০৩:০৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

চীনের উপর নির্ভরতার দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে ইরান

কৌশলগত বিপর্যয়

গত এক বছরে ধারাবাহিক ক্ষতিতে ইরানের দীর্ঘমেয়াদি কৌশল ভেঙে পড়েছে। গাজায় হামাসের প্রায় ধ্বংস, লেবাননের হিজবুল্লাহ দুর্বল হয়ে পড়া এবং সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের পতন—এই তিনটি ঘটনায় ইরান তার দীর্ঘদিনের আঞ্চলিক প্রতিনিধি বাহিনী হারিয়েছে। ফলে ইসরায়েল জুন মাসে ইরানের বিরুদ্ধে ১২ দিনের যুদ্ধ চালাতে পেরেছিল আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়ার ভয় ছাড়াই। সেই যুদ্ধে ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পারমাণবিক কর্মসূচি পিছিয়ে যায়।

বিকল্পহীন তেহরান

ইরান এখন তার হারানো প্রভাব ফেরানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকে ইসরায়েলের আগ্রাসী অবস্থান ইরানের পক্ষে নতুন প্রতিনিধি বাহিনী গড়ে তোলা বা হিজবুল্লাহকে পুনরায় অস্ত্র দেওয়াকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে। নিজস্ব ভূখণ্ড রক্ষায় অক্ষম ইরান নতুন প্রক্সি গড়ে তুলতে বা দ্রুত পারমাণবিক বোমা বানাতে গেলে শাসনব্যবস্থা ধ্বংসের ঝুঁকি বাড়বে।

নিকট ভবিষ্যতে ইরানের সবচেয়ে বাস্তবসম্মত পথ হতে পারে চীনের সাথে সামরিক সহযোগিতা বাড়ানো। আগে চীন মধ্যপ্রাচ্যে পক্ষপাত এড়িয়ে চলত, কিন্তু ইসরায়েল-আরব উত্তেজনার নতুন প্রেক্ষাপটে বেইজিং হয়তো ইরানকে সহায়তা করতে আগ্রহী হতে পারে।

সিরিয়ার নতুন বাধা

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সিরিয়ার আসাদ সরকার উৎখাত হওয়ার পর নতুন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা স্পষ্ট করেছেন, তার দেশে ইরানি প্রভাব আর গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি তুরস্কসহ ইরানের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছেন এবং ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের দায়ী করেছেন অস্থিরতার জন্য। তবে নতুন সরকার দেশকে একীভূত করতে হিমশিম খাচ্ছে। এই ফাঁক ব্যবহার করে ইরান ভেতরে অখুশি গোষ্ঠীগুলোকে অর্থায়নের মাধ্যমে পাশে টানতে পারে।

যদি যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহার করে নেয়, ইরান আরও সুযোগ পেতে পারে। তবে সিরিয়ার ট্রানজিট রুট না থাকলে লেবাননে অস্ত্র পাঠানোর উপায় সীমিত থাকবে—আকাশ বা সমুদ্রপথে, যা সহজেই ইসরায়েল আটকাতে পারে। ইতিমধ্যেই হিজবুল্লাহর নেতৃত্ব ভেঙে পড়েছে এবং সংগঠনটি অস্ত্র পরিত্যাগের চাপের মুখে।

প্রক্সি কৌশলের সীমাবদ্ধতা

হিজবুল্লাহর ক্ষয়ক্ষতির ফলে ইরান কার্যত তার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধক হাতিয়ার হারিয়েছে। ইয়েমেনের হুথিরা রেড সিতে জাহাজে হামলা চালালেও তারা ইরানকে ইসরায়েলের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে পারেনি। ইরাকের শিয়া মিলিশিয়াদের সামর্থ্যও সীমিত।

ইরান চাইলে সরাসরি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে ঝুঁকতে পারে। ইতোমধ্যে তাদের কাছে কয়েকটি অস্ত্র বানানোর মতো উচ্চমাত্রার ইউরেনিয়াম রয়েছে। তবে এ পথে অগ্রসর হওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা নজরদারির কারণে যেকোনো গোপন কার্যক্রম নতুন ও বিধ্বংসী হামলার কারণ হতে পারে। আর আকাশ প্রতিরক্ষা দুর্বল থাকায় তৈরি হলেও এসব অস্ত্র নিরাপদ থাকবে না।

প্রচলিত প্রতিরক্ষার ঘাটতি

১২ দিনের যুদ্ধে ইরান ইসরায়েলি শহরগুলোতে আঘাত হানতে পারলেও কার্যকর সামরিক লক্ষ্যে আঘাত করতে ব্যর্থ হয়। ইসরায়েলের শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কার্যত নিষ্ক্রিয় করে দেয়। পরবর্তীতে ইসরায়েল ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপকেও ধ্বংস করে।

