দিল্লি ও উত্তর ভারতের পানির সংকট সমাধানে নতুন পরিকল্পনা
ভারতের রাজধানী দিল্লি ও উত্তরাঞ্চলের পানির সংকট মোকাবিলায় নতুন উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। শুক্রবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মনোহর লাল খাট্টার জানান, পাকিস্তানের সঙ্গে ইন্দাস ওয়াটার ট্রিটি স্থগিত হওয়ায় ভারতের প্রাপ্য পানি এখন দেশের বিভিন্ন রাজ্যে সরবরাহের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আগামী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে এই পানি দিল্লি ও আশপাশের রাজ্যে পৌঁছাতে পারে।
মন্ত্রী এদিন রাজধানীর ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান উদ্বোধনের সময় বলেন, দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে জলাবদ্ধতা ও বন্যা সমস্যার সমাধানের পাশাপাশি পানির সংকট নিরসনেও সরকার নতুন উদ্যোগ নিচ্ছে।
পাকিস্তানে যাওয়া পানি ভারতেই ব্যবহারের সিদ্ধান্ত
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইতিমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন যে ইন্দাস ওয়াটার ট্রিটি আপাতত স্থগিত থাকবে। ফলে পাকিস্তানের দিকে যে বিপুল পানি প্রবাহিত হতো, সেটি এখন ভারতের ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করছে। আগামী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা ও রাজস্থানসহ একাধিক রাজ্যে এ পানি সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে কীভাবে পানি দিল্লিতে পৌঁছানো হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা এখনও প্রকাশ করেননি খাট্টার।
ইন্দাস ওয়াটার ট্রিটি: একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ইন্দাস ওয়াটার ট্রিটি স্বাক্ষরিত হয়। ওই চুক্তি অনুযায়ী, পাকিস্তান ৮০ শতাংশ এবং ভারত ২০ শতাংশ পানির অধিকার পায়। ইন্দাস অববাহিকায় মোট ছয়টি বড় নদী রয়েছে—ইন্দাস, ঝিলম, চেনাব, রাভি, বিয়াস ও শতদ্রু। এর মধ্যে ইন্দাস ও শতদ্রু নদীর উৎপত্তি চীনে হলেও বাকি চারটি ভারতের ভেতর দিয়ে পাকিস্তানে প্রবাহিত হয়।
গত এপ্রিল মাসে জম্মু-কাশ্মীরের পাহালগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর ভারত এ চুক্তি স্থগিত করার ঘোষণা দেয়। ভারতের অভিযোগ, পাকিস্তান বারবার চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেছে। অন্যদিকে পাকিস্তান হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, ভারত যদি পানি আটকায় বা প্রবাহ পরিবর্তন করে তবে সেটি যুদ্ধ ঘোষণার শামিল হবে।
অপারেশন সিন্ধুর পর ভারতের অবস্থান
অপারেশন সিন্ধু সফল হলেও ভারত স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, চুক্তি স্থগিতই থাকবে। গত ৬৫ বছরে বাঁধ প্রযুক্তির উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক প্রবাহ হ্রাসের কারণে ভারতের প্রাপ্য পানির পরিমাণও কমে গেছে। এসব কারণেই ভারত দীর্ঘদিন ধরে চুক্তি পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়ে আসছে।
নতুন বাঁধ নির্মাণে জোর
দিল্লির পানির চাহিদা মেটাতে হাঠনিকুন্ড ব্যারাজের কাছে একটি নতুন বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে কেন্দ্র। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রাইসওয়াটারহাউসকুপারস (PwC)-এর সঙ্গে আলোচনা চলছে।
মন্ত্রী খাট্টার জানান, হাঠনিকুন্ড ব্যারাজ কোনো বাঁধ নয়; ফলে এটি পানি সংরক্ষণ করতে পারে না। সেখানে নতুন একটি বাঁধ তৈরি করা হলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি দিল্লি ও আশপাশের রাজ্যের জন্য ২-৩ মাসের অতিরিক্ত পানির সংস্থান করা সম্ভব হবে।
হিমাচল ও উত্তরাখণ্ডে আরও তিন বাঁধ
সরকারি পরিকল্পনা অনুযায়ী, হিমাচল প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডে আরও তিনটি বড় বাঁধ নির্মাণের কাজ এগোচ্ছে। এগুলো হলো—রেনুকা, লাখওয়ার ও কিশাউ বাঁধ।
রেনুকা বাঁধ: হিমাচল প্রদেশের সিরমৌর জেলার গিরি নদীর ওপর।
লাখওয়ার বাঁধ: উত্তরাখণ্ডের দেরাদুন জেলার লাখওয়ার গ্রামের কাছে যমুনা নদীর ওপর।
কিশাউ বাঁধ: উত্তরাখণ্ডে যমুনার শাখা নদী টন্স নদীর ওপর।
মন্ত্রী জানান, রেনুকা ও লাখওয়ার বাঁধ নির্মাণ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। কিশাউ বাঁধের ক্ষেত্রে একটি ছোট প্রযুক্তিগত জটিলতা রয়েছে, যা কয়েক মাসের মধ্যে সমাধান হবে। এই বাঁধগুলো চালু হলে দিল্লি শুধু পানির সংকটমুক্তই হবে না, বরং উদ্বৃত্ত পানিও পাবে।
সরকারের দাবি, ইন্দাস ওয়াটার ট্রিটি স্থগিতের ফলে যে নতুন জলসম্পদ ভারতের হাতে এসেছে, তা শুধু দিল্লি নয়, বরং সমগ্র উত্তর ভারতের জন্য সুফল বয়ে আনবে। দীর্ঘমেয়াদে এটি পানির সংকট নিরসনে একটি বড় সুযোগ হয়ে উঠতে পারে।