বাংলাদেশের ভৌগোলিক পরিচয় সাধারণত সমতল ভূমির উপর দাঁড়িয়ে। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার উর্বর অববাহিকা, মাঠঘেরা গ্রাম আর নদীমাতৃক সৌন্দর্যের জন্যই বাংলাদেশ বিশ্বজুড়ে পরিচিত। কিন্তু দেশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে, বিশেষ করে চট্টগ্রাম পার্বত্য জেলাগুলোতে রয়েছে এক ভিন্ন বাংলাদেশ। এখানে পাহাড়, অরণ্য, ঝরনা ও নদী মিলেমিশে তৈরি করেছে এক অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এই পাহাড়ি অঞ্চলের গর্ব হলো তাজিংডং—যা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পাহাড় হিসেবে স্বীকৃত। স্থানীয় ম্রো ভাষায় তাজিংডং মানে “বড় পাহাড়” বা “মহান পর্বত”। অনেকেই একে বিজয় শিখর নামেও চেনে।
অবস্থান ও ভৌগোলিক পরিচয়
তাজিংডং পাহাড় অবস্থিত বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলায়। পাহাড়টি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে, মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী দুর্গম অঞ্চলে অবস্থান করছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় এক হাজার দুইশো আশি মিটার বা চার হাজার দুইশো ফুট। এই উচ্চতা বাংলাদেশের অন্য সব শৃঙ্গের তুলনায় বেশি। চারদিকে ঘন জঙ্গল ও দুর্গম পথের কারণে পাহাড়টি অনেকটাই অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে।
এটি মূলত আরাকান পর্বতশ্রেণির একটি অংশ। আরাকান পাহাড় মিয়ানমার থেকে শুরু হয়ে বাংলাদেশের বান্দরবান পর্যন্ত বিস্তৃত। এই পর্বতমালা ভূতাত্ত্বিকভাবে খুবই প্রাচীন এবং এখনো ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত। ফলে এখানকার পাহাড়গুলো প্রকৃতিগতভাবে আলাদা বৈশিষ্ট্য ধারণ করেছে।
নামকরণের ইতিহাস
তাজিংডং নামটি এসেছে ম্রো জনগোষ্ঠীর ভাষা থেকে। “তাজিং” শব্দের অর্থ “বড়” আর “ডং” মানে “পাহাড়”। অর্থাৎ “তাজিংডং” মানে “বড় পাহাড়”। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কাছে এই পাহাড় ছিল বহু আগে থেকেই পূজার স্থান। তাদের বিশ্বাস ছিল পাহাড়ের চূড়ায় আত্মিক শক্তির বসবাস রয়েছে। এ জন্য পাহাড়টি কেবল ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকেই নয়, সাংস্কৃতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ সরকার দুই হাজার সালের দিকে পাহাড়টির সরকারি নামকরণ করে বিজয় শিখর। যদিও সাধারণ মানুষের কাছে এখনো এটি তাজিংডং নামেই বেশি পরিচিত।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরিবেশ
তাজিংডং পাহাড় চারদিকে ঘন অরণ্যে আবৃত। বনভূমিতে রয়েছে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় চিরসবুজ বৃক্ষরাজি, বাঁশঝাড়, পাহাড়ি শাকসবজি এবং বুনো অর্কিড। বর্ষাকালে পাহাড়ের গা বেয়ে ছোট ছোট ঝরনা তৈরি হয়, যা স্থানীয়দের ভাষায় “ঝিরি” নামে পরিচিত। এই ঝিরি ধরে হাঁটতে হাঁটতে উপরের দিকে উঠতে হয়।
শীতকালে পাহাড়ের চূড়া থেকে দেখা যায় চারপাশের অসংখ্য পাহাড়ি সারি আর মেঘে ঢাকা আকাশ। অনেক সময় মনে হয় যেন মেঘের সমুদ্রে দাঁড়িয়ে আছি। বর্ষায় পাহাড় আরও বর্ণিল রূপ ধারণ করে। তখন পাহাড়ের ঢালু বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলধারা পর্যটকদের কাছে এক অনন্য অভিজ্ঞতা এনে দেয়।
জীববৈচিত্র্য
তাজিংডং পাহাড় বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের এক বিশাল ভাণ্ডার। এখানে পাওয়া যায়—
স্তন্যপায়ী প্রাণী: বন্য হাতি, পাহাড়ি হরিণ, চিতা, গিবন বানর, বানর, শেয়াল ইত্যাদি।
পাখি: পাহাড়ি টিয়া, ময়ূর, হিল মাইনা, হর্নবিলসহ নানা প্রজাতির পাখি।
সরীসৃপ ও উভচর: বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, গেকো টিকটিকি, ব্যাঙ।
গাছপালা: শাল, গর্জন, বিভিন্ন বাঁশজাতীয় উদ্ভিদ এবং বুনো অর্কিড।
এই পাহাড়ের বনভূমি শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উৎস নয়, বরং দেশের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও সংস্কৃতি
তাজিংডংয়ের চারপাশে বসবাস করে ম্রো, খিয়াং, বম, লুসাইসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। তাদের জীবনের সঙ্গে এই পাহাড় গভীরভাবে জড়িত।
জীবিকা: তারা মূলত জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। ধান, আদা, হলুদ, মরিচ, কচু, বিভিন্ন শাকসবজি এবং ফল তাদের প্রধান উৎপাদন।
