০৭:২১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

কাঠের বালতির কল্পনায় নতুন স্থাপত্য

কানাজাওয়ায় ভিন্নধর্মী চা-ঘর

ইশিকাওয়া প্রিফেকচারের কানাজাওয়ার একটি শান্ত এলাকায় চলছে এক অভিনব চা-অনুষ্ঠান। চারপাশে ছড়িয়ে আছে সিডার কাঠ, তাতামি, খড় আর ম্যাচার গন্ধ। কিন্তু এটি সাধারণ কোনো ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান নয়। চা পরিবেশন করা হচ্ছে মোটর অয়েল-এর টিন থেকে, আর চা-ঘরটি তৈরি করা হয়েছে যেন এক বিশাল কাঠের বালতি।


শুজি নাকাগাওয়ার স্বপ্ন

৫৭ বছর বয়সী শুজি নাকাগাওয়া বলেন, তিনি সবসময় ভেবেছেন বালতির ভেতরে ঢুকলে কেমন লাগবে। যেহেতু মানুষকে ছোট করা সম্ভব নয়, তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন বড় আকারের বালতি বানাবেন। এভাবেই জন্ম নেয় তাঁর অনন্য চা-ঘর। নাকাগাওয়া হলেন কিয়োটো শহরের এক তৃতীয় প্রজন্মের কাঠশিল্পী, যিনি ছোটবেলা থেকেই বাবার কর্মশালায় বড় হয়েছেন।

প্রাচীন কৌশলে আধুনিক স্থাপত্য

নাকাগাওয়ার তৈরি চা-ঘর তিন মিটার চওড়া এবং দুই মিটার উঁচু। এটি তৈরি হয়েছে জাপানের ঐতিহ্যবাহী কাঠের বালতি (কিওকে) বানানোর একই কৌশলে। যেখানে একটি সাধারণ বালতিতে প্রায় ১৫টি কাঠের টুকরো লাগে, সেখানে এই চা-ঘরে লেগেছে প্রায় ৮০টি। কাঠের টুকরোগুলো ধাতব ফিতায় বাঁধা থাকে। ফিতা শক্ত হলে কাঠ টিকে থাকে, ঢিলে হলে পুরো কাঠামো ভেঙে পড়ে।


পারিবারিক ঐতিহ্যের চাপ

শৈশব থেকেই নাকাগাওয়া অনুভব করতেন যে তাঁকে বাবার ও দাদার পথেই হাঁটতে হবে। তাঁর ভাই অবশ্য ইন্টিরিয়র ডিজাইনে চলে যান। নাকাগাওয়া প্রথমে সমসাময়িক শিল্পকলা পড়েন, স্টিলের ভাস্কর্য বানান, তবে জীবিকার জন্য শেষমেশ কাঠশিল্পেই ফিরে আসেন। ২০০৩ সালে তিনি শিগা প্রিফেকচারে নিজের কর্মশালা খোলেন।

পরিবারের শিল্পকর্মের ইতিহাস

নাকাগাওয়ার দাদা ঐতিহ্যবাহী কাঠশিল্প করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে প্লাস্টিক আর শিল্পজাত পণ্যে বাজার দখল হয়ে যায়। তাঁর বাবা কিয়োৎসুগু নাকাগাওয়া নতুন নকশা তৈরি করেন এবং ২০০১ সালে জাপানের জাতীয় জীবন্ত সম্পদ হিসেবে স্বীকৃতি পান।


নতুন প্রজন্মের জন্য লক্ষ্য

নাকাগাওয়া বলেন, এই শিল্প প্রায় ৭০০ বছরের পুরনো হলেও তাঁর প্রজন্মে এসে বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকিতে ছিল। তাই তাঁর লক্ষ্য শুধু সংরক্ষণ নয়, নতুন নকশা ও কল্পনার মাধ্যমে এটিকে নতুন জীবন দেওয়া। স্থাপত্যে কাঠের বালতির কৌশল ব্যবহার করে তিনি প্রমাণ করেছেন, এই প্রাচীন কৌশল এখনো সমসাময়িক শিল্পে জায়গা করে নিতে পারে।


