একটা সময় ছিলো আমরা কয়েক বন্ধু মিলে কোন কোন রবিবার সকালে ঢাকার পাশের কলাকুপা বান্দুরা হয়ে (নবাবগঞ্জের মধ্যে পড়ে) ওদিকে দোহার অবধি চলে যেতাম। দুটো এলাকারই কিছু কিছু স্থান ও বিষয়গুলো সে সময়ের ঢাকা বা আজকের পুরানো ঢাকার থেকে বেশি নাগরিক মনে হতো। তাছাড়া সেখানে ছিলো অনেক অতীত আভিজাত্যের ছাপ। কোন একটি স্থান, বাড়ি বা কোন দেশের সংস্কৃতি বুঝতে হলে প্রথম উপায় সেখানের রান্নার স্বাদ। এই রান্নার ক্ষেত্রে কলাকুপা বান্দুরা ও দোহার এর মালিকান্দা গ্রামসহ এসব এলাকা- পুরানো ঢাকার থেকেও এক ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের প্রমাণ রাখতো।
যেমন ২০০৮ বা ২০০৯ এর দিকে একবার আসামের একটি হোটেলে ব্রহ্মপুত্রের রুই আর পাহাড়ি মুরগি রুমে দিয়ে যাবার সময় ছেলেটি কিছুটা পূর্ববঙ্গের টানে বলে, স্যার খাওয়া হয়ে গেলে আমি এগুলো ক্লিন করার জন্য আসব, জানাবেন রান্না কেমন হয়েছে? আমিই রান্না করেছি। সে ফিরে এলে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমার বাড়ি কি ঢাকার কলাকুপা বান্দুরায়? সে হেসে উত্তর দেয়, স্যার আমার নয়, আমার বাবার বাড়ি ছিলো সেখানে। বাবার কাছ থেকে আমার রান্না শেখা। এমনকি তার কাছে জানতে পারি তখনও তার বাবার এলাকার অনেকে সেখানে বাবুর্চি হিসেবে কাজ করতে যায়।
আর দোহার এর মালিকান্দায় আমরা একটি বড় দীঘি ও তার পাশের একটা বড় বট গাছ সহ দীঘির যে বিশাল পাড়টি সেখানে যেতাম- বেত ও বাঁশের বিভিন্ন ছোট ছোট সৌখিন শো পিস কেনার জন্য। ওখানে বসেই কারিগররা তৈরি করতো।

দোহারে যদিও তখন বেশি পরিচিত মাহবুব ভাই আর নাজমূল হুদা ভাই। তারপরেও দোহার এর আরেকটি গ্রামের ওপর অনেক বেশি টান ছিলো, সেটা মালিকান্দা গ্রাম। পূর্ববাংলায় অর্থাৎ বর্তমানের বাংলাদেশে গ্রামীণ এলিটদের ফেলে যাওয়া এমন বহু গ্রাম আছে। যার পথে পথে বা নানান স্মৃতিতে এ ছাপ। এ গ্রামগুলো যে সভ্যতা, সংস্কৃতি ও স্বচ্ছলতা নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছিলো- আর পুরুষানুক্রমে উচ্চ শিক্ষা নেবার পরেও ওই সময়ের মানুষরা যে ওই গ্রামগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি, তারও বহু ছাপ আছে। এছাড়াও এই মালিকান্দা গ্রামের ওপর আমার আরেকটি টান ছিলো কংগ্রেস নেতা, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল ঘোষের কারণে। যেহেতু ছোট বেলায় বাবা ও জ্যাঠামহাশয়দের কাছে তাঁর সম্পর্কে এত কিছু শুনেছি যেন মনে হতো মানুষটি আমার কাছে জীবন্ত। পরবর্তীতে পড়ার নেশার কারণে কিছুটা জেনেছি তাঁর সম্পর্কে। জেনেছি তাঁর ঢাকার ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবী জীবন। তাছাড়া তিনি ছিলেন কেমিস্ট্রির মানুষ সেটাও একটা কারণ।
