দ্বন্দ্বময় শৈশব স্মৃতি
আমেরিকায় বেড়ে ওঠা জেনি চ্যান স্কুলে শিখেছেন এক ধরনের ইতিহাস, আর তার দাদীর মুখে শুনেছেন আরেক ভিন্ন কাহিনি। পাঠ্যপুস্তকে হংকং দখলকালে জাপানিদের নৃশংসতার উল্লেখ ছিল না। অথচ তার দাদী বলতেন দারিদ্র্য, যৌন দাসত্বের হুমকি ও বেঁচে থাকার লড়াইয়ের গল্প। শুরুতে চ্যান ভেবেছিলেন এগুলো হয়তো অতিরঞ্জিত। কিন্তু পরে তিনি বুঝলেন, এগুলোই এশিয়ার এক বিশাল ও উপেক্ষিত ইতিহাস, যেখানে তিন কোটি পঞ্চাশ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল, অথচ পশ্চিমা দৃষ্টিকোণে তা প্রায় অদৃশ্য।
সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও গবেষণা
অতঃপর ২০১৪ সালে চ্যান ‘প্যাসিফিক অ্যাট্রসিটিজ এডুকেশন’ (PAE) নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এর লক্ষ্য হলো এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অজানা ইতিহাস উদ্ধার করা। চ্যান ও তার দল যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল আর্কাইভ থেকে এক মিলিয়নেরও বেশি যুদ্ধাপরাধের নাজুক দলিল ডিজিটাল আকারে সংরক্ষণ করেছেন। এসব নথি দীর্ঘদিন মার্কিন হাতে থাকলেও এশীয় ভুক্তভোগীদের কণ্ঠস্বর চাপা ছিল।
ভয়াবহতার দলিল ও সাক্ষ্য
চ্যান ও তার সহকর্মীরা বেঁচে থাকা মানুষের সাক্ষ্য এবং নথিপত্র একত্র করেছেন। এগুলোতে উঠে এসেছে জাপানি সেনাদের যৌন দাসত্ব ব্যবস্থা, কুখ্যাত ইউনিট ৭৩১-এর জীবাণু ও রাসায়নিক যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা, নানজিং গণহত্যা এবং জোরপূর্বক দাসত্বের মতো বিষয়।
চ্যানের ভাষায়, “আমরা সময়ের সঙ্গে লড়ছি। নথিগুলো এত ভঙ্গুর যে অনেক সময় খোলার সঙ্গেই ভেঙে পড়ছে।”
অভিযোগ নয়, সত্য প্রকাশ
চ্যান বলেন, “আমরা কাউকে দোষী প্রমাণ করতে চাই না”। নথিগুলো ডিজিটাল আকারে তুলে ধরে আমরা শুধু বিশ্বকে দেখাই কী ঘটেছিল।
PAE শুধু দলিল সংরক্ষণেই থেমে থাকেনি। তারা ইউনিট ৭৩১-এর ডিজিটাল রেকর্ড চীনের একটি জাদুঘরে হস্তান্তর করেছে, যেখানে মানুষের ওপর ভয়াবহ পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রমাণ রয়েছে।
স্মৃতি হারিয়ে যাওয়া প্রজন্ম
চ্যান উল্লেখ করেন, হংকংয়ের তরুণ প্রজন্মের অনেকে জানেই না যে জাপান কখনো হংকং দখল করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রেও একই অবস্থা। তার মতে, এই অজ্ঞতা ভাঙা জরুরি।
“যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা হয়, ৯০ শতাংশ আলোচনার কেন্দ্র থাকে হিটলারকে ঘিরে। আমি চাই এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ইতিহাসও সমানভাবে আলোচিত হোক।”
সম্মেলন ও গবেষণা উপস্থাপন
এ বছরের সম্মেলনটি উৎসর্গ করা হয় ১৯৩১ সালের মুকদেন ঘটনার স্মৃতিতে, যা জাপানের মানচুরিয়া দখলের সূচনা করেছিল। প্রায় ৩০০ জন ইতিহাসবিদ, লেখক, বেঁচে থাকা ব্যক্তি ও শিক্ষার্থী এতে অংশ নেন। এখানে PAE-এর ১০ বছরের গবেষণার ফল তুলে ধরা হয়। আলোচনায় উঠে আসে ফিলিপিনো গেরিলাদের প্রতিরোধ ভূমিকা, জাপানি সেনাদের কার্যক্রম, জাপানি ফ্যাসিবাদ, যুদ্ধ-পরবর্তী মার্কিন নীতি পরিবর্তন এবং প্রচারণার প্রভাব।
বেদনাদায়ক কিন্তু হৃদয়ছোঁয়া মুহূর্ত
চীনে জাপানি দখল থেকে বেঁচে থাকা জেনি বি চ্যান তার শৈশব স্মৃতি বলেন—বোমা হামলা, অনাহার, পরিবারের মৃত্যু এবং পরে আমেরিকায় গিয়ে শিক্ষা ও আন্দোলনে জীবন উৎসর্গের কথা।
এক জাপানি দম্পতি যাদের পিতারা জাপানি সেনাদের অপরাধে জড়িত ছিলেন, মঞ্চে এসে অপরাধবোধ ও অনুশোচনা প্রকাশ করেন। স্ত্রী কাজুকো ওয়াতানাবে কাঁদতে শুরু করলে এক চীনা বৃদ্ধ তাকে এগিয়ে এসে সান্ত্বনা দেন—যা সম্মেলনের সবচেয়ে আবেগঘন মুহূর্ত হয়ে ওঠে।
তরুণদের অংশগ্রহণ
যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন হাইস্কুল শিক্ষার্থীও তাদের ডকুমেন্টারি উপস্থাপন করে, যা ইউনিট ৭৩১ নিয়ে গবেষণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি এবং জাতীয় ইতিহাস প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়েছিল। তারা উল্লেখ করে, স্কুলে শেখা ৯৯ শতাংশ আলোচনাই হিটলারকেন্দ্রিক, অথচ এশিয়ায় যুদ্ধক্ষেত্র ও প্রাণহানির বিশাল অংশ উপেক্ষিত।
ভবিষ্যতের প্রত্যাশা
চ্যান বলেন, “আমরা যদি এই আয়োজনের মাধ্যমে অন্তত কিছু আলোকপাত করতে পারি এবং ১০ বছরের গবেষণার ফল মানুষের সামনে আনতে পারি, তবে সেটিই বড় সাফল্য।”
তার বিশ্বাস, এশিয়ার এই অজানা কাহিনিগুলো একদিন মূলধারার ইতিহাস আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নেবে।