ইরানের এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন শক্তিশালী বিমান প্রতিরক্ষা। কিন্তু দেশটির শিল্প ক্ষমতা নিজস্বভাবে প্রয়োজনীয় যুদ্ধবিমান বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উৎপাদনে অক্ষম। রাশিয়ার কাছ থেকে সহায়তা পেলেও ইউক্রেন যুদ্ধ ও ইসরায়েলের সঙ্গে মস্কোর জটিল সম্পর্কের কারণে তা সীমিত। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়া ইরানকে ৫০টি সু-৩৫ বিমান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু এখনো মাত্র দুটি সরবরাহ করেছে।

চীনের দিকে ঝোঁক

এই পরিস্থিতিতে চীন হয়ে উঠতে পারে ইরানের প্রধান ভরসা। চীন আগে ভারসাম্য বজায় রাখলেও এখন বেইজিং-ওয়াশিংটন উত্তেজনার কারণে ইরানকে কৌশলগত অংশীদার বানানো তাদের জন্য লাভজনক হতে পারে। চীন চাইলে ইরানকে এইচকিউ-৯ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিতে পারে, যা রাশিয়ার এস-৪০০ এর সমতুল্য। এছাড়া চেংদু জে-১০ যুদ্ধবিমান সরবরাহ করলে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা কিছুটা শক্তিশালী হতে পারে।

স্বল্পমেয়াদে এসব পদক্ষেপ ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক ভারসাম্য বদলাবে না। তবে মধ্যমেয়াদে এগুলো শত্রুদের জন্য হামলা চালানো ব্যয়বহুল করে তুলবে এবং ইরানকে সময় কিনে দেবে নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্র মজুত পুনর্গঠনের জন্য।

তবু ইরানের সামনে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। তারা হয়তো নিরাপত্তাহীন অবস্থায় সময় কাটিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করবে, নয়তো আরও ঝুঁকিপূর্ণ পারমাণবিক অস্ত্রের পথে নামবে। গত দুই দশক ধরে যেই নিরাপত্তার কাঠামোর উপর ইরান নির্ভর করেছিল, তা ভেঙে পড়েছে। প্রচলিত সামরিক দুর্বলতা কাটানো ছাড়া দেশটি মৌলিকভাবে দুর্বলই থেকে যাবে।

চীনের উপর নির্ভরতার দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে ইরান

১১:৪৭:০৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

কৌশলগত বিপর্যয়

গত এক বছরে ধারাবাহিক ক্ষতিতে ইরানের দীর্ঘমেয়াদি কৌশল ভেঙে পড়েছে। গাজায় হামাসের প্রায় ধ্বংস, লেবাননের হিজবুল্লাহ দুর্বল হয়ে পড়া এবং সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের পতন—এই তিনটি ঘটনায় ইরান তার দীর্ঘদিনের আঞ্চলিক প্রতিনিধি বাহিনী হারিয়েছে। ফলে ইসরায়েল জুন মাসে ইরানের বিরুদ্ধে ১২ দিনের যুদ্ধ চালাতে পেরেছিল আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়ার ভয় ছাড়াই। সেই যুদ্ধে ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পারমাণবিক কর্মসূচি পিছিয়ে যায়।

বিকল্পহীন তেহরান

ইরান এখন তার হারানো প্রভাব ফেরানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকে ইসরায়েলের আগ্রাসী অবস্থান ইরানের পক্ষে নতুন প্রতিনিধি বাহিনী গড়ে তোলা বা হিজবুল্লাহকে পুনরায় অস্ত্র দেওয়াকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে। নিজস্ব ভূখণ্ড রক্ষায় অক্ষম ইরান নতুন প্রক্সি গড়ে তুলতে বা দ্রুত পারমাণবিক বোমা বানাতে গেলে শাসনব্যবস্থা ধ্বংসের ঝুঁকি বাড়বে।

নিকট ভবিষ্যতে ইরানের সবচেয়ে বাস্তবসম্মত পথ হতে পারে চীনের সাথে সামরিক সহযোগিতা বাড়ানো। আগে চীন মধ্যপ্রাচ্যে পক্ষপাত এড়িয়ে চলত, কিন্তু ইসরায়েল-আরব উত্তেজনার নতুন প্রেক্ষাপটে বেইজিং হয়তো ইরানকে সহায়তা করতে আগ্রহী হতে পারে।

