০২:৫৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

হয়রানি ও বৈষম্যে বিপন্ন ব্যবসায়ীরা: অর্থনীতির মেরুদণ্ডে চাপ

অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর: আশার বদলে হতাশা

অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্ণ হলো। সাধারণ মানুষ যেমন শান্তি ও স্থিতিশীলতা খুঁজে পাচ্ছেন না, তেমনি দেশের ব্যবসায়ী সমাজও আশাহত। সরকারের কাছ থেকে তারা আস্থা, সহায়তা ও দিকনির্দেশনা পাওয়ার আশা করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বরং আগের চেয়ে ব্যবসায়ীরা বেশি চাপ ও সমস্যায় পড়েছেন।

অর্থনীতি যেখানে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপর নির্ভরশীল, সেখানে এই আস্থাহীনতা একটি বড় সংকেত।

 

হয়রানি ও প্রশাসনিক চাপ

ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন, অনেক শীর্ষ উদ্যোক্তাকে মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে। বিদেশ ভ্রমণে বাধা, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ, এমনকি গ্রেপ্তার আতঙ্ক—এসব কারণে তারা ব্যবসার মূল কাজে মনোযোগ দিতে পারছেন না।

অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগেই এই ধরনের হয়রানি শুধু আইনের শাসনকেই দুর্বল করছে না, বরং ব্যবসা ও বাণিজ্যের স্বাভাবিক প্রবাহও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

এর সঙ্গে জুড়ে গেছে গ্যাসের সংকট, উচ্চ সুদ, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি এবং আইন-শৃঙ্খলার অবনতি। অথচ এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের কোনো কাঠামোগত বৈঠক হয়নি।

বিনিয়োগের মন্দা: কর্মসংস্থানের হুমকি

দেশে নতুন বিনিয়োগ কার্যত থমকে গেছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে চাকরির বাজারে—নতুন চাকরি তৈরি হচ্ছে না, বরং অনেক মানুষ বিদ্যমান চাকরি হারাচ্ছেন।

বেশ কিছু উদ্যোক্তা ঋণ শোধ করতে না পেরে ঋণখেলাপি হয়ে পড়ছেন। সরকার প্রণোদনা ঘোষণা করলেও, ব্যবসায়ীরা বলছেন, সেই সুবিধা খুব সীমিত সংখ্যক প্রতিষ্ঠানই পেয়েছে। ফলে অধিকাংশ ব্যবসায়ী বঞ্চিত হয়েছেন। এর প্রভাব পড়ছে রাজস্ব আদায়েও, যা অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করছে।

গুজবআতঙ্ক ও আস্থাহীনতা

ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, একটি গোষ্ঠী ইচ্ছে করে সরকারকে বিভ্রান্ত করেছে। ফলে শীর্ষ উদ্যোক্তাদের টার্গেট করে হয়রানি চালানো হয়েছে। এমনকি ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার গুজব ছড়ানো হয়েছে, যার কারণে বিদেশি ক্রেতারা আস্থা হারিয়েছেন।

ফলাফল হয়েছে ভয়াবহ—অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, হাজারো মানুষ চাকরি হারিয়েছেন।

সংগঠনের দৃষ্টিভঙ্গি

বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

  • ঢাকা চেম্বার বলছে, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। ডলার সংকট, ঋণ প্রবাহের সমস্যা এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
  • বিটিএমএ সভাপতির মতে, গ্যাস সংকট আর মূলধনের ঘাটতির কারণে শিল্প খাত ধ্বংসের মুখে।
  • চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ অভিযোগ করছে, আইন-শৃঙ্খলা ও জ্বালানি খাতে কোনো উন্নতি হয়নি।
  • সিমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন সরাসরি বলেছে, ব্যবসায়ীরা সম্মান পাচ্ছেন না; বরং জেল-জুলুম ও দুর্ব্যবহার সহ্য করতে হচ্ছে।

এই মন্তব্যগুলো ইঙ্গিত করছে, সমস্যাটি শুধু ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের নয়, বরং সার্বিক ব্যবসা পরিবেশের।

অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র

বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি জানিয়েছে, ২০২৫ সালে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যের নিচে নেমে যেতে পারে। এর পেছনে অর্থনীতির স্থবিরতা ও কর্মসংস্থানের ঘাটতি দায়ী।