সংস্কৃতি: তাদের গান, নৃত্য, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস এবং লোককথায় তাজিংডং বিশেষভাবে উল্লেখ রয়েছে।
ধর্মীয় বিশ্বাস: পাহাড়কে তারা পবিত্র মনে করে। অনেক সময় চূড়ায় গিয়ে তারা দেবতার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করে।
স্থানীয় সংস্কৃতি পর্যটকদের কাছে এক ভিন্ন রূপ উপস্থাপন করে, যা বাংলাদেশের মূলধারার সংস্কৃতি থেকে আলাদা হলেও দেশের বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্যের অংশ।
পর্যটন সম্ভাবনা ও ভ্রমণ অভিজ্ঞতা
তাজিংডং অভিযাত্রী ও প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এক অসাধারণ গন্তব্য। তবে এখানে ভ্রমণ সহজ নয়।
যাত্রাপথ:
বান্দরবান শহর থেকে প্রথমে থানচি পর্যন্ত যেতে হয়।
এরপর স্থানীয় গাইড নিয়ে পায়ে হেঁটে পাহাড়ের দিকে যাত্রা শুরু করতে হয়।
খাড়া পাহাড়ি পথ, ঘন জঙ্গল ও ঝিরি নদী পার হতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে।
চূড়ায় পৌঁছানোর অভিজ্ঞতা:
চূড়ায় উঠতে প্রচুর শারীরিক পরিশ্রমের প্রয়োজন হলেও উপরে পৌঁছে সেই ক্লান্তি মুহূর্তেই কেটে যায়। চারদিকে পাহাড়ি সারি, মেঘের খেলা আর সবুজের বিস্তার ভ্রমণকারীদের মুগ্ধ করে।
পর্যটন সুবিধা:
এলাকাটি এখনো মূলত দুর্গম। ফলে পর্যটন অবকাঠামো সীমিত। তবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সহায়তায় তাঁবু খাটিয়ে বা পাহাড়ি গ্রামে অবস্থান করে অভিযাত্রীরা রাতযাপন করতে পারে।
বিতর্ক ও গবেষণা
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পাহাড় কোনটি—তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক রয়েছে।
তাজিংডং: সরকারি জরিপে একে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পাহাড় বলা হয়।
কেওকারাডং: দীর্ঘদিন কেওকারাডংকেও সর্বোচ্চ পাহাড় হিসেবে ধরা হতো।
সাকা হাফং (মদাক শিখর): সাকা হাফং তাজিংডংয়ের তুলনায় আরও উঁচু বলে অনেক গবেষক দাবি করেন।
দুই হাজার এগারো সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর করা জরিপে তাজিংডংকেই সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ঘোষণা করা হয়। তবে গবেষক ও ভ্রমণকারীদের মধ্যে এ নিয়ে এখনো বিতর্ক চলমান।
তাজিংডংয়ের গুরুত্ব
তাজিংডং পাহাড় শুধু একটি প্রাকৃতিক নিদর্শন নয়, বরং জাতীয় পরিচয়ের অংশ।
ভূ-প্রকৃতি: দেশের ভৌগোলিক বৈচিত্র্যকে তুলে ধরে।
জীববৈচিত্র্য: অগণিত প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল।
সংস্কৃতি: ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ইতিহাস, বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের প্রতীক।
পর্যটন: বাংলাদেশের ইকো-ট্যুরিজম ও অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমে এক অনন্য সংযোজন।
গবেষণা: ভূতত্ত্ব, পরিবেশবিদ্যা ও নৃতত্ত্ব গবেষণার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র।
সংরক্ষণ ও চ্যালেঞ্জ
তাজিংডং ও এর আশপাশের বনভূমি আজ নানা চ্যালেঞ্জের মুখে।
অতিরিক্ত বন নিধন: জুম চাষ ও কাঠ কাটার কারণে বনভূমি হুমকির মুখে।
অবকাঠামো সংকট: পর্যটন অবকাঠামো দুর্বল হওয়ায় সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়: ভূমিধস, বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তন পাহাড়ি এলাকাকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
তাজিংডং সংরক্ষণ করতে হলে সরকার, স্থানীয় জনগণ ও পরিবেশবাদীদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
তাজিংডং শুধু বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পাহাড় নয়, বরং এক প্রকৃতির বিস্ময়, এক সংস্কৃতির প্রতীক এবং এক অভিযাত্রীর স্বপ্ন। এর উচ্চতা, ইতিহাস, জীববৈচিত্র্য ও মানবজীবনের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক এটিকে করেছে বিশেষ। পাহাড়টি আমাদের প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের অংশ, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব।
তাজিংডং পাহাড়ে দাঁড়ালে মনে হয় বাংলাদেশ শুধু নদীর দেশ নয়, বরং পাহাড়-অরণ্য, মেঘ-আকাশ মিলিয়ে গড়া এক বৈচিত্র্যময় ভূখণ্ড। এ পাহাড় আমাদের ভৌগোলিক গর্ব, জাতীয় সম্পদ এবং প্রকৃতির অমূল্য দান।