গর্ভবতী নারীরা ব্যাথানাশক ওষুধ টাইলেনল (প্যারাসিটামল) খেলে পরবর্তীতে সন্তানের অটিজম দেখা দিতে পারে–– ট্রাম্প প্রশাসন এরকম নির্দেশনা জারি করতে পারে বলে খবর প্রকাশ করেছে মার্কিন গণমাধ্যম। তবে এটি চিকিৎসা নির্দেশিকার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, তিনি অটিজম নিয়ে একটি “এমেইজিং” ঘোষণা দেবেন।
সাংবাদিকদের তিনি জানান, “অটিজম সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে…। আমার ধারণা, আমরা হয়তো এর একটি কারণ খুঁজে পেয়েছি।”
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভবতী অবস্থায় নারীরা যদি অ্যাসিটামিনোফেন (টাইলেনল, প্যারাসিটামলের মূল উপাদান) খান, তাহলে অটিজমের সঙ্গে সামান্য সম্পর্ক থাকতে পারে। তবে এটি প্রমাণিত নয় যে এই ওষুধই অটিজমের কারণ।
টাইলেনল (প্যারাসিটামল) কী?
টাইলেনল হলো একটি ওভার-দ্য-কাউন্টার (প্রেসক্রিপশন ছাড়া কেনা যায় এমন) ব্যথানাশক ওষুধ। এর মূল উপাদান যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাসিটামিনোফেন নামে পরিচিত, আর বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় একে প্যারাসিটামল বলা হয়।
এটি বিভিন্ন ব্র্যান্ড নামে বিক্রি হয় এবং শিশু ও নবজাতকদের জন্য বিশেষ সংস্করণও পাওয়া যায়। জ্বর ও ব্যথা কমানোর জন্য টাইলেনল এখন বিশ্বজুড়ে ঘরোয়া ওষুধের মধ্যে অন্যতম।
গর্ভাবস্থায় নিরাপত্তা
বিশ্বজুড়ে বড় চিকিৎসা সংগঠনগুলো বলছে, টাইলেনল (প্যারাসিটামল) গর্ভবতী নারীদের জন্য নিরাপদ।
আমেরিকান কলেজ অব অবসটেট্রিক্স অ্যান্ড গাইনেকোলজি জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে চিকিৎসকেরা টাইলেনলকে গর্ভবতী নারীদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ ব্যথানাশকের মধ্যে একটি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
তারা আরও বলেছে, “আগে করা গবেষণাগুলোতে কোনো পরিষ্কার প্রমাণ মেলেনি যে গর্ভাবস্থার যেকোনো সময় সীমিত পরিমাণে অ্যাসিটামিনোফেন ব্যবহার করলে শিশুর বিকাশে সমস্যা হয়।”
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) – এর নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, গর্ভবতী নারীদের জন্য প্যারাসিটামল হলো প্রথম পছন্দের ব্যথানাশক। তাদের ভাষায়, “গর্ভাবস্থায় এটি সাধারণভাবে খাওয়া হয় এবং আপনার শিশুর কোনো ক্ষতি করে না।”
টাইলেনলের উৎপাদক প্রতিষ্ঠান কেনভিউ দাবি করেছে, গর্ভবতী নারীদের জন্য টাইলেনল সবচেয়ে নিরাপদ ব্যথানাশক।
তবে প্রতিষ্ঠানটি এবং মার্কিন চিকিৎসকেরা, উভয়েই পরামর্শ দিচ্ছেন— গর্ভবতী নারীরা যেন প্রেসক্রিপশন বা চিকিৎসাপত্র ছাড়াই এসব ওষুধ খাওয়ার আগে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করেন।
মার্কিন গণমাধ্যম জানিয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন গর্ভবতী নারীদের কেবল উচ্চমাত্রার জ্বরের সময়েই এই ওষুধ খেতে পরামর্শ দেবে। কারণ অনেক বেশি জ্বর মা এবং গর্ভের শিশুর উভয়ের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
টাইলেনল কি অটিজমের কারণ হতে পারে?
