০৭:১২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
জলবায়ু সংকট কি আরেকটি আর্থিক টাইম বোমা? কক্সবাজারে ‘ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ ২০২৫’ অনুষ্ঠিত দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার প্রাপ্ত মোহনলালের জীবন ও কাজ ভোলা নদী: ভোলা জেলার জীবনরেখা ৭১তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার: দাদাসাহেব ফালকে সম্মান পাচ্ছেন মোহনলাল আফ্রিকার দ্রুত বর্ধনশীল ভোক্তা বাজারে সিঙ্গাপুরের কোম্পানিগুলোর আগ্রহ প্রাবোওয়ের প্রণোদনা কর্মসূচি জনরোষ সামলাবে, তবে স্থায়ী সমাধান নয় জয়শঙ্কর-রুবিও বৈঠক: বাণিজ্য ও ভিসা ইস্যুতে টানাপোড়েনের মাঝেই আলোচনা রেল সংকট, নতুন টাস্কফোর্স এবং আগেভাগেই সমাধানের প্রশ্ন সংযুক্ত আরব আমিরাতে গোল্ডেন ভিসার যোগ্যতা যাচাই করুন দুই মিনিটে

আমি রবিবাসরীয়: শান্তিনিকেতনের আনন্দবাজার

  • তাপস দাস
  • ০৪:২৪:১৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • 42

‘চল চল দেখবে মজা আনন্দবাজারে,
ছেলেমেয়ে বেচে কেনে কাতারে কাতারে’

লেখার শিরোনাম এবং উল্লেখিত লাইনে আনন্দবাজার শব্দের উল্লেখ, স্বাভাবিক ভাবে অনেক পাঠকের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। তাই প্রথমেই আনন্দবাজার নিয়ে কৌতুহলটা দূর করে নেওয়া দরকার। প্রথমেই জানিয়ে রাখি, লাইনগুলির লেখক, কবি নিশিকান্ত। শান্তিনিকেতন ছেড়ে তিনি পন্ডিচেরী নিবাসী হয়েছিলেন, কিন্তু তার গান বহুবছর ধরে রয়েগেছে শান্তিনিকেতনের সংস্কৃতিতে।

শান্তিনিকেতনে ঋতু উৎসব ও নাটক উৎসব বাদ দিলে , দুটি বড় উৎসব পৌষ মেলা এবং আনন্দবাজার। সুতরাং আনন্দবাজার শান্তিনিকেতনের একটি মেলার নাম। তবে এই মেলাটি অন্যান্য সব মেলাগুলো থেকে স্বাতন্ত্র্য। কারণ, অন্য মেলাগুলোর আয়োজন অন্যরা করে কিন্তু আনন্দবাজারের আয়োজনে থাকেন শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীরা। এই বছর দ্বিতীয়বার আমার এই মেলায় আসা, কিন্তু দিনটি যেহেতু রবিবার তাই শিরোনামে একটু রসিকতা করেছি।

আনন্দবাজারের সঠিক সূচনা বা তারিখ এখনো নির্ধারণ করা যায়নি। ‘প্রবাসী’ পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে সীতা দেবীর লেখা বই ‘পুণ্যস্মৃতি’ থেকে জানা যায় ১৩২৪ সালে নববর্ষের দিন ছেলেদের আনন্দবাজার হয়েছিল। ১৩২৫ সালে মেয়েদের আনন্দবাজার বসেছিল নিচু বাংলায়। পরের বছর ১৩২৬ সালের ২রা বৈশাখ বিদ্যালয়ের ছাত্ররা শালবীথিতে আনন্দবাজারে আয়োজন করে। এরপর আনন্দবাজারের দিন নির্ধারণ করা হয় মহালয়ের দিন। এই রীতি আজও প্রচলিত। তবে ঠিক কবে থেকে এই দিন নির্ধারণ করা হয়, তা এখনো জানা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

প্রথমবার রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এই মেলায় গরহাজির ছিলেন। কারণ ওই সময় তিনি জাপানে ছিলেন। এরপর তিনি শান্তিনিকেতনে ছিলেন কিন্তু আনন্দবাজারে আসেননি এমনটি ঘটেনি। সীতাদেবীর লেখা এবং আনন্দবাজারের পুরোনো খাতা থেকে জানা যায়, আনন্দবাজারের আগের নাম ছিল ‘বউ ঠাকুরানীর হাট ‘।

