১০:৪২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫

বন্ধ গার্মেন্টস কেনাকাটা কেন্দ্র থেকে ফেসবুকের মাছ বিক্রি: রহিম ভাইয়ের টিকে থাকার লড়াই

পুরনো দিনের সমাপ্তি

গার্মেন্টস কেনাকাটার জগতে একসময় ব্যস্ততম ছিলেন রহিম ভাই (ছদ্মনাম)। ঢাকার মিরপুরে তার ছোট্ট কেনাকাটা কেন্দ্র বা বায়িং হাউস ছিল, যেখানে বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ চলত। অর্ডার নিতেন, ডিজাইন তৈরি হতো, কারখানায় কাজ চলতসবকিছু যেন এক ছন্দে এগোচ্ছিল।

কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক অস্থিরতা সবকিছু উল্টে দেয়। সেদিনের সহিংসতা,  আর দীর্ঘ সময়ের অস্থিতিশীলতায় তার ব্যবসা একেবারেই ভেঙে পড়ে। বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশে অর্ডার স্থগিত করে দেয়, যেসব কারখানার সঙ্গে তার চুক্তি ছিল তারা সময়মতো কাজ দিতে পারেনি।

“আমার বায়িং হাউসের মূল শক্তি ছিল সময়মতো পণ্য সরবরাহ করা। যখন সেটা সম্ভব হলো না, ক্রেতারা চুক্তি বাতিল করল। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ব্যবসা ধসে পড়ল,” বলেন রহিম ভাই।

অচলাবস্থা থেকে নতুন পথের খোঁজে

ব্যবসা বন্ধ হওয়ায় তার হাতে কোনো সঞ্চয় অবশিষ্ট রইল না। দুই সন্তানের স্কুলের খরচ, পরিবারের চিকিৎসা ব্যয়, ভাড়াসবকিছু মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়ল। অনেক রাত জেগে ভেবে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, নিজের টিকে থাকার জন্য কিছু করতে হবে, তা যত ছোটই হোক।

গ্রামের বাড়িতে তার মাছের খামার ছিল। আগে শুধু আত্মীয়-স্বজনকে দিতেন, কিন্তু এবার তিনি ভিন্নভাবে ভাবলেন। হাতে থাকা স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট ব্যবহার করে ফেসবুকে মাছ বিক্রির কাজ শুরু করলেন।

প্রথমদিকে লজ্জা লাগলেও পরে বুঝলেন এটাই বাঁচার উপায়। ফেসবুক লাইভে গিয়ে টি

তেলাপিয়া, রুই, কাতলা দেখিয়ে অর্ডার নিতে শুরু করলেন। আশপাশের এলাকাতেও ডেলিভারি দিচ্ছেন।

ফেসবুক লাইভে নতুন গ্রাহক

প্রথমদিনের লাইভে খুব বেশি সাড়া পাননি। কিন্তু নিয়মিত ছবি পোস্ট করা, ভিডিও দেওয়া এবং ক্রেতাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের ফলে ধীরে ধীরে বিক্রি বাড়তে থাকে।

“আমি আগে বিদেশি ক্রেতাদের ইমেইল দিতাম, এখন দেশের মানুষকে ফেসবুক মেসেঞ্জারে জবাব দেই,” রহিম ভাই হাসিমুখে বললেন।

প্রতিদিন বিকেলে তিনি লাইভে এসে মাছের আকার, দাম এবং রান্নার টিপসও দেন। এভাবে তার পেজে এখন কয়েকশো ফলোয়ার জমেছে। অনেক পুরনো বন্ধু, যারা তার গার্মেন্টস ব্যবসার সঙ্গী ছিলেন, তার এই নতুন উদ্যোগ দেখে অবাক হয়েছেন।

চ্যালেঞ্জ ও সংগ্রাম

তবে এই পথ মোটেও সহজ নয়। মাছ সংরক্ষণ, পরিবহন এবং ডেলিভারির জন্য অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে। অনেক সময় মাছ পৌঁছানোর আগেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

“গার্মেন্টসে লাভের মার্জিন ছিল বেশি। এখানে প্রতিটি কেজি মাছ থেকে কয়েক টাকা লাভ হয়, কিন্তু পরিশ্রম কয়েকগুণ বেশি,” তিনি জানান।

এ ছাড়া ফেসবুক অ্যালগরিদমের কারণে পোস্ট সবসময় সবার কাছে পৌঁছায় না। এজন্য তিনি নিজের পেজের প্রচারে সময় দিচ্ছেন। মাঝে মাঝে ফেসবুক বিজ্ঞাপনও দেন, যদিও সেটি তার জন্য ব্যয়বহুল।

অভিজ্ঞতার আলোকে ভবিষ্যৎ

যদিও ব্যবসার ধরণ সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে, রহিম ভাই এখনো আশা ছাড়েননি। তিনি বিশ্বাস করেন, একসময় ফেসবুকের এই ব্যবসাকে আরও বড় পর্যায়ে নিতে পারবেন।

তার স্বপ্ন হলো, গ্রামে একটি আধুনিক মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র গড়ে তোলা। সেখান থেকে শুধু ঢাকায় নয়, দেশের অন্যান্য শহরেও মাছ সরবরাহ করবেন।

৫ আগস্টের রাজনৈতিক অস্থিরতা রহিম ভাইয়ের মতো হাজারো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর জীবনকে ওলটপালট করে দিয়েছে। কিন্তু জীবনের চাকা থেমে থাকে না। গার্মেন্টসের জগৎ থেকে ফেসবুক লাইভে মাছ বিক্রিএ যেন এক রূপকথার মতো রূপান্তর।

জনপ্রিয় সংবাদ

প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার গানের জগতে ফিরে আসা: ‘লাস্ট ক্রিসমাস’ ডেসি ভার্সন নিয়ে নেটিজেনদের কটাক্ষ