পশ্চিমবঙ্গের পরবর্তী এবং এখনও অবধি সেরা মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান রায়ের জন্ম যদিও পূর্ববাংলার সাতক্ষীরায় হয়নি, তবে তারপরেও তার পৈত্রিকবাড়ি ও তার পিতা প্রকাশ রায়ের জন্ম সাতক্ষীরায়। সাতক্ষীরা মূলত অতীতের গ্রেটার যশোহরের অংশ। যা আজ যশোর। আর স্বাভাবিকভাবে এই এলাকার রায়দের সঙ্গে কোন না কোন ভাবে একটা যোগ রয়ে গেছে বারো ভূঁইয়ার ভেতর সব থেকে মানবিক রাজা বসন্ত রায় ও মাথা নত না করা বীর রাজা প্রতাপাদিত্য রায়ের সঙ্গে। তাছাড়া প্রতাপাদিত্যের গড় প্রতাপনগর যেহেতু সাতক্ষীরার মধ্যে তাই ওই এলাকা বঙ্গজ ক্ষত্রিয় ও পাঠান বীরের বংশধরদের একটা মিলনস্থান। এমনকি প্রতাপাদিত্যের অস্ত্র তৈরি করতো যে এলাকা সেখানে নিবিড়ভাবে ঘুরে দেখেছি, আজ তারা কর্মকার হলেও তাদের সঙ্গে একটি মিলিত স্রোত আছে পাঠান ও বাঙালি অস্ত্র কারিগরের।
অন্যদিকে ষাটের দশক অবধি সাতক্ষীরা ও তার পাশের এলাকাগুলো দেখলে বোঝা যেতো এটা সুস্থ সভ্যতা ঘেরা আভিজাত এলাকা। এই এলাকাতেই এস ওয়াজেদ আলীর বাড়ি। বাংলা ও বাঙালির চিন্তায় যে ক’জন আধুনিকতা এনেছেন এস ওয়াজেদ আলী তাদেরই একজন। এবং তার কথা যদিও বাঙালি ভুলে গেছে তবুও মনে করিয়ে দিতে হবে, তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি প্রথম বলেছিলেন, বাঙালির জন্য একটা আলাদা রাষ্ট্র প্রয়োজন। যদিও এস ওয়াজেদ আলীর চিন্তা ও চেতনার বাঙালি ছিলো আধুনিক মানুষ- কোন ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী নয়।

ডা: বিধানচন্দ্র রায়ের পরে প্রফুল্ল চন্দ্র সেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হন, তিনিও আগের সেই যশোহরের অংশ খুলনার সেনহাটির সন্তান। যদিও বেড়ে উঠেছেন বিহারে। প্রফুল্ল চন্দ্র সেনের কথা ছোট বেলা থেকে খুব বেশি শুনেছি, তাছাড়া সেনহাটির মানুষ তিনি। সেনহাটি এক সময়ে শুধু সেনহাটির জমিদারদের জন্য নয়, সেনহাটি, দৌলতপুর, খুলনা এই এলাকাগুলো মূলত সংস্কৃতি চর্চা নিয়ে মেতে থাকা একটা এলাকা ছিলো। শেখ হাসিনার আমলে প্রচুর রাস্তাঘাট ও ব্রিজ হয়ে আগের সেই সব ঐতিহ্য অনেককিছু খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু আমরা যারা নানাভাবে ঘুরে ফিরে কৈশোরে দেশকে চেনার চেষ্টা করেছি তারা জানি সেনহাটি কেমন এলাকা ছিলো।
আজ পূর্ববঙ্গের মানুষ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে একটা ঘৃণা আছে। যেমন সম্প্রতি আমার ছোটভাইসম একজন বললেন, পূর্ববঙ্গের মানুষ এসে কলকাতা শহর নোংরা করাতে পূর্ববঙ্গের মানুষের প্রতি কলকাতার মানুষের একটা ক্ষোভ আছে। তবে গতকালই মনে হয় কোন একটা মিডিয়ায় গ্রানাডার মানুষের সাক্ষাৎকার পড়ছিলাম, সেখানে তারা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমাদের দ্বীপ চলে গেলেও আমাদের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে পারলে, আমরা টিকে থাকবো। বাস্তবে সংস্কৃতিই যে সব তার প্রমাণও কিন্তু এই