ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা: যুক্তরাষ্ট্র ছাড়তে বাধ্য এক নারী
নেদারল্যান্ডসে জন্ম নেওয়া ক্রিস্টিনা কুই মাত্র ১০ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন। কিন্তু ধারাবাহিক স্কুলে গুলিবর্ষণের ঘটনা এবং বন্দুক সহিংসতার কারণে ২০১৭ সালে তিনি দেশ ছেড়ে চলে যান। এখন তিনি নেদারল্যান্ডসেই থাকেন এবং বছরে একবার ওহাইওতে বাবা-মাকে দেখতে যান। তবে দুই ছোট সন্তান থাকার কারণে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বেশি সময় কাটাতে স্বস্তি পান না। তার মতে, যেকোনো প্রতিবেশীর বাড়িতে রাখা বন্দুক শিশুদের হাতে চলে আসতে পারে—এটাই সবচেয়ে বড় ভয়।
গণহত্যা ও প্রতিবাদ
এপ্রিল মাসে ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে গুলিবর্ষণের কয়েক দিন পর ২০০ মানুষ বন্দুক নিয়ন্ত্রণের দাবিতে রাজ্য ক্যাপিটলে মিছিল করেন। বন্দুক সহিংসতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা জানায়, শুধু চলতি বছরেই যুক্তরাষ্ট্রে ৩০২টি গণগুলিবর্ষণ ঘটেছে।
পর্যটকদের অনিশ্চয়তা
কুই একা নন। কানাডার শেরিল জেসামিনও নিরাপত্তার কারণে যুক্তরাষ্ট্র সফর বাতিল করেছেন। তিনি এবং তার সঙ্গী মে মাসে ওরেগন উপকূল ভ্রমণে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০২৪ সালের নির্বাচনে জয়ের পর তারা ভ্রমণ বাতিল করেন। তাদের আশঙ্কা ছিল, সমকামী দম্পতি হিসেবে বৈষম্যের শিকার হতে পারেন এবং অভিবাসন কর্তৃপক্ষের হয়রানির শিকারও হতে পারেন।
বন্দুকভীতি ও নিরাপত্তাহীনতা
জেসামিন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক সহিংসতা সবসময় আলোচনায় থাকে, যা বিদেশি ভ্রমণকারীদের আতঙ্ক বাড়ায়। শুধু ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে কানাডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণকারীর সংখ্যা কমেছে প্রায় ১৮ লাখ। রাজনৈতিক উত্তেজনা ও নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে এই পতন ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সেপ্টেম্বরে আবারও একাধিক বড় গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে—ইউটাহতে রক্ষণশীল কর্মী চার্লি কার্ক খুন হন এবং একই দিনে কলোরাডোতে স্কুলে গুলি চালানো হয়। এসব ঘটনা বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে ভয় আরও গভীর করেছে।
পর্যটনে ধস
ট্যুরিজম ইকোনমিকস নামক গবেষণা সংস্থা চলতি বছরে যুক্তরাষ্ট্রে পর্যটন খাতে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আশা করেছিল। কিন্তু এখন তাদের পূর্বাভাস হলো ৮.২ শতাংশ পতন। তারা বলছে, ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি ও বক্তব্যের কারণে বিদেশি ভ্রমণকারীরা যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করছে।
ন্যাশনাল ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পর্যটক আগমন কমেছে ৩ শতাংশ। শুধু কানাডীয় পর্যটকদের পতনের ফলে সীমান্তবর্তী শহরগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যেমন—সিয়াটলে কানাডীয় পর্যটকদের সংখ্যা ২৬.৯ শতাংশ কমার আশঙ্কা রয়েছে।
বন্দুক সহিংসতা নিয়ে জরিপের ফল
২০২৪ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় ছয় হাজার ভ্রমণকারীর ওপর করা এক জরিপে দেখা যায়, ৯০ শতাংশেরও বেশি যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর অস্ত্র থাকার কারণে ভ্রমণে নিরুৎসাহিত হয়েছেন। এর মধ্যে ৭৪ শতাংশ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক সহিংসতা এখন অতীতের তুলনায় আরও গুরুতর।
যুক্তরাষ্ট্রে গুলিবর্ষণের পরিসংখ্যান
২০২৫ সালে এখন পর্যন্ত ৩০২টি গণগুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ২০২৪ সালে এই সংখ্যা ছিল ৫০৩ এবং ২০২৩ সালে ৬৫৯। ২০১৫ সালে এটি ছিল ৩৩২। তুলনায় কানাডায় প্রতি লাখে বন্দুক-জনিত হত্যার হার ০.৬, নেদারল্যান্ডসে ০.২, আর যুক্তরাষ্ট্রে তা ৪.৫।
কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্য তাদের নাগরিকদের ভ্রমণ পরামর্শে যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক সহিংসতার ঝুঁকির কথা উল্লেখ করেছে। যদিও পর্যটকরা সরাসরি খুব কমই জড়িত হন, তবুও “ভুল সময়ে ভুল জায়গায়” পড়ার ঝুঁকি থেকেই যায়।
বিকল্প গন্তব্যের দিকে ঝোঁক
কুই পরিবার আগামী গ্রীষ্মে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চল ভ্রমণের স্বপ্ন দেখলেও শেষ পর্যন্ত পর্তুগাল ও স্পেনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অন্যদিকে জেসামিন পরিবারও নিউ ইয়র্ক ভ্রমণের বদলে মেক্সিকোকে বেছে নিয়েছেন। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে ব্যয় করা ভ্রমণের অর্থ এখন আর নিরাপদ বা সঠিক সিদ্ধান্ত নয়।