প্রথমদিকে আনন্দবাজার ছিল পাঠভবনের ছাত্রছাত্রীদের, পরবর্তীকালে অন্যান্য ভবনের ছাত্রছাত্রীরা যুক্ত হন। আগে আনন্দবাজার বসত শালবীথি আম্রকুঞ্জে ঘিরে, এখন বসে গৌরপ্রাঙ্গনে।

এতক্ষন ধরে যে আলোচনা করা হল, তাতে আনন্দবাজারের ইতিহাস পাওয়া গেলো বটে, কিন্তু আনন্দবাজার ঠিক কি, সেটা বোঝা গেলো না, অতএব এবার সরাসরি আনন্দবাজার সম্পর্কে আমার এবং অন্যদের অভিজ্ঞাতার মধ্যে দিয়ে বোঝার চেস্টা করবো। তিরাসা বসাক বলে দ্বাদশ শ্রেণীর এক ছাত্রী, আশ্রম সম্মেলনীর সখা সংঘ ও সাহিত্য বিভাগের যৌথ উদ্যোগে বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত ‘আকাশ’ নামক এক বইয়ে একটি কবিতায় লিখছে

“শারদের প্রাতের মঙ্গলধ্বনি
কাশের বনে দোলে কাশবিলাস
ঢাকের তালে জাগে আনন্দবাজার
গৌরপ্রাঙ্গনে ওঠে সুখবিলাস ”

আনন্দবাজারের দিন কেন ছাত্রছাত্রীদের কাছে সুখবিলাস, এই বিষয়টি নবম শ্রেণীর ছাত্রী রাজন্যার লেখনী থেকে বোঝা যাক, রাজন্যা লিখছে “আমরা সারা বছর এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকি, কারণ এই দিনে আমাদের নিজস্ব বাজার, আনন্দবাজার হয়। অন্যান্য সব বাজারের থেকে এই বাজারটি আমাদের কাছে অন্যরকম, কারণ এই বাজারের আমরা নিজেরা দোকান করি। একমাস আগে থেকে দোকান করার তোড়জোড় শুরু করে দিই। মহালয়ার আগের দিন সবাই আমরা নিজের নিজের জায়গায় গ্রিল, বাঁশ ইত্যাদির দোকান করার সামগ্রী রেখে যাই। প্রায় সকাল থেকেই সবাই দোকান বানাতে শুরু করে দেয়। বিভিন্ন দোকানে বিভিন্ন জিনিস সাজানো থাকে। কেউ বিভিন্ন ধরণের খাবার দোকান বানায় , কেউ হাতে তৈরির জিনিস বিক্রি করে। ”

আর এক নবম শ্রেণীর ছাত্রী দেবস্মিতা লিখছে, “এই বাজারে বিশ্বভারতীর যতগুলো ভবন আছে প্রায় সবাই একটি করে দোকান দেয়, এমনকি পাঠভবনের শিশুদের হোস্টেলের বাচ্ছারাও দোকান দেয়। পাঠভবনের ছাত্র-ছাত্রীদের আশ্রম সম্মেলনি আছে। যেখানে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সাহায্য নিয়ে দোকান বসায়। আশ্রম সম্মেলনির দোকানে পাঠভবনের ছাত্রছাত্রীদের নিজের হাতে লেখা গল্প আর আঁকা নিয়ে একটি আকাশ নামে পত্রিকা প্রকাশ করা হয় এবং কাঠের তৈরী জিনিস পত্র বিক্রি করা হয়। ” এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি এই বছর আমি আকাশ পত্রিকা কিনেছি। সেই পত্রিকা থেকেই এই লেখাগুলো তুলে ধরছি। প্রত্যেক বছরের মত এই বছরেও তড়িৎ দা (পাঠভবনের বাংলার শিক্ষক ) স্টলে ছিলেন। তড়িৎ দার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ করিয়ে দেয় আমার বন্ধু দীপ্র মজুমদার যিনি নিজেও পাঠভবনের প্রাক্তনী।