পূর্ববাংলার ক্ষেত্রে মেলে। আর অজয় মুখার্জ্জী মুখ্যমন্ত্রী হবার পূর্ব অবধি পশ্চিমবঙ্গের সব মুখ্যমন্ত্রীর আদি বাড়ি পূর্ববাংলায়। যাহোক, পূর্ববঙ্গের সেই মোগল আমলের আগের থেকে গড়ে ওঠা পরিবারগুলোর মানুষকে রিফিউজি হতে হয়েছে, আবার সব দেশে দরিদ্র মানুষ থাকে তাদেরও রিফিউজি হতে হয়েছে। রিফিউজি জীবনে যে মানুষ আর মানুষ থাকে না বা থাকতে পারে না তা ১৯৭১ সালে বুঝেছি। তারপরেও রিফিউজিদের জন্য ১৯৭১ সালে প্রফুল্ল সেন, অজয় মুখার্জ্জী, সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় এর যে মমত্ব দেখেছি তা অতুলনীয়। আর ইন্দিরা গান্ধীর কথা বলতে গেলে লেখা ভিন্ন দিকে চলে যাবে।

যাহোক, প্রফুল্ল সেনের পরে আর যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর পৈত্রিকবাড়ি বেশি পরিচিত, অনেকবার যাতায়াতের পথে সেখানে যেতে হয়েছে সেটা জ্যোতি বসুর বারুদীর বাড়ি। এরশাদ আমলে মি. বসু এসে ওই বাড়িতে যাবার পরে সেটা জ্যোতি বসুর বাড়ি হিসেবে ওই এলাকায় বেশি পরিচিত হয়। তার আগে এটা তার ঠাকুরদাদার নামেই বেশি পরিচিত ছিলো। বাড়ির ভগ্নাশেষ এখনও সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে।
আর সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের সময়টা খুব কাছে থেকে দেখার ও বোঝার বয়স হয়েছিলো। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা শুধু তার মাতা ও মাতামহের জন্য নয়। পশ্চিমবঙ্গে উগ্র এবং কম শিক্ষিত বামদের প্ররোচনায় একটি তরুণ সম্প্রদায় যে নকশাল আন্দোলনের নামে খুনি ও আপন সংস্কৃতি বিরোধী হয়ে যাচ্ছিলো- তিনি মূলত সেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালি তরুণদেরকে রক্ষা করেন। হয়তো তাকেও কিছু হত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে- তবে বৃহত্তর কল্যাণে এছাড়া কোন পথ ছিলো না মূর্খ পরিচালিত ওই অন্ধদের ঠেকাতে। চারু মজুমদারের এই খুনি ও সংস্কৃতি বিরোধী তৈরির ভুল পথ কোন শিক্ষিতজন যে সমর্থন করেননি তার প্রমাণ বদরুদ্দিন ওমরও। তিনিও ওই পথকে ভুল বলে সরে আসেন। বাস্তবে খুনি আর বিপ্লবী এক নয়। রাজনৈতিক আন্দোলন ও মব ভায়োলেন্স এক নয়। বিপ্লবীদের নেতা বিপ্লবী হয়, খুনীদের নেতা খুনি সর্দার বা মহাজন হয়।
যাহোক, জ্যোতিবাবুর আমল ও বুদ্ধবাবুর আমলে বিশেষ আগ্রহ ছিলো তাদের পার্টি কেন্দ্রিক লোকাল গভর্নমেন্ট নির্বাচন নিয়ে। রাজনীতি দিয়ে সভ্য সমাজকে ভেঙে ফেলার জন্য এর থেকে বড় অস্ত্র খুব কম আছে।

তবে এই লোকাল গভর্নমেন্ট ছাড়া ২০১১ সালের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন কভার করার জন্য এপ্রিলের শেষের দিকে পশ্চিমবঙ্গে যাই। দিল্লি হয়ে কলকাতা নামার পরেই বুঝতে পারি, বামফ্রন্টে ভাঙনের স্রোত। মহাশ্বেতা দেবী, শাওলী মিত্র সকলে মমতা ব্যানার্জীর তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন। বুদ্ধবাবুর সঙ্গে আছেন কেবল শঙ্খ ঘোষ, নীরেন চক্রবর্তী, মুস্তফা সিরাজের মত মানুষেরা। পশ্চিমবঙ্গের বাম শাসনকে কখনও তেমন পছন্দ না করলেও শঙ্খ ঘোষ, নীরেন চক্রবর্তী, মুস্তফা সিরাজ প্রিয় লেখক শুধু নন, প্রিয় মানুষও।