সিরিয়ার নতুন বাধা

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সিরিয়ার আসাদ সরকার উৎখাত হওয়ার পর নতুন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা স্পষ্ট করেছেন, তার দেশে ইরানি প্রভাব আর গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি তুরস্কসহ ইরানের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছেন এবং ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের দায়ী করেছেন অস্থিরতার জন্য। তবে নতুন সরকার দেশকে একীভূত করতে হিমশিম খাচ্ছে। এই ফাঁক ব্যবহার করে ইরান ভেতরে অখুশি গোষ্ঠীগুলোকে অর্থায়নের মাধ্যমে পাশে টানতে পারে।

যদি যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহার করে নেয়, ইরান আরও সুযোগ পেতে পারে। তবে সিরিয়ার ট্রানজিট রুট না থাকলে লেবাননে অস্ত্র পাঠানোর উপায় সীমিত থাকবে—আকাশ বা সমুদ্রপথে, যা সহজেই ইসরায়েল আটকাতে পারে। ইতিমধ্যেই হিজবুল্লাহর নেতৃত্ব ভেঙে পড়েছে এবং সংগঠনটি অস্ত্র পরিত্যাগের চাপের মুখে।

প্রক্সি কৌশলের সীমাবদ্ধতা

হিজবুল্লাহর ক্ষয়ক্ষতির ফলে ইরান কার্যত তার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধক হাতিয়ার হারিয়েছে। ইয়েমেনের হুথিরা রেড সিতে জাহাজে হামলা চালালেও তারা ইরানকে ইসরায়েলের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে পারেনি। ইরাকের শিয়া মিলিশিয়াদের সামর্থ্যও সীমিত।

ইরান চাইলে সরাসরি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে ঝুঁকতে পারে। ইতোমধ্যে তাদের কাছে কয়েকটি অস্ত্র বানানোর মতো উচ্চমাত্রার ইউরেনিয়াম রয়েছে। তবে এ পথে অগ্রসর হওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা নজরদারির কারণে যেকোনো গোপন কার্যক্রম নতুন ও বিধ্বংসী হামলার কারণ হতে পারে। আর আকাশ প্রতিরক্ষা দুর্বল থাকায় তৈরি হলেও এসব অস্ত্র নিরাপদ থাকবে না।

প্রচলিত প্রতিরক্ষার ঘাটতি

১২ দিনের যুদ্ধে ইরান ইসরায়েলি শহরগুলোতে আঘাত হানতে পারলেও কার্যকর সামরিক লক্ষ্যে আঘাত করতে ব্যর্থ হয়। ইসরায়েলের শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কার্যত নিষ্ক্রিয় করে দেয়। পরবর্তীতে ইসরায়েল ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপকেও ধ্বংস করে।

ইরানের এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন শক্তিশালী বিমান প্রতিরক্ষা। কিন্তু দেশটির শিল্প ক্ষমতা নিজস্বভাবে প্রয়োজনীয় যুদ্ধবিমান বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উৎপাদনে অক্ষম। রাশিয়ার কাছ থেকে সহায়তা পেলেও ইউক্রেন যুদ্ধ ও ইসরায়েলের সঙ্গে মস্কোর জটিল সম্পর্কের কারণে তা সীমিত। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়া ইরানকে ৫০টি সু-৩৫ বিমান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু এখনো মাত্র দুটি সরবরাহ করেছে।

চীনের দিকে ঝোঁক

এই পরিস্থিতিতে চীন হয়ে উঠতে পারে ইরানের প্রধান ভরসা। চীন আগে ভারসাম্য বজায় রাখলেও এখন বেইজিং-ওয়াশিংটন উত্তেজনার কারণে ইরানকে কৌশলগত অংশীদার বানানো তাদের জন্য লাভজনক হতে পারে। চীন চাইলে ইরানকে এইচকিউ-৯ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিতে পারে, যা রাশিয়ার এস-৪০০ এর সমতুল্য। এছাড়া চেংদু জে-১০ যুদ্ধবিমান সরবরাহ করলে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা কিছুটা শক্তিশালী হতে পারে।

স্বল্পমেয়াদে এসব পদক্ষেপ ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক ভারসাম্য বদলাবে না। তবে মধ্যমেয়াদে এগুলো শত্রুদের জন্য হামলা চালানো ব্যয়বহুল করে তুলবে এবং ইরানকে সময় কিনে দেবে নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্র মজুত পুনর্গঠনের জন্য।

তবু ইরানের সামনে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। তারা হয়তো নিরাপত্তাহীন অবস্থায় সময় কাটিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করবে, নয়তো আরও ঝুঁকিপূর্ণ পারমাণবিক অস্ত্রের পথে নামবে। গত দুই দশক ধরে যেই নিরাপত্তার কাঠামোর উপর ইরান নির্ভর করেছিল, তা ভেঙে পড়েছে। প্রচলিত সামরিক দুর্বলতা কাটানো ছাড়া দেশটি মৌলিকভাবে দুর্বলই থেকে যাবে।