কর্মশালার ভেতর জীবন

শিগার কর্মশালায় সাতজন কর্মী নিয়ে কাজ করেন নাকাগাওয়া। বেশিরভাগ কাজই হাতে করা হয়, কেবল কখনো চেইন করাত বা ব্যান্ড করাত ব্যবহার করা হয়। তিনি কখনো কম্পিউটার ডিজাইনের ওপর ভিত্তি করে কাঠ কাটেন, আবার কখনো কাঠের নিজস্ব গঠনই তাঁকে নকশা বলে দেয়। তাঁর কর্মশালায় রয়েছে ৩০০টি হাতের প্ল্যান এবং অগণিত কাঠের টুকরো।

বৈশ্বিক স্বীকৃতি

২০১৭ সালে লোয়েভ কারুশিল্প পুরস্কারের চূড়ান্ত তালিকায় জায়গা পান নাকাগাওয়া। তাঁর কাঠের বালতি স্থানীয় ঐতিহ্য হলেও নিউইয়র্কের গ্যালারিগুলোতেও তা প্রশংসা কুড়িয়েছে। পশ্চিমা শিল্পজগতে আগে যেখানে কারুশিল্পকে সবচেয়ে নিচে ধরা হতো, এখন তার অবস্থান বদলেছে।


শিল্প বনাম কারুশিল্প

নাকাগাওয়ার মতে, শিল্পকর্ম হলো ব্যক্তিগত প্রকাশ, যেখানে দর্শক তা পছন্দ করবেন বা করবেন না। কিন্তু কারুশিল্প তৈরি হয় নির্মাতা ও ব্যবহারকারীর সম্পর্কের ওপর। কাঠশিল্পে কেবল বস্তু নয়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলমান কৌশলই আসল মূল্য।


ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি

নাকাগাওয়ার তিন সন্তানের কেউ হয়তো পারিবারিক এই শিল্পে আসবে না। তবু তিনি চান তরুণ প্রজন্মের কাছে কৌশলটি পৌঁছে দিতে, বিশেষ করে স্থাপত্যে এর ব্যবহার বাড়িয়ে। তাঁর আশা, এভাবে কাঠের এই প্রাচীন শিল্প আরও অন্তত ১০০ থেকে ২০০ বছর টিকে থাকবে।

কাঠের বালতির কল্পনায় নতুন স্থাপত্য

০২:০০:৫২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

কানাজাওয়ায় ভিন্নধর্মী চা-ঘর

ইশিকাওয়া প্রিফেকচারের কানাজাওয়ার একটি শান্ত এলাকায় চলছে এক অভিনব চা-অনুষ্ঠান। চারপাশে ছড়িয়ে আছে সিডার কাঠ, তাতামি, খড় আর ম্যাচার গন্ধ। কিন্তু এটি সাধারণ কোনো ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান নয়। চা পরিবেশন করা হচ্ছে মোটর অয়েল-এর টিন থেকে, আর চা-ঘরটি তৈরি করা হয়েছে যেন এক বিশাল কাঠের বালতি।


শুজি নাকাগাওয়ার স্বপ্ন

৫৭ বছর বয়সী শুজি নাকাগাওয়া বলেন, তিনি সবসময় ভেবেছেন বালতির ভেতরে ঢুকলে কেমন লাগবে। যেহেতু মানুষকে ছোট করা সম্ভব নয়, তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন বড় আকারের বালতি বানাবেন। এভাবেই জন্ম নেয় তাঁর অনন্য চা-ঘর। নাকাগাওয়া হলেন কিয়োটো শহরের এক তৃতীয় প্রজন্মের কাঠশিল্পী, যিনি ছোটবেলা থেকেই বাবার কর্মশালায় বড় হয়েছেন।

প্রাচীন কৌশলে আধুনিক স্থাপত্য

নাকাগাওয়ার তৈরি চা-ঘর তিন মিটার চওড়া এবং দুই মিটার উঁচু। এটি তৈরি হয়েছে জাপানের ঐতিহ্যবাহী কাঠের বালতি (কিওকে) বানানোর একই কৌশলে। যেখানে একটি সাধারণ বালতিতে প্রায় ১৫টি কাঠের টুকরো লাগে, সেখানে এই চা-ঘরে লেগেছে প্রায় ৮০টি। কাঠের টুকরোগুলো ধাতব ফিতায় বাঁধা থাকে। ফিতা শক্ত হলে কাঠ টিকে থাকে, ঢিলে হলে পুরো কাঠামো ভেঙে পড়ে।