বন্ধ গার্মেন্টস কেনাকাটা কেন্দ্র থেকে ফেসবুকের মাছ বিক্রি: রহিম ভাইয়ের টিকে থাকার লড়াই

০২:০০:৫৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

পুরনো দিনের সমাপ্তি

গার্মেন্টস কেনাকাটার জগতে একসময় ব্যস্ততম ছিলেন রহিম ভাই (ছদ্মনাম)। ঢাকার মিরপুরে তার ছোট্ট কেনাকাটা কেন্দ্র বা বায়িং হাউস ছিল, যেখানে বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ চলত। অর্ডার নিতেন, ডিজাইন তৈরি হতো, কারখানায় কাজ চলতসবকিছু যেন এক ছন্দে এগোচ্ছিল।

কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক অস্থিরতা সবকিছু উল্টে দেয়। সেদিনের সহিংসতা,  আর দীর্ঘ সময়ের অস্থিতিশীলতায় তার ব্যবসা একেবারেই ভেঙে পড়ে। বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশে অর্ডার স্থগিত করে দেয়, যেসব কারখানার সঙ্গে তার চুক্তি ছিল তারা সময়মতো কাজ দিতে পারেনি।

“আমার বায়িং হাউসের মূল শক্তি ছিল সময়মতো পণ্য সরবরাহ করা। যখন সেটা সম্ভব হলো না, ক্রেতারা চুক্তি বাতিল করল। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ব্যবসা ধসে পড়ল,” বলেন রহিম ভাই।

অচলাবস্থা থেকে নতুন পথের খোঁজে

ব্যবসা বন্ধ হওয়ায় তার হাতে কোনো সঞ্চয় অবশিষ্ট রইল না। দুই সন্তানের স্কুলের খরচ, পরিবারের চিকিৎসা ব্যয়, ভাড়াসবকিছু মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়ল। অনেক রাত জেগে ভেবে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, নিজের টিকে থাকার জন্য কিছু করতে হবে, তা যত ছোটই হোক।

গ্রামের বাড়িতে তার মাছের খামার ছিল। আগে শুধু আত্মীয়-স্বজনকে দিতেন, কিন্তু এবার তিনি ভিন্নভাবে ভাবলেন। হাতে থাকা স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট ব্যবহার করে ফেসবুকে মাছ বিক্রির কাজ শুরু করলেন।

প্রথমদিকে লজ্জা লাগলেও পরে বুঝলেন এটাই বাঁচার উপায়। ফেসবুক লাইভে গিয়ে টি

তেলাপিয়া, রুই, কাতলা দেখিয়ে অর্ডার নিতে শুরু করলেন। আশপাশের এলাকাতেও ডেলিভারি দিচ্ছেন।

ফেসবুক লাইভে নতুন গ্রাহক

প্রথমদিনের লাইভে খুব বেশি সাড়া পাননি। কিন্তু নিয়মিত ছবি পোস্ট করা, ভিডিও দেওয়া এবং ক্রেতাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের ফলে ধীরে ধীরে বিক্রি বাড়তে থাকে।

“আমি আগে বিদেশি ক্রেতাদের ইমেইল দিতাম, এখন দেশের মানুষকে ফেসবুক মেসেঞ্জারে জবাব দেই,” রহিম ভাই হাসিমুখে বললেন।

প্রতিদিন বিকেলে তিনি লাইভে এসে মাছের আকার, দাম এবং রান্নার টিপসও দেন। এভাবে তার পেজে এখন কয়েকশো ফলোয়ার জমেছে। অনেক পুরনো বন্ধু, যারা তার গার্মেন্টস ব্যবসার সঙ্গী ছিলেন, তার এই নতুন উদ্যোগ দেখে অবাক হয়েছেন।

চ্যালেঞ্জ ও সংগ্রাম

তবে এই পথ মোটেও সহজ নয়। মাছ সংরক্ষণ, পরিবহন এবং ডেলিভারির জন্য অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে। অনেক সময় মাছ পৌঁছানোর আগেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

“গার্মেন্টসে লাভের মার্জিন ছিল বেশি। এখানে প্রতিটি কেজি মাছ থেকে কয়েক টাকা লাভ হয়, কিন্তু পরিশ্রম কয়েকগুণ বেশি,” তিনি জানান।

এ ছাড়া ফেসবুক অ্যালগরিদমের কারণে পোস্ট সবসময় সবার কাছে পৌঁছায় না। এজন্য তিনি নিজের পেজের প্রচারে সময় দিচ্ছেন। মাঝে মাঝে ফেসবুক বিজ্ঞাপনও দেন, যদিও সেটি তার জন্য ব্যয়বহুল।

অভিজ্ঞতার আলোকে ভবিষ্যৎ

যদিও ব্যবসার ধরণ সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে, রহিম ভাই এখনো আশা ছাড়েননি। তিনি বিশ্বাস করেন, একসময় ফেসবুকের এই ব্যবসাকে আরও বড় পর্যায়ে নিতে পারবেন।

তার স্বপ্ন হলো, গ্রামে একটি আধুনিক মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র গড়ে তোলা। সেখান থেকে শুধু ঢাকায় নয়, দেশের অন্যান্য শহরেও মাছ সরবরাহ করবেন।

৫ আগস্টের রাজনৈতিক অস্থিরতা রহিম ভাইয়ের মতো হাজারো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর জীবনকে ওলটপালট করে দিয়েছে। কিন্তু জীবনের চাকা থেমে থাকে না। গার্মেন্টসের জগৎ থেকে ফেসবুক লাইভে মাছ বিক্রিএ যেন এক রূপকথার মতো রূপান্তর।