পাঠভবনের দোকান সম্পর্কে আরো একটু তথ্য যোগ করা যায়, অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী আদ্রিজার লেখা থেকে। আদ্রিজা লিখছে “পাঠভবন আশ্রম সম্মেলনী বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক -শিক্ষিকাদের তৈরী জিনিসপত্রের পসরা নিয়ে বসে পাঠভবনের সামনে। ‘শিল্পীকোন’ ও ‘কবিকোন ‘-এর সামনে দর্শকদের ভিড় দেখা যায় তাদের ছবি আঁকতে বা তাদের নাম দিয়ে কোন কবিতা লিখিয়ে নিতে। ” এই বছর আমিও কবিকোন থেকে আমার নামে একটি কবিতা লিখিয়েছি। কয়েকটি লাইন এখানে তুলে ধরছি।

“রাষ্ট্র বিজ্ঞানের শিক্ষক উনি
তাপস ওনার নাম,
সময় পেলেই মনে পড়ে
তার পূর্ববাংলার গান ”

এই বার আমি একটি ছেলেকে দেখলাম ঘুরে ঘুরে ঝালমুড়ি বিক্রি করছে। আর একটি বিষয় আমার বেশ মজার লাগলো। হটাৎ দেখছি একদল কলেজের ছত্রছাত্রী থালা বাসন বাজিয়ে, নাচ করছে, এর কারণ সম্পর্কে আমার বন্ধুপত্নী অনাম্নী যিনি নিজেও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী সে আমায় অবগত করে জানাল যে বিভাগের দোকানের খাবারের জিনিস আগে বিক্রি হয়ে গেছে, এটা তাদের জয় সূচক আনন্দ।

খাবারের প্রসঙ্গ যখন উঠলো তখন সেই প্রসঙ্গে একটু আসা যাক। ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী স্বস্তিকা তার কবিতায় লিখছে

“আনন্দবাজার আনন্দবাজার
মানুষ আসে হাজার হাজার
ঘুগনি, ফুচকাআর মিষ্টি,
পাপ হয়না, দিলে দৃষ্টি ”

দেবস্মিতার লেখা থেকে খাবারের মেনুতে ঘুগনি, পাঁপড়, মালপোয়া, দইবড়া ইত্যাদি কথা জানা যায়। এই বছর আমিও ঘুগনি, দইবড়া এবং পাঁপড়ি চাট খেয়েছি।

এবার সকলের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে ছাত্র-ছাত্রীরা যদি বিক্রেতা হয় তাহলে ক্রেতা কারা। একধরণের ক্রেতা যারা বাইরে থেকে মেলায় ঘুরতে আসে এবং প্রাক্তনীরা। প্রাক্তনীদের কাছে আনন্দবাজার মিলন মেলাও বটে। আমার এক বান্ধবী নিবেদিতা যিনি বিশ্বভারতীর দর্শন বিভাগের প্রাক্তনী , তার কাছ থেকে জানতে পারি “ছাত্র ছাত্রীরা পাকড়াও করে তাদের মাস্টারমশাইদের। এবং এই মাস্টারমশাইরাই বেশিরভাগ খাদ্য এবং শিল্পের ক্রেতা “. অর্থনীতি বিভাগের দোকানে গিয়ে জানতে, তাদের এক মাস্টারমশাই আছেন যিনি নাকি সমস্ত প্রাক্তনীদের তাদের বিভাগকে দোকান থেকে খাবার খাওয়ান। তবে এই বছর তিনি সম্ভবত দরকারি কাজে কলকাতায় গেছেন, মেলায় আসতে পারেননি। যদিও রাতে ফেরার কথা ছিল। তিনি ফিরে মেলায় এসেছিলেন কিনা জানি না।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ‘শান্তিনিকেতনের আনন্দবাজার’ বইতে, অমিতাভ চৌধুরীর লেখা থেকে জানা যায় ” রবীন্দ্রনাথ সাধারণত লটারি, পুতুলের দোকান , ফুলের দোকান ইত্যাদিতে বেশি যেতেন। তাঁর উপস্থিতি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নতুন উৎসাহ এনে দিত। ভানুসিংহের পদাবলীতে শ্রীমতী রানু মুখোপাধ্যায়কে লেখা এক চিঠিতে আনন্দবাজারে তার আনন্দ করার এক বিবরণ আছে। এবং চার আনার রুমাল এক টাকায় কেনার কাহিনীও বর্ণনা করেছেন চিঠিতে।

দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এলে ক্রেতা ছাত্র -ছাত্রী এবং বিক্রেতা ছাত্রছাত্রীরা খুশি হয়ে যেতেন। দিলদরিয়া এই মানুষটি অকাতরে পয়সা খরচ করতেন এই খুদে মেলায় এসে। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে খাবারের দোকানে ঢুকলে দাম যত চড়া হোক না কেন, গাঁটের কড়ি গচ্চা দিতে হত না অন্য কারও। শুনেছি জুতো বুরুশের কাজে নেমে একটি ছাত্র পুরো একটাকা আদায় করে ছিল দিনেন্দ্রনাথের কাছ থেকে। ”

আর একটি প্রশ্নও পাঠকের মনে থেকে যেতে পারে, বিক্রি বাট্টা করার পর, টাকা গুলি কি ছাত্র ছাত্রীরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় ? এই চিন্তার দূর হতে পারে, আদ্রিজার লেখা থেকে। আদ্রিজা লিখছে ” কয়েক ঘন্টার কেনা বেচার পর লভ্যাংশ জমা পড়ে বিশ্বভারতীর কর্মীমণ্ডলীর সেবা শাখার তহবিলে। এই তহবিলের টাকা থেকে পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতন সংলগ্ন এলাকায় দুঃস্থ মানুষদের পড়াশোনা, বিবাহ, চিকিৎসা, ইত্যাদি বিভিন্ন কাজে সাহায্য করা ”

আর একটি বিষয় উল্লেখ না করলে হয়তো আনন্দবাজার নিয়ে লেখাটা অসম্পূর্ণ হয়ে যাবে, সেটা হল মেলার শুরু এবং শেষে ঢাকের আওয়াজ। নিবেদিতার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানলাম। ঠাকুর পরিবার যেহেতু ব্রাহ্ম ছিল তাই বিশ্বভারতীতে সম্ভবত মূর্তির পুজো হতো না, মহালয়ের দিন এই ঢাকের তাল দিয়েই পুজোর আবহ ছাড়িয়ে পড়ত সকলের মধ্যে।

আপাতত লেখাটি এখানেই শেষ করছি। আরো অনেক কিছু লেখা বাকি থেকে গেল। ধীরে ধীরে বিভিন্ন পর্বে আমি আনন্দবাজারের একটি সামগ্রিক ইতিহাস এবং রবীন্দ্রচিন্তাকে তুলে ধরবো।

জলবায়ু সংকট কি আরেকটি আর্থিক টাইম বোমা?

আমি রবিবাসরীয়: শান্তিনিকেতনের আনন্দবাজার

০৪:২৪:১৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

‘চল চল দেখবে মজা আনন্দবাজারে,
ছেলেমেয়ে বেচে কেনে কাতারে কাতারে’

লেখার শিরোনাম এবং উল্লেখিত লাইনে আনন্দবাজার শব্দের উল্লেখ, স্বাভাবিক ভাবে অনেক পাঠকের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। তাই প্রথমেই আনন্দবাজার নিয়ে কৌতুহলটা দূর করে নেওয়া দরকার। প্রথমেই জানিয়ে রাখি, লাইনগুলির লেখক, কবি নিশিকান্ত। শান্তিনিকেতন ছেড়ে তিনি পন্ডিচেরী নিবাসী হয়েছিলেন, কিন্তু তার গান বহুবছর ধরে রয়েগেছে শান্তিনিকেতনের সংস্কৃতিতে।

শান্তিনিকেতনে ঋতু উৎসব ও নাটক উৎসব বাদ দিলে , দুটি বড় উৎসব পৌষ মেলা এবং আনন্দবাজার। সুতরাং আনন্দবাজার শান্তিনিকেতনের একটি মেলার নাম। তবে এই মেলাটি অন্যান্য সব মেলাগুলো থেকে স্বাতন্ত্র্য। কারণ, অন্য মেলাগুলোর আয়োজন অন্যরা করে কিন্তু আনন্দবাজারের আয়োজনে থাকেন শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীরা। এই বছর দ্বিতীয়বার আমার এই মেলায় আসা, কিন্তু দিনটি যেহেতু রবিবার তাই শিরোনামে একটু রসিকতা করেছি।