যাহোক, গড়িয়াহাটে একটি শান্ত পরিপাটি গেস্ট হাউসে ডেরা গেঁড়ে, নির্বাচনী রিপোর্টিং এ নেমে পড়ি। কয়েকটি জেলা ও কলকাতার পাক সার্কাস ঘুরে বুঝতে পারি, বামজোটের মূল শক্তি সংখ্যালঘু ভোট হাতছাড়া হয়ে গেছে। সেটা এখন তৃণমূলের দিকে। তাছাড়া কালোটাকার নির্বাচনের দেশে বড় হয়েছি, নির্বাচন কভার করেছি একের পর এক। তাই সেবার পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে নতুন বিষয় দেখলাম, কালোটাকার একটি স্রোত বইছে নির্বাচনী প্রচারের গভীর তলদেশ দিয়ে। এক বন্ধু সাংবাদিককে বললাম, সে পাত্তা না দিয়ে বরং বারফাট্টাই দেখালো, ওটা তোমাদের দেশে হতে পারে, আমাদের দেশে নয়। একে ছোট দেশ, তারপরে গণতন্ত্র হোঁচট খায় বার বার, রাজপথে সরকার পরিবর্তন নির্ধারণ হয়। দেশের স্রষ্টা সবংশে নিধন হয়। তাই আমাদেরকে যে নির্বাচন নিয়ে এসব কথা শুনতে হবে সেটাতো স্বাভাবিকই। তাই প্রথমেই ধাক্কা খেয়ে আর বলিনি। পরে যখন তাদের রাজ্যে পরিবর্তনের পরে পৃথিবীর বড় রাষ্ট্রের একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিয়ে হাজির হলেন বাংলাদেশ হয়ে – তখন ওই বন্ধুকে ফোন করেছিলাম, কেমন হলো এত বড় রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর তোমাদের রাজ্যে। সে বললো, খুবই ভালো। বুঝলাম, কলকাতা আছে কলকাতাতেই- যায়নি এর বাইরে।

যাহোক, বন্ধু ও ছোট ভাই সুব্রত সেন সব সময়ই নির্বাচনের হিসাব সঠিক করে। ও আমাকে ডিনার করাতে পাক সার্কাসে নিয়ে যাচ্ছে ওর গাড়ি রেখে হাতে টানা রিকসায়। ওই রিকসায় বসে তাকে জিজ্ঞেস করি, কে জিতবে? সে বলে, এবার মমতা। এতে কোন সন্দেহ নেই। ও আরো কিছু কারণ বললো।
এর পরে ঠিক করলাম, মমতা ব্যানার্জীর একটা সাক্ষাৎকার নেয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। তখন যদিও The Week ছেড়ে দিয়েছেন, তরুণদা অর্থাৎ তরুণ গঙ্গোপাধ্যায়। বড় সাংবাদিক হয়েও তার লেখক ভাই শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোট ভাই এ পরিচয়ের থেকে খুব বেশি বের হতে পারেননি। শুধু পূর্ববাংলার মানুষ বলে নয়, তরুণদার মনটা অন্য রকম। ঢাকায় এলে অনেক কিছু যেমন তাঁর আমাকে ছাড়া ভালো লাগতো না তেমনি ওখানে গেলে তাঁর আতিথেয়তায় মাঝে মাঝে চাপে পড়ে যেতাম। খুলনার মানুষ। খেতে ও খাওয়াতে ভালোবাসতেন। যা খুলনা নামক সংস্কৃতি নির্ভর শহরটির একটা প্রাচীন ধারা। যাহোক, তরুণদাকে বলতেই তিনি কাকে যেন ফোন করে, আমার সাংবাদিকতার যে পরিচয় দিতে লাগলেন, তাতে আমিও চিনতে পারছি না, যার পরিচয় দিচ্ছে দাদা- সে লোকটা কে?