সরকারি চাকরির সংখ্যা খুবই সীমিত—দেশের মোট চাকরির মাত্র ৩.৮%। ফলে অধিকাংশ মানুষ নির্ভরশীল বেসরকারি খাতের ওপর। যদি সেই খাত দুর্বল হয়ে পড়ে, তবে সাধারণ মানুষের জীবিকা সরাসরি হুমকির মুখে পড়বে।

এ ছাড়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৩.৯৭%—যা গত বছরের তুলনায় কম। বেসরকারি বিনিয়োগ কমেছে, রাজস্ব আদায়ও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম হয়েছে। অর্থনীতির মূল সূচকগুলোই উদ্বেগজনক।

বিদেশি বিনিয়োগে আগ্রহহীনতা

সরকার পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার প্রতিশ্রুতি দিলেও তাতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য আসেনি। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নানা সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হলেও তারা ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছেন না।

কারণ স্পষ্ট: যখন দেশীয় ব্যবসায়ীরাই আস্থা পাচ্ছেন না, তখন বিদেশিরা কেন এখানে বিনিয়োগ করবেন?

বাজারে আতঙ্কের ছায়া

শীর্ষ উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের কারণে ছোট ব্যবসায়ী ও নতুন উদ্যোক্তারাও আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। এতে বাজারে সরবরাহ কমছে, দাম বাড়ছে, এবং সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়ছেন।

অর্থনীতিবিদদের মতে, ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে আইনি প্রমাণের ভিত্তিতেই নিতে হবে। ভয়ভীতি বা প্রশাসনিক চাপ দিয়ে সমস্যার সমাধান হয় না, বরং নতুন সংকট তৈরি হয়।

টিকে থাকার লড়াই

বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলো ব্যবসায়ী সমাজ। কর্মসংস্থান ও উৎপাদন নির্ভর করছে তাঁদের ওপর। তাঁদের আস্থা ও স্থিতিশীলতা ছাড়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়।

ভুল বা অপরাধ থাকলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। তবে হয়রানি ও বৈষম্য অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করছে। ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, স্থিতিশীলতা ফেরাতে হলে একটি নির্বাচিত সরকার ছাড়া কোনো সমাধান নেই।

 

 

হয়রানি ও বৈষম্যে বিপন্ন ব্যবসায়ীরা: অর্থনীতির মেরুদণ্ডে চাপ

১২:০৪:৪৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর: আশার বদলে হতাশা

অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্ণ হলো। সাধারণ মানুষ যেমন শান্তি ও স্থিতিশীলতা খুঁজে পাচ্ছেন না, তেমনি দেশের ব্যবসায়ী সমাজও আশাহত। সরকারের কাছ থেকে তারা আস্থা, সহায়তা ও দিকনির্দেশনা পাওয়ার আশা করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বরং আগের চেয়ে ব্যবসায়ীরা বেশি চাপ ও সমস্যায় পড়েছেন।

অর্থনীতি যেখানে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপর নির্ভরশীল, সেখানে এই আস্থাহীনতা একটি বড় সংকেত।

 

হয়রানি ও প্রশাসনিক চাপ

ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন, অনেক শীর্ষ উদ্যোক্তাকে মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে। বিদেশ ভ্রমণে বাধা, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ, এমনকি গ্রেপ্তার আতঙ্ক—এসব কারণে তারা ব্যবসার মূল কাজে মনোযোগ দিতে পারছেন না।

অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগেই এই ধরনের হয়রানি শুধু আইনের শাসনকেই দুর্বল করছে না, বরং ব্যবসা ও বাণিজ্যের স্বাভাবিক প্রবাহও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

এর সঙ্গে জুড়ে গেছে গ্যাসের সংকট, উচ্চ সুদ, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি এবং আইন-শৃঙ্খলার অবনতি। অথচ এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের কোনো কাঠামোগত বৈঠক হয়নি।

বিনিয়োগের মন্দা: কর্মসংস্থানের হুমকি

দেশে নতুন বিনিয়োগ কার্যত থমকে গেছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে চাকরির বাজারে—নতুন চাকরি তৈরি হচ্ছে না, বরং অনেক মানুষ বিদ্যমান চাকরি হারাচ্ছেন।