আনন্দবাজারের সঠিক সূচনা বা তারিখ এখনো নির্ধারণ করা যায়নি। ‘প্রবাসী’ পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে সীতা দেবীর লেখা বই ‘পুণ্যস্মৃতি’ থেকে জানা যায় ১৩২৪ সালে নববর্ষের দিন ছেলেদের আনন্দবাজার হয়েছিল। ১৩২৫ সালে মেয়েদের আনন্দবাজার বসেছিল নিচু বাংলায়। পরের বছর ১৩২৬ সালের ২রা বৈশাখ বিদ্যালয়ের ছাত্ররা শালবীথিতে আনন্দবাজারে আয়োজন করে। এরপর আনন্দবাজারের দিন নির্ধারণ করা হয় মহালয়ের দিন। এই রীতি আজও প্রচলিত। তবে ঠিক কবে থেকে এই দিন নির্ধারণ করা হয়, তা এখনো জানা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

প্রথমবার রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এই মেলায় গরহাজির ছিলেন। কারণ ওই সময় তিনি জাপানে ছিলেন। এরপর তিনি শান্তিনিকেতনে ছিলেন কিন্তু আনন্দবাজারে আসেননি এমনটি ঘটেনি। সীতাদেবীর লেখা এবং আনন্দবাজারের পুরোনো খাতা থেকে জানা যায়, আনন্দবাজারের আগের নাম ছিল ‘বউ ঠাকুরানীর হাট ‘।

প্রথমদিকে আনন্দবাজার ছিল পাঠভবনের ছাত্রছাত্রীদের, পরবর্তীকালে অন্যান্য ভবনের ছাত্রছাত্রীরা যুক্ত হন। আগে আনন্দবাজার বসত শালবীথি আম্রকুঞ্জে ঘিরে, এখন বসে গৌরপ্রাঙ্গনে।

এতক্ষন ধরে যে আলোচনা করা হল, তাতে আনন্দবাজারের ইতিহাস পাওয়া গেলো বটে, কিন্তু আনন্দবাজার ঠিক কি, সেটা বোঝা গেলো না, অতএব এবার সরাসরি আনন্দবাজার সম্পর্কে আমার এবং অন্যদের অভিজ্ঞাতার মধ্যে দিয়ে বোঝার চেস্টা করবো। তিরাসা বসাক বলে দ্বাদশ শ্রেণীর এক ছাত্রী, আশ্রম সম্মেলনীর সখা সংঘ ও সাহিত্য বিভাগের যৌথ উদ্যোগে বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত ‘আকাশ’ নামক এক বইয়ে একটি কবিতায় লিখছে

“শারদের প্রাতের মঙ্গলধ্বনি
কাশের বনে দোলে কাশবিলাস
ঢাকের তালে জাগে আনন্দবাজার
গৌরপ্রাঙ্গনে ওঠে সুখবিলাস ”

আনন্দবাজারের দিন কেন ছাত্রছাত্রীদের কাছে সুখবিলাস, এই বিষয়টি নবম শ্রেণীর ছাত্রী রাজন্যার লেখনী থেকে বোঝা যাক, রাজন্যা লিখছে “আমরা সারা বছর এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকি, কারণ এই দিনে আমাদের নিজস্ব বাজার, আনন্দবাজার হয়। অন্যান্য সব বাজারের থেকে এই বাজারটি আমাদের কাছে অন্যরকম, কারণ এই বাজারের আমরা নিজেরা দোকান করি। একমাস আগে থেকে দোকান করার তোড়জোড় শুরু করে দিই। মহালয়ার আগের দিন সবাই আমরা নিজের নিজের জায়গায় গ্রিল, বাঁশ ইত্যাদির দোকান করার সামগ্রী রেখে যাই। প্রায় সকাল থেকেই সবাই দোকান বানাতে শুরু করে দেয়। বিভিন্ন দোকানে বিভিন্ন জিনিস সাজানো থাকে। কেউ বিভিন্ন ধরণের খাবার দোকান বানায় , কেউ হাতে তৈরির জিনিস বিক্রি করে। ”