পারিবারিক ঐতিহ্যের চাপ

শৈশব থেকেই নাকাগাওয়া অনুভব করতেন যে তাঁকে বাবার ও দাদার পথেই হাঁটতে হবে। তাঁর ভাই অবশ্য ইন্টিরিয়র ডিজাইনে চলে যান। নাকাগাওয়া প্রথমে সমসাময়িক শিল্পকলা পড়েন, স্টিলের ভাস্কর্য বানান, তবে জীবিকার জন্য শেষমেশ কাঠশিল্পেই ফিরে আসেন। ২০০৩ সালে তিনি শিগা প্রিফেকচারে নিজের কর্মশালা খোলেন।

পরিবারের শিল্পকর্মের ইতিহাস

নাকাগাওয়ার দাদা ঐতিহ্যবাহী কাঠশিল্প করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে প্লাস্টিক আর শিল্পজাত পণ্যে বাজার দখল হয়ে যায়। তাঁর বাবা কিয়োৎসুগু নাকাগাওয়া নতুন নকশা তৈরি করেন এবং ২০০১ সালে জাপানের জাতীয় জীবন্ত সম্পদ হিসেবে স্বীকৃতি পান।


নতুন প্রজন্মের জন্য লক্ষ্য

নাকাগাওয়া বলেন, এই শিল্প প্রায় ৭০০ বছরের পুরনো হলেও তাঁর প্রজন্মে এসে বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকিতে ছিল। তাই তাঁর লক্ষ্য শুধু সংরক্ষণ নয়, নতুন নকশা ও কল্পনার মাধ্যমে এটিকে নতুন জীবন দেওয়া। স্থাপত্যে কাঠের বালতির কৌশল ব্যবহার করে তিনি প্রমাণ করেছেন, এই প্রাচীন কৌশল এখনো সমসাময়িক শিল্পে জায়গা করে নিতে পারে।


কর্মশালার ভেতর জীবন

শিগার কর্মশালায় সাতজন কর্মী নিয়ে কাজ করেন নাকাগাওয়া। বেশিরভাগ কাজই হাতে করা হয়, কেবল কখনো চেইন করাত বা ব্যান্ড করাত ব্যবহার করা হয়। তিনি কখনো কম্পিউটার ডিজাইনের ওপর ভিত্তি করে কাঠ কাটেন, আবার কখনো কাঠের নিজস্ব গঠনই তাঁকে নকশা বলে দেয়। তাঁর কর্মশালায় রয়েছে ৩০০টি হাতের প্ল্যান এবং অগণিত কাঠের টুকরো।

বৈশ্বিক স্বীকৃতি

২০১৭ সালে লোয়েভ কারুশিল্প পুরস্কারের চূড়ান্ত তালিকায় জায়গা পান নাকাগাওয়া। তাঁর কাঠের বালতি স্থানীয় ঐতিহ্য হলেও নিউইয়র্কের গ্যালারিগুলোতেও তা প্রশংসা কুড়িয়েছে। পশ্চিমা শিল্পজগতে আগে যেখানে কারুশিল্পকে সবচেয়ে নিচে ধরা হতো, এখন তার অবস্থান বদলেছে।


শিল্প বনাম কারুশিল্প

নাকাগাওয়ার মতে, শিল্পকর্ম হলো ব্যক্তিগত প্রকাশ, যেখানে দর্শক তা পছন্দ করবেন বা করবেন না। কিন্তু কারুশিল্প তৈরি হয় নির্মাতা ও ব্যবহারকারীর সম্পর্কের ওপর। কাঠশিল্পে কেবল বস্তু নয়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলমান কৌশলই আসল মূল্য।


ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি

নাকাগাওয়ার তিন সন্তানের কেউ হয়তো পারিবারিক এই শিল্পে আসবে না। তবু তিনি চান তরুণ প্রজন্মের কাছে কৌশলটি পৌঁছে দিতে, বিশেষ করে স্থাপত্যে এর ব্যবহার বাড়িয়ে। তাঁর আশা, এভাবে কাঠের এই প্রাচীন শিল্প আরও অন্তত ১০০ থেকে ২০০ বছর টিকে থাকবে।