যাহোক, মনে করেছিলাম, ১০ তারিখ নির্বাচন এই ৭ তারিখে এসে কোন মতে হবু মুখ্যমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার নেবার সময় পাওয়া যাবে না। কিন্তু ঠিকই ৮ মে ১২.৩০ মিনিটে তার কালীঘাটের বাড়িতেই সময় দেয়া হয়। রীতি অনুযায়ী ১২.০০টায় পৌঁছে তার পিএসকে রিপোর্ট করি, আমি পৌঁছে গেছি এবং অপেক্ষা করব এখানে। তিনি বললেন, ১২.৩০ এর পর আরো মিনিট পনের পিছিয়ে যাবে কারণ, ভেতরে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছে। তাকে জানাই কোন অসুবিধা নেই।

মে মাসের তীব্র রোদ, লিলেন জ্যাকেটও রোদের তাপ ঠেকাতে পারছে না। তারপরেও ভাবলাম, যখন সময় আছে একটু আশেপাশে ঘুরে দেখি। কারণ কলকাতার ওই এলাকাটায় ওভাবে কখনও যাওয়া হয়নি। আশেপাশে ঘুরতে গিয়ে জায়গাটা কেমন যেন পরিচিত মনে হতে লাগলো।
পুরানো ঢাকায় বেড়ে উঠেছি তাই বড় আঙিনা, এ ছাদ থেকে ও ছাদ, আবার কলতলা এলাকা, খালপাড়ের গুদারা ঘাট এলাকা এমনি নানান চরিত্রের এলাকার সঙ্গে পরিচয় আছে। যে এলাকাটার সঙ্গে মিলে গেলো তার সঙ্গে মেলাতে পারলাম না মালকান্দিয়া, সেনহাটি, সাতক্ষীরা, বারুদী কোন কিছুই। বা হতে পারে মাথার ওপর তপ্ত রোদ মাথাটা নষ্ট করে দিলো। দ্রুত গাড়িতে চেপে ড্রাইভারকে বললাম, এলগিন রোডে চলো। মোবাইলটা বন্ধ করে দিলাম। এলগিন রোডে এসে সুভাষ বসুর বাড়িতে একাকি অনেকক্ষণ কাটালাম। তারপরে গেস্ট হাউসে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ না করে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকি। তারপর চলে গেলাম গোলপুকুর এলাকায়। তখন সন্ধ্যা রাতের গভীরে। আকাশে তারা, নীচে বিদ্যুতের আলো। গোলপুকুর তো এখন নামে মাত্র পুকুর। তারপরেও সেখানে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকি, এই গোলপুকুর, রামমোহন, হিন্দু কলেজ, উনবিংশ শতাব্দীর বেঙ্গল রেনেসাঁ সবই এই কলকাতা থেকে শুরু।
আবার মনে হতে থাকে একটা শহরে তো নানান পরিবেশ থাকে। আর পরিবেশই যদিও একজন মানুষের বেড়ে ওঠার নিয়ামক। তারপরেও কি সব মানুষের ওপর প্রভাব ফেলে? ব্যতিক্রম কি কেউ থাকে না?
তবে বুঝলাম, সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো আমারও বুক পকেটে রাখা বাঙালি ও বাঙালি-সংস্কৃতি এখন জীবন্ত। এ অবস্থায় আর নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা করা সম্ভব নয়। তাই অনেক রাত অবধি গঙ্গার পাড়ে ঘুরে ঘুরে ভোর রাতে গেস্ট হাউসে ফিরে ৯ তারিখ বিকেলে ঘুম থেকে উঠি। ট্রাভেল এজেন্টকে ফোন করে ২৪ তারিখের টিকিটটা ১১ তারিখ সকালে নিয়ে আসতে বলি। আর ১০ তারিখ পাবলিকের মতো কিছু ভোটের লাইন দেখি।
১০ তারিখ রাত থেকে টিভিতে ভোটের রেজাল্ট দিচ্ছে। যা ধারণায় ছিলো তাই হচ্ছে। ১১ তারিখ ভোর তিনটায় এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্য রওনা। ভোরে ঢাকায় নেমে সোজা অফিসে গিয়ে রুমে ঢুকে শাওয়ার নিয়ে অন্য কাজে বসে যাই। অফিসকে জানিয়ে দেই কলকাতার সংবাদদাতা যা পাঠাবে সেটাই নিও। আমি কিছু লিখবো না।
লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.

স্বদেশ রায় 


