আর এক নবম শ্রেণীর ছাত্রী দেবস্মিতা লিখছে, “এই বাজারে বিশ্বভারতীর যতগুলো ভবন আছে প্রায় সবাই একটি করে দোকান দেয়, এমনকি পাঠভবনের শিশুদের হোস্টেলের বাচ্ছারাও দোকান দেয়। পাঠভবনের ছাত্র-ছাত্রীদের আশ্রম সম্মেলনি আছে। যেখানে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সাহায্য নিয়ে দোকান বসায়। আশ্রম সম্মেলনির দোকানে পাঠভবনের ছাত্রছাত্রীদের নিজের হাতে লেখা গল্প আর আঁকা নিয়ে একটি আকাশ নামে পত্রিকা প্রকাশ করা হয় এবং কাঠের তৈরী জিনিস পত্র বিক্রি করা হয়। ” এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি এই বছর আমি আকাশ পত্রিকা কিনেছি। সেই পত্রিকা থেকেই এই লেখাগুলো তুলে ধরছি। প্রত্যেক বছরের মত এই বছরেও তড়িৎ দা (পাঠভবনের বাংলার শিক্ষক ) স্টলে ছিলেন। তড়িৎ দার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ করিয়ে দেয় আমার বন্ধু দীপ্র মজুমদার যিনি নিজেও পাঠভবনের প্রাক্তনী।

পাঠভবনের দোকান সম্পর্কে আরো একটু তথ্য যোগ করা যায়, অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী আদ্রিজার লেখা থেকে। আদ্রিজা লিখছে “পাঠভবন আশ্রম সম্মেলনী বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক -শিক্ষিকাদের তৈরী জিনিসপত্রের পসরা নিয়ে বসে পাঠভবনের সামনে। ‘শিল্পীকোন’ ও ‘কবিকোন ‘-এর সামনে দর্শকদের ভিড় দেখা যায় তাদের ছবি আঁকতে বা তাদের নাম দিয়ে কোন কবিতা লিখিয়ে নিতে। ” এই বছর আমিও কবিকোন থেকে আমার নামে একটি কবিতা লিখিয়েছি। কয়েকটি লাইন এখানে তুলে ধরছি।

“রাষ্ট্র বিজ্ঞানের শিক্ষক উনি
তাপস ওনার নাম,
সময় পেলেই মনে পড়ে
তার পূর্ববাংলার গান ”

এই বার আমি একটি ছেলেকে দেখলাম ঘুরে ঘুরে ঝালমুড়ি বিক্রি করছে। আর একটি বিষয় আমার বেশ মজার লাগলো। হটাৎ দেখছি একদল কলেজের ছত্রছাত্রী থালা বাসন বাজিয়ে, নাচ করছে, এর কারণ সম্পর্কে আমার বন্ধুপত্নী অনাম্নী যিনি নিজেও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী সে আমায় অবগত করে জানাল যে বিভাগের দোকানের খাবারের জিনিস আগে বিক্রি হয়ে গেছে, এটা তাদের জয় সূচক আনন্দ।

খাবারের প্রসঙ্গ যখন উঠলো তখন সেই প্রসঙ্গে একটু আসা যাক। ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী স্বস্তিকা তার কবিতায় লিখছে

“আনন্দবাজার আনন্দবাজার
মানুষ আসে হাজার হাজার
ঘুগনি, ফুচকাআর মিষ্টি,
পাপ হয়না, দিলে দৃষ্টি ”

দেবস্মিতার লেখা থেকে খাবারের মেনুতে ঘুগনি, পাঁপড়, মালপোয়া, দইবড়া ইত্যাদি কথা জানা যায়। এই বছর আমিও ঘুগনি, দইবড়া এবং পাঁপড়ি চাট খেয়েছি।