এপ্রিল মাসে মার্কিন স্বাস্থ্য ও মানবসেবা বিভাগের প্রধান রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র ঘোষণা করেছিলেন, তিনি পাঁচ মাসের মধ্যে অটিজমের কারণ খুঁজে বের করার জন্য একটি ব্যাপক পরীক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম চালাবেন।
তবে তখন বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছিলেন যে অটিজমের কারণ খুঁজে বের করা সহজ হবে না— কারণ এটি একটি জটিল অবস্থা, যার ওপর বহু দশক ধরে গবেষণা চলছে।
গবেষকদের সাধারণ মত হলো, অটিজমের একক কোনো কারণ নেই। বরং এটি জিনগত ও পরিবেশগত নানা কারণে একসঙ্গে হতে পারে।
অগাস্টে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান স্কুল অব পাবলিক হেলথ-এর ডিনের নেতৃত্বে করা এক গবেষণা পর্যালোচনায় বলা হয়, গর্ভাবস্থায় টাইলেনলের সংস্পর্শে এলে শিশুদের অটিজম ও অন্যান্য স্নায়বিক সমস্যার ঝুঁকি কিছুটা বেড়ে যেতে পারে।
তাই গবেষকেরা পরামর্শ দেন, ওষুধ ব্যবহারে কিছুটা সীমাবদ্ধতা আনা উচিত। তবে তারা এটিও বলেন যে মায়ের জ্বর ও ব্যথা কমাতে টাইলেনল এখনো গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদিকে, ২০২৪ সালে প্রকাশিত আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে— টাইলেনল খাওয়ার সঙ্গে অটিজমের কোনো সম্পর্ক নেই।
ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক ও বিকাশগত মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক মনিক বোথা বলেছেন, “কোনো শক্ত প্রমাণ বা বিশ্বাসযোগ্য গবেষণা এখনো পাওয়া যায়নি যা টাইলেনল আর অটিজমের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক প্রমাণ করে।”
টাইলেনল কীভাবে কাজ করে
ব্যথা কমানোর ওষুধগুলোকে অ্যানালজেসিক বলা হয়। এগুলো দুই ধরনের হতে পারে— ওপিওয়েড ও নন-ওপিওয়েড।
ওপিওয়েড (মারাত্মক ব্যাথার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ), যা আফিম গাছ থেকে পাওয়া যায় বা ল্যাবে তৈরি করা হয়, মস্তিষ্কের ওপিওয়েড রিসেপ্টরের সঙ্গে যুক্ত হয়। এতে ডোপামিন নামের এক ধরনের হরমোন নিঃসৃত হয়, যা আনন্দের অনুভূতির সঙ্গে যুক্ত।
তবে এই ওষুধগুলোতে আসক্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওপিওয়েড ওষুধ দিয়ে ব্যথার চিকিৎসা শুরু করা উচিত নন, যেমন প্যারাসিটামল।
কৌতূহলজনক বিষয় হলো, এখনো বিজ্ঞানীরা পুরোপুরি একমত নন— প্যারাসিটামল আসলে ঠিক কীভাবে কাজ করে।
যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের মাসকিউলোস্কেলেটাল (পেশি ও হাড় সম্পর্কিত) মেডিসিনের অধ্যাপক ফিলিপ কোনাগান বলেন, “প্যারাসিটামলের কার্যপ্রণালী এখনো পুরোপুরি পরিষ্কার হয়নি। ধারণা করা হয়, এটি মস্তিষ্ক ও সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমে ব্যথার অনুভূতিকে প্রভাবিত করে, আবার প্রদাহের জায়গাতেও কাজ করতে পারে।”
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) জানায়, প্যারাসিটামল মস্তিষ্কে ব্যথার সংকেত ও শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণকারী রাসায়নিক বার্তাবাহকগুলোকে বাধা দিয়ে কাজ করে।
অনেকদিন ধরেই একটি ধারণা আছে যে প্যারাসিটামল সাইক্লোঅক্সিজেনেজ (সিওএক্স) নামক এক ধরনের এনজাইমকে বাধা দেয়। এই এনজাইম প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন তৈরি করে, যা ব্যথার সঙ্গে সম্পর্কিত হরমোনের মতো পদার্থ।
এখন মনে করা হচ্ছে, প্যারাসিটামল আরও বিভিন্নভাবে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ, এটি শরীরে ভেঙে গিয়ে এএম৪০৪ (AM404) নামের একটি যৌগ তৈরি করে, যা ব্যথা কমানোর নানা প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে।
টাইলেনল কতবার খাওয়া যায়?
