সারসংক্ষেপ
- যুক্তরাজ্য,কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও পর্তুগাল ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে
- ইসরায়েল তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে,ট্রাম্পের অবস্থানকেও চ্যালেঞ্জ করেছে এই সিদ্ধান্ত
- গাজা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পশ্চিমা দেশগুলোর হতাশা থেকে পদক্ষেপ
- নেতানিয়াহুর ভাষায় এটি “সন্ত্রাসবাদের জন্য বড় পুরস্কার”
চার দেশের স্বীকৃতি ও প্রেক্ষাপট
রবিবার যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও পর্তুগাল আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। গাজা যুদ্ধের দীর্ঘস্থায়ী সংকট এবং দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর ফলে ইসরায়েল তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
ইতিমধ্যে ১৪০টিরও বেশি দেশ ফিলিস্তিনের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন করেছে। পশ্চিমা এই চার দেশ ঐতিহ্যগতভাবে ইসরায়েলের মিত্র হিসেবে পরিচিত হওয়ায় তাদের অবস্থান বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে।
যুক্তরাজ্যের প্রতীকী ভূমিকা
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মার ঘোষণা দেন, “আজ আমরা ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলিদের জন্য শান্তির আশা পুনরুজ্জীবিত করতে এবং দুই রাষ্ট্র সমাধানকে এগিয়ে নিতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিচ্ছি।”
তিনি আরও বলেন, “গাজায় মানুষসৃষ্ট মানবিক বিপর্যয় ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন ও ক্রমবর্ধমান বোমাবর্ষণ, অনাহার ও ধ্বংসযজ্ঞ সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।”
ব্রিটেনের এই সিদ্ধান্ত বিশেষ প্রতীকী, কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আধুনিক ইসরায়েল প্রতিষ্ঠায় তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেন, “যেসব নেতা অক্টোবর ৭-এর ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের পর ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছেন, তারা সন্ত্রাসবাদকে বিশাল পুরস্কার দিচ্ছেন।” তিনি আরও যোগ করেন, “জর্ডান নদীর পশ্চিমে কোনো ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হবে না।”
২০২৩ সালের হামাস নেতৃত্বাধীন হামলায় ১,২০০ জন ইসরায়েলি নিহত হয় এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়। তার জবাবে ইসরায়েলের গাজা অভিযান প্রায় দুই বছরে স্থানীয় হিসেবে ৬৫ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে, যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজার বেশিরভাগ অবকাঠামো, ছড়িয়ে পড়েছে দুর্ভিক্ষ, এবং বারবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে লাখ লাখ মানুষ।
ফিলিস্তিনিদের প্রতিক্রিয়া
হেবরনের বাসিন্দা শরাফ আল তারাওয়া বলেন, “আজকের সিদ্ধান্ত মানবতার দায়িত্ব। ব্রিটেনের ভূমিকা এখন এই নৈতিক কর্তব্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।”
হামাস এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও বলেছে, এটি কার্যকর পদক্ষেপে রূপ নিতে হবে, যাতে গাজায় যুদ্ধ বন্ধ হয় এবং পশ্চিম তীর দখল প্রতিরোধ করা যায়।
ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেন, এই স্বীকৃতি দুই রাষ্ট্রকে নিরাপত্তা, শান্তি ও সৌহার্দ্যের সঙ্গে পাশাপাশি বসবাসের পথে সহায়ক হবে।
পশ্চিমা দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ চাপ
ব্রিটেনের জনগণ ও রাজনৈতিক মহল গাজায় বাড়তে থাকা মৃত্যুর সংখ্যা ও ক্ষুধার্ত শিশুদের ছবি দেখে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করেছিল। অনেকেই ক্ষুব্ধ ছিলেন, কারণ তাদের সরকার এখনো ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ চালিয়ে যাচ্ছে।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি বলেন, এই সিদ্ধান্ত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চাইতে থাকা মানুষকে শক্তিশালী করবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এটি কোনোভাবেই সন্ত্রাসবাদের পুরস্কার নয়।
পর্তুগালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাওলো র্যাঞ্জেল বলেন, “দুই রাষ্ট্র সমাধানই ন্যায়সঙ্গত ও স্থায়ী শান্তির একমাত্র পথ। যুদ্ধবিরতি এখন জরুরি।”
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ডানপন্থী প্রতিক্রিয়া
যুক্তরাষ্ট্র তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পূর্বে স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, তিনি এই ধরনের স্বীকৃতির বিরোধী।
অন্যদিকে ইসরায়েলের নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির ঘোষণা দেন, তিনি পশ্চিম তীরকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলের অংশ হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব দেবেন। এটি কার্যত ১৯৬৭ সালে দখল করা ভূখণ্ড সংযুক্তির ইঙ্গিত।
ব্রিটেনের ঐতিহাসিক ভূমিকা
১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সেনারা অটোমান সাম্রাজ্যের কাছ থেকে জেরুজালেম দখল করে। এরপর ১৯২২ সালে লিগ অব নেশন্স ব্রিটেনকে ফিলিস্তিন পরিচালনার দায়িত্ব দেয়। এই প্রেক্ষাপটেই ব্রিটেনের বর্তমান সিদ্ধান্তকে ইতিহাস সংশোধনের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন অনেকে।
লন্ডনে ফিলিস্তিনি মিশনের প্রধান হুসাম জোমলট বলেন, “আজকের দিনটি ইতিহাস সংশোধনের দিন। ব্রিটিশ সরকার ও জনগণের পক্ষ থেকে এই ঘোষণা ন্যায়ের প্রতিশ্রুতি।”
ভিন্নমত ও সমালোচনা
তবে অনেকে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। ব্রিটিশ-ইসরায়েলি জিম্মি এমিলি দামারির মা বলেন, “গাজার শাসন এখনো হামাসের হাতে, যারা ইসরায়েল ধ্বংস করতে চায়। এই স্বীকৃতি হামাসকে পুরস্কৃত করা হচ্ছে।”
চার পশ্চিমা দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক নতুন বাস্তবতা তৈরি হলো। গাজার যুদ্ধ থামাতে ও শান্তি পুনরুদ্ধারে এটি কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে এখনো বড় প্রশ্ন রয়ে গেছে। তবে ফিলিস্তিনিদের জন্য এটি নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক সান্ত্বনা ও আশার প্রতীক।