এবার সকলের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে ছাত্র-ছাত্রীরা যদি বিক্রেতা হয় তাহলে ক্রেতা কারা। একধরণের ক্রেতা যারা বাইরে থেকে মেলায় ঘুরতে আসে এবং প্রাক্তনীরা। প্রাক্তনীদের কাছে আনন্দবাজার মিলন মেলাও বটে। আমার এক বান্ধবী নিবেদিতা যিনি বিশ্বভারতীর দর্শন বিভাগের প্রাক্তনী , তার কাছ থেকে জানতে পারি “ছাত্র ছাত্রীরা পাকড়াও করে তাদের মাস্টারমশাইদের। এবং এই মাস্টারমশাইরাই বেশিরভাগ খাদ্য এবং শিল্পের ক্রেতা “. অর্থনীতি বিভাগের দোকানে গিয়ে জানতে, তাদের এক মাস্টারমশাই আছেন যিনি নাকি সমস্ত প্রাক্তনীদের তাদের বিভাগকে দোকান থেকে খাবার খাওয়ান। তবে এই বছর তিনি সম্ভবত দরকারি কাজে কলকাতায় গেছেন, মেলায় আসতে পারেননি। যদিও রাতে ফেরার কথা ছিল। তিনি ফিরে মেলায় এসেছিলেন কিনা জানি না।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ‘শান্তিনিকেতনের আনন্দবাজার’ বইতে, অমিতাভ চৌধুরীর লেখা থেকে জানা যায় ” রবীন্দ্রনাথ সাধারণত লটারি, পুতুলের দোকান , ফুলের দোকান ইত্যাদিতে বেশি যেতেন। তাঁর উপস্থিতি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নতুন উৎসাহ এনে দিত। ভানুসিংহের পদাবলীতে শ্রীমতী রানু মুখোপাধ্যায়কে লেখা এক চিঠিতে আনন্দবাজারে তার আনন্দ করার এক বিবরণ আছে। এবং চার আনার রুমাল এক টাকায় কেনার কাহিনীও বর্ণনা করেছেন চিঠিতে।

দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এলে ক্রেতা ছাত্র -ছাত্রী এবং বিক্রেতা ছাত্রছাত্রীরা খুশি হয়ে যেতেন। দিলদরিয়া এই মানুষটি অকাতরে পয়সা খরচ করতেন এই খুদে মেলায় এসে। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে খাবারের দোকানে ঢুকলে দাম যত চড়া হোক না কেন, গাঁটের কড়ি গচ্চা দিতে হত না অন্য কারও। শুনেছি জুতো বুরুশের কাজে নেমে একটি ছাত্র পুরো একটাকা আদায় করে ছিল দিনেন্দ্রনাথের কাছ থেকে। ”

আর একটি প্রশ্নও পাঠকের মনে থেকে যেতে পারে, বিক্রি বাট্টা করার পর, টাকা গুলি কি ছাত্র ছাত্রীরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় ? এই চিন্তার দূর হতে পারে, আদ্রিজার লেখা থেকে। আদ্রিজা লিখছে ” কয়েক ঘন্টার কেনা বেচার পর লভ্যাংশ জমা পড়ে বিশ্বভারতীর কর্মীমণ্ডলীর সেবা শাখার তহবিলে। এই তহবিলের টাকা থেকে পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতন সংলগ্ন এলাকায় দুঃস্থ মানুষদের পড়াশোনা, বিবাহ, চিকিৎসা, ইত্যাদি বিভিন্ন কাজে সাহায্য করা ”

আর একটি বিষয় উল্লেখ না করলে হয়তো আনন্দবাজার নিয়ে লেখাটা অসম্পূর্ণ হয়ে যাবে, সেটা হল মেলার শুরু এবং শেষে ঢাকের আওয়াজ। নিবেদিতার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানলাম। ঠাকুর পরিবার যেহেতু ব্রাহ্ম ছিল তাই বিশ্বভারতীতে সম্ভবত মূর্তির পুজো হতো না, মহালয়ের দিন এই ঢাকের তাল দিয়েই পুজোর আবহ ছাড়িয়ে পড়ত সকলের মধ্যে।

আপাতত লেখাটি এখানেই শেষ করছি। আরো অনেক কিছু লেখা বাকি থেকে গেল। ধীরে ধীরে বিভিন্ন পর্বে আমি আনন্দবাজারের একটি সামগ্রিক ইতিহাস এবং রবীন্দ্রচিন্তাকে তুলে ধরবো।