চিকিৎসকরা বলছেন, প্যারাসিটামল নিরাপদভাবে খাওয়ার জন্য অবশ্যই নির্ধারিত ডোজ মেনে চলা জরুরি। তাদের মতে, ঠিক পরিমাণে এবং স্বল্প সময়ের জন্য এই ওষুধ খেলে সাধারণত কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় না।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের সুপারিশ অনুযায়ী প্রস্তাবিত ডোজ হলো:
- একটি বা দুটি ৫০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট একসাথে খাওয়া
- দিনে সর্বোচ্চ চারবার খাওয়া
- ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ আটটি ট্যাবলেটের বেশি নয়
এই সীমার বেশি খেলে লিভারের গুরুতর ক্ষতি বা লিভার বিকল হয়ে যেতে পারে। কারণ, শরীরে প্যারাসিটামলের প্রায় ৫ শতাংশ ভেঙে গিয়ে এনএপিকিউআই নামে এক ধরনের বিষাক্ত পদার্থে রূপ নেয়, যা লিভারের জন্য ক্ষতিকর।
মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ)-এর তথ্য বলছে, ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে হঠাৎ লিভার বিকলের প্রধান কারণ ছিল প্যারাসিটামল ওভারডোজ।
এর প্রায় অর্ধেক ক্ষেত্রেই ওভারডোজটা দুর্ঘটনাবশত হয়েছিল— মানে, ভুক্তভোগী না জেনেই প্রতিদিনের সর্বোচ্চ সীমার বেশি খেয়ে ফেলেছিলেন।
এটা অনেক সময় হয় কারণ প্যারাসিটামল প্রায় ৬০০ ধরনের ওষুধে মিশ্রিত থাকে। ফলে কেউ যদি ফ্লু বা সর্দি-জ্বরের জন্য একাধিক ওষুধ খায়, তখন খেয়াল না করেই বেশি পরিমাণে প্যারাসিটামল খেয়ে ফেলার ঝুঁকি থাকে।
বিশেষজ্ঞরা অভিভাবকদেরও পরামর্শ দেন— বাচ্চাদের ডোজের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্ক হতে হবে। বিশেষ করে যখন শিশুর যত্ন সারাদিনে একাধিক জায়গায় হয়— যেমন ডে-কেয়ার, দাদা-দাদী বা নানা-নানীর বাড়ি আর নিজের বাড়ি।
কার্যকারিতা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ব্যথা ও হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার জ্বরের চিকিৎসায় প্রথম পছন্দ হিসেবে প্যারাসিটামল ব্যবহারের পরামর্শ দেয়।
যদি এটি কাজ না করে, তাহলে রোগীকে ধাপে ধাপে ব্যথা নিয়ন্ত্রণের জন্য অন্য ওষুধে যেতে হয়— আগে হালকা ওপিওয়েড, পরে শক্তিশালী ওপিওয়েড, এবং প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা।
প্যারাসিটামলের কার্যকারিতা নির্ভর করে কোন ধরনের ব্যথার জন্য এটি ব্যবহার করা হচ্ছে তার ওপর।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোক্রেন ইনস্টিটিউট প্রকাশিত গবেষণা বিশ্লেষণ করে, জানায়—
- এটি তীব্র মাইগ্রেন, প্রসব-পরবর্তী ব্যথা এবং অস্ত্রোপচারের পর ব্যথা কমাতে কার্যকর।
- তবে হাঁটুর আর্থ্রাইটিসের মতো রোগে এর সুফলকে “সীমিত” বা মাঝারি ধরা হয়।
- আর কোমরের ব্যথা বা ক্যানসারের সঙ্গে যুক্ত শারীরিক অস্বস্তির ক্ষেত্রে, কোক্রেন ইনস্টিটিউটের মতে, এটি প্লাসিবোর (যেমন চিনি খাওয়ার ট্যাবলেটের মতো কার্যকারিতা-বিহীন চিকিৎসা) চেয়ে বেশি কার্যকর নয়।
BBC News বাংলা