বিরল পাখি আর এক প্রভাবশালী পরিবার
ব্রাজিলের উজ্জ্বল নীল রঙের স্পিক্স ম্যাকাও টিয়া ২০১৯ সালে প্রাকৃতিক পরিবেশে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। পরে সংরক্ষিত প্রজনন কর্মসূচির মাধ্যমে আবারও কিছু পাখি ব্রাজিলে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে এই প্রজাতির ২৬টি টিয়া হঠাৎ ভারতে আম্বানি পরিবারের পরিচালিত বেসরকারি সংরক্ষণাগারে চলে আসায় তিন মহাদেশের কর্মকর্তারা দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রশ্ন তুলছেন।
তদন্ত ও আন্তর্জাতিক নজরদারি
সম্প্রতি ভারতের তদন্তকারীরা আম্বানিদের ভান্তারা নামের প্রাণী উদ্ধার ও পুনর্বাসন কেন্দ্রকে কোনো বেআইনি কাজের অভিযোগ থেকে মুক্ত করেছে, কিন্তু ইউরোপীয় কর্মকর্তারা বলছেন, ভারতের এই কেন্দ্রে যে কোনো বন্যপ্রাণী রপ্তানির ক্ষেত্রে তারা বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করবেন। একই সঙ্গে ব্রাজিল, জার্মানি ও ভারত জাতিসংঘ-পরিচালিত বন্যপ্রাণী বাণিজ্য পর্যবেক্ষণ সংস্থার অধীনে সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছে।
ভান্তারার পরিধি ও বিশাল সংগ্রহ
গুজরাটে ৩,৫০০ একর জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠা ভান্তারা কেন্দ্রে প্রায় ২,০০০ প্রজাতির প্রাণী রয়েছে। কেন্দ্রটি আলোচনায় আসে ২০২৩ সালে আনন্দ আম্বানির প্রাক-বিবাহ অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে, যেখানে মার্ক জাকারবার্গ ও ইভাঙ্কা ট্রাম্পের মতো অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন।
২০২২ সাল থেকে কেন্দ্রটি দক্ষিণ আফ্রিকা, ভেনেজুয়েলা, কঙ্গো ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ নানা দেশ থেকে বিপুলসংখ্যক প্রাণী আমদানি করেছে। রেকর্ড অনুযায়ী, এখানে এসেছে প্রায় ২,৮৯৬ সাপ, ১,৪৩১ কচ্ছপ, ২১৯ বাঘ, ১৪৯ চিতা, ১০৫ জিরাফ, ৬২ শিম্পাঞ্জি, ২০ গণ্ডারসহ অসংখ্য সরীসৃপ। এসব চালানের মূল্য ধরা হয়েছে ৯ মিলিয়ন ডলার, তবে ভান্তারার দাবি—এটা কেবল পরিবহন ও বিমা খরচ, কোনো প্রাণীর বাণিজ্যিক লেনদেন হয়নি।
বিরল টিয়া নিয়ে মূল বিতর্ক
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে স্পিক্স ম্যাকাও টিয়াদের নিয়েই। কাস্টমস নথি অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে জার্মানির বার্লিন থেকে ভারতের আহমেদাবাদে ২৬টি টিয়া আনা হয়। প্রতিটি টিয়ার খরচ, পরিবহন ও বিমা বাবদ ধরা হয় ৯৬৯ ডলার; তবে ব্রাজিল জানায়, তারা এই স্থানান্তরের অনুমোদন দেয়নি।
ব্রাজিলের জৈববৈচিত্র্য সংরক্ষণ সংস্থা স্পষ্ট জানায়, ভান্তারা এখনো আন্তর্জাতিক প্রজনন কর্মসূচিতে অংশ নেয়নি, তাই ভারতে এ টিয়া পাঠানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই।
জার্মানি, ব্রাজিল ও ভারতের অবস্থান
জার্মানি প্রথমে সৎ বিশ্বাসে টিয়া স্থানান্তর অনুমোদন করলেও পরে ব্রাজিলের সঙ্গে আলোচনার পর নতুন করে অনুমতি দেয়নি। এ নিয়ে বর্তমানে আইনি প্রক্রিয়া চলছে।
ব্রাজিল আগেই জার্মান ভিত্তিক সংস্থা ACTPর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, অভিযোগ তোলে যে তারা বাণিজ্যিকভাবে টিয়া অন্য দেশে পাঠিয়েছে। যদিও ACTP ও ভান্তারা উভয়েই এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
আদালত ও সরকারের অবস্থান
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার পর সম্প্রতি জানায়, ভান্তারার বিরুদ্ধে কোনো আইনি লঙ্ঘন পাওয়া যায়নি। কেন্দ্রটির রপ্তানি-আমদানি অনুমতিও সঠিক ছিল। এমনকি ভান্তারা এখন ব্রাজিলের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় আছে টিয়াদের প্রাকৃতিক পরিবেশে ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে, যদিও তা প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
ভান্তারার বিলাসবহুল পরিবেশ
২০২০ সালে অনুর্বর জমি থেকে শুরু করে বর্তমানে ভান্তারা এক বিস্তৃত সবুজ ও আধুনিক প্রাণী অভয়ারণ্যে রূপ নিয়েছে। এখানে হাতিদের জন্য পপকর্ন ও বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা পর্যন্ত রয়েছে। এ বছরের মার্চে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভান্তারা উদ্বোধন করেন এবং সিংহশাবক, গণ্ডার, হাতি ও জিরাফকে খাওয়ানোর ভিডিও প্রচার করা হয়। ছবিতে দেখা যায়, এক স্পিক্স ম্যাকাও টিয়া মোদির হাতে বসে ছিল।
আন্তর্জাতিক নজরদারি অব্যাহত
ভারত সরকার ভান্তারাকে সংরক্ষণমূলক কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও ইউরোপীয় কমিশন বলেছে, ভারতের উদ্দেশ্যে ভবিষ্যতে যেকোনো প্রাণী রপ্তানি অনুরোধ তারা বাড়তি সতর্কতার সঙ্গে যাচাই করবে। এদিকে নভেম্বরে সাইটিস বৈঠকের আগে ব্রাজিল, জার্মানি ও ভারতের মধ্যে সমাধান খোঁজার চেষ্টা চলছে।
ভান্তারাকে এখনো আইনি দিক থেকে দোষী প্রমাণ করা না গেলেও বিরল টিয়া নিয়ে বিতর্ক আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভারতকে চাপের মধ্যে রেখেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ব্রাজিলের আপত্তি দূর না হলে বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদে ভারত ও আম্বানি পরিবারের জন্য জটিল হয়ে উঠতে পারে।