বেশ কিছু উদ্যোক্তা ঋণ শোধ করতে না পেরে ঋণখেলাপি হয়ে পড়ছেন। সরকার প্রণোদনা ঘোষণা করলেও, ব্যবসায়ীরা বলছেন, সেই সুবিধা খুব সীমিত সংখ্যক প্রতিষ্ঠানই পেয়েছে। ফলে অধিকাংশ ব্যবসায়ী বঞ্চিত হয়েছেন। এর প্রভাব পড়ছে রাজস্ব আদায়েও, যা অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করছে।

গুজবআতঙ্ক ও আস্থাহীনতা

ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, একটি গোষ্ঠী ইচ্ছে করে সরকারকে বিভ্রান্ত করেছে। ফলে শীর্ষ উদ্যোক্তাদের টার্গেট করে হয়রানি চালানো হয়েছে। এমনকি ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার গুজব ছড়ানো হয়েছে, যার কারণে বিদেশি ক্রেতারা আস্থা হারিয়েছেন।

ফলাফল হয়েছে ভয়াবহ—অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, হাজারো মানুষ চাকরি হারিয়েছেন।

সংগঠনের দৃষ্টিভঙ্গি

বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

  • ঢাকা চেম্বার বলছে, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। ডলার সংকট, ঋণ প্রবাহের সমস্যা এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
  • বিটিএমএ সভাপতির মতে, গ্যাস সংকট আর মূলধনের ঘাটতির কারণে শিল্প খাত ধ্বংসের মুখে।
  • চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ অভিযোগ করছে, আইন-শৃঙ্খলা ও জ্বালানি খাতে কোনো উন্নতি হয়নি।
  • সিমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন সরাসরি বলেছে, ব্যবসায়ীরা সম্মান পাচ্ছেন না; বরং জেল-জুলুম ও দুর্ব্যবহার সহ্য করতে হচ্ছে।

এই মন্তব্যগুলো ইঙ্গিত করছে, সমস্যাটি শুধু ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের নয়, বরং সার্বিক ব্যবসা পরিবেশের।

অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র

বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি জানিয়েছে, ২০২৫ সালে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যের নিচে নেমে যেতে পারে। এর পেছনে অর্থনীতির স্থবিরতা ও কর্মসংস্থানের ঘাটতি দায়ী।

সরকারি চাকরির সংখ্যা খুবই সীমিত—দেশের মোট চাকরির মাত্র ৩.৮%। ফলে অধিকাংশ মানুষ নির্ভরশীল বেসরকারি খাতের ওপর। যদি সেই খাত দুর্বল হয়ে পড়ে, তবে সাধারণ মানুষের জীবিকা সরাসরি হুমকির মুখে পড়বে।

এ ছাড়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৩.৯৭%—যা গত বছরের তুলনায় কম। বেসরকারি বিনিয়োগ কমেছে, রাজস্ব আদায়ও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম হয়েছে। অর্থনীতির মূল সূচকগুলোই উদ্বেগজনক।

বিদেশি বিনিয়োগে আগ্রহহীনতা

সরকার পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার প্রতিশ্রুতি দিলেও তাতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য আসেনি। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নানা সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হলেও তারা ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছেন না।

কারণ স্পষ্ট: যখন দেশীয় ব্যবসায়ীরাই আস্থা পাচ্ছেন না, তখন বিদেশিরা কেন এখানে বিনিয়োগ করবেন?

বাজারে আতঙ্কের ছায়া

শীর্ষ উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের কারণে ছোট ব্যবসায়ী ও নতুন উদ্যোক্তারাও আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। এতে বাজারে সরবরাহ কমছে, দাম বাড়ছে, এবং সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়ছেন।

অর্থনীতিবিদদের মতে, ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে আইনি প্রমাণের ভিত্তিতেই নিতে হবে। ভয়ভীতি বা প্রশাসনিক চাপ দিয়ে সমস্যার সমাধান হয় না, বরং নতুন সংকট তৈরি হয়।

টিকে থাকার লড়াই

বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলো ব্যবসায়ী সমাজ। কর্মসংস্থান ও উৎপাদন নির্ভর করছে তাঁদের ওপর। তাঁদের আস্থা ও স্থিতিশীলতা ছাড়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়।

ভুল বা অপরাধ থাকলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। তবে হয়রানি ও বৈষম্য অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করছে। ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, স্থিতিশীলতা ফেরাতে হলে একটি নির্বাচিত সরকার ছাড়া কোনো সমাধান নেই।