০৯:১৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

কেন ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভুট্টা আমদানি করছে না?

ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নানা মতবিরোধ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো যুক্তরাষ্ট্রের দাবি যে, ভারতকে মার্কিন ভুট্টা (কর্ন) আমদানি করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লুটনিক অভিযোগ করেছেন, ভারতের জনসংখ্যা ১৪০ কোটি হলেও দেশটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে এক কেজিও ভুট্টা আমদানি করে না। এই প্রসঙ্গকে ঘিরে দেখা যাক ভারতের ভুট্টা উৎপাদন, আমদানির উৎস, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি ব্যবস্থার ধরণ এবং রাজনৈতিক প্রভাব।

ভারতে ভুট্টা উৎপাদন ও আমদানি

ভারতের ভুট্টার ফলন তুলনামূলকভাবে কম। বিশ্ব গড় যেখানে হেক্টর প্রতি ছয় টন, ভারতে তা চার টনেরও নিচে। তবুও দেশটি এতদিন প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল এবং কখনো কখনো রপ্তানিও করেছে, বিশেষ করে হাঁস-মুরগি ও পশুখাদ্যের জন্য এবং মানুষের খাদ্যচাহিদা মেটাতে।

কিন্তু এখন পেট্রলে ইথানল মিশ্রণ বাড়ানোর ফলে ভুট্টার চাহিদা বেড়েছে। এই মৌসুমে প্রায় ৫০ মিলিয়ন টনের মধ্যে ১০-১২ মিলিয়ন টন ভুট্টা ইথানল তৈরিতে ব্যবহৃত হবে বলে ধারণা করছেন আইসিএআরের ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক এইচ. এস. জাত। তবে তিনি বলেছেন, এ বছর ভালো ফলনের কারণে ভুট্টা আমদানির প্রয়োজন হবে না।

Why India Isn't Buying Corn From US, Even After Trump's Tariff Pressure |  Explained | Explainers News - News18

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত ভুট্টা আমদানি করেছে, বিশেষ করে মিয়ানমার ও ইউক্রেন থেকে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ প্রায় এক মিলিয়ন টন, যা আগের বছরের তুলনায় আট গুণ বেশি।

জিএম ভুট্টা ও ভারতের সীমাবদ্ধতা

ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ভুট্টা আমদানি করছে না কারণ সেখানকার বেশিরভাগই জেনেটিকালি মডিফায়েড (জিএম)। ভারতে কেবল জিএম তুলা চাষের অনুমতি রয়েছে। জিএম বেগুন ও সরিষা এখনও পরীক্ষাধীন। সমালোচকদের মতে, জিএম ভুট্টা খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করলে এর সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে বড় ধরনের উদ্বেগ তৈরি হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি ব্যবস্থা ও রপ্তানি প্রয়োজন

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য হলো বিশাল জমি, উচ্চ যান্ত্রিকীকরণ ও ব্যাপক উৎপাদন। সেখানে ভুট্টার ফলন ভারতের তিন গুণ। কৃষিকাজ মূলত পুঁজিবাদী ধাঁচে পরিচালিত হয় এবং উৎপাদন মূলত পশুখাদ্য, ইথানল, শিল্পজাত পণ্য ও রপ্তানির জন্য।

প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন টন ভুট্টা উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে ৪৫ মিলিয়ন টন রপ্তানি হয়। দেশটির কর্ন বেল্ট অঞ্চল (মধ্যপশ্চিম) রিপাবলিকানদের ভোটব্যাংক, যেখানে ভুট্টা ও সয়াবিন উৎপাদন কেন্দ্রীভূত। রাজনৈতিক কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও কংগ্রেসে শক্তিশালী কৃষি লবি সক্রিয় থাকে।

China's Soybean Boycott Threatens U.S. Agriculture: Tariffs, Stockpiles,  and Export Collapse

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য দ্বন্দ্ব ও সয়াবিন সংকট

চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন কেনা বন্ধ করেছে, যা মধ্যপশ্চিমের কৃষকদের জন্য বড় ধাক্কা। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় বাজারে ভুট্টা রপ্তানির সুযোগ খুঁজছে।

ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা

ভারত জিএম ফসলের প্রতি অনীহা থাকায় জিএম ভুট্টা আমদানির প্রশ্নে রাজনৈতিকভাবে বিপাকে পড়তে পারে। এছাড়া মেক্সিকোর অভিজ্ঞতা ভারতকে সতর্ক করেছে। নাফটা চুক্তির পর সস্তা মার্কিন ভুট্টা আমদানিতে এক মিলিয়নেরও বেশি মেক্সিকান কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কৃষিকাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।

মার্কিন ভুট্টার দাম ভারতীয় ভুট্টার প্রায় ৭০%। পরিবহন ও বিপণন খরচ বাদ দিলেও এটি ডাম্পিংয়ের শামিল হবে। বর্তমানে ভারতের কৃষকরা ভুট্টা উৎপাদনে ব্যাপকভাবে যুক্ত হয়েছেন—শুধু বিহারেই ভুট্টার জমি গত মৌসুমে সাড়ে দশ লাখ হেক্টর বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে সস্তা ভুট্টা আমদানি কৃষকদের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে।

Dólar à vista [chevron_left]brby[chevron_right] fecha em baixa de 0,30%, a  r$5,3911 na venda | Reuters

ইথানল কর্মসূচি ও আমদানির বিপরীত প্রভাব

ভারতের ইথানল মিশ্রণ কর্মসূচির লক্ষ্য শুধু কার্বন নিঃসরণ কমানো নয়, বরং বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ও। প্রতি বছর পেট্রলে ২০% ইথানল মেশালে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় বাঁচানো সম্ভব, যা কৃষকদের হাতেই ফিরবে।

এই প্রেক্ষাপটে বিদেশি ভুট্টা আমদানি করলে পুরো কর্মসূচির উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক চাপ সত্ত্বেও ভারত আপাতত মার্কিন ভুট্টা আমদানি করছে না। দেশীয় উৎপাদন বাড়ানো, কৃষকদের সুরক্ষা, জিএম ফসলের ঝুঁকি এবং ইথানল কর্মসূচির কৌশলগত লক্ষ্য—সব মিলিয়ে ভারতের জন্য এটি একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত।

কেন ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভুট্টা আমদানি করছে না?

০৪:১০:২৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নানা মতবিরোধ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো যুক্তরাষ্ট্রের দাবি যে, ভারতকে মার্কিন ভুট্টা (কর্ন) আমদানি করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লুটনিক অভিযোগ করেছেন, ভারতের জনসংখ্যা ১৪০ কোটি হলেও দেশটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে এক কেজিও ভুট্টা আমদানি করে না। এই প্রসঙ্গকে ঘিরে দেখা যাক ভারতের ভুট্টা উৎপাদন, আমদানির উৎস, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি ব্যবস্থার ধরণ এবং রাজনৈতিক প্রভাব।

ভারতে ভুট্টা উৎপাদন ও আমদানি

ভারতের ভুট্টার ফলন তুলনামূলকভাবে কম। বিশ্ব গড় যেখানে হেক্টর প্রতি ছয় টন, ভারতে তা চার টনেরও নিচে। তবুও দেশটি এতদিন প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল এবং কখনো কখনো রপ্তানিও করেছে, বিশেষ করে হাঁস-মুরগি ও পশুখাদ্যের জন্য এবং মানুষের খাদ্যচাহিদা মেটাতে।

কিন্তু এখন পেট্রলে ইথানল মিশ্রণ বাড়ানোর ফলে ভুট্টার চাহিদা বেড়েছে। এই মৌসুমে প্রায় ৫০ মিলিয়ন টনের মধ্যে ১০-১২ মিলিয়ন টন ভুট্টা ইথানল তৈরিতে ব্যবহৃত হবে বলে ধারণা করছেন আইসিএআরের ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক এইচ. এস. জাত। তবে তিনি বলেছেন, এ বছর ভালো ফলনের কারণে ভুট্টা আমদানির প্রয়োজন হবে না।

Why India Isn't Buying Corn From US, Even After Trump's Tariff Pressure |  Explained | Explainers News - News18

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত ভুট্টা আমদানি করেছে, বিশেষ করে মিয়ানমার ও ইউক্রেন থেকে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ প্রায় এক মিলিয়ন টন, যা আগের বছরের তুলনায় আট গুণ বেশি।

জিএম ভুট্টা ও ভারতের সীমাবদ্ধতা

ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ভুট্টা আমদানি করছে না কারণ সেখানকার বেশিরভাগই জেনেটিকালি মডিফায়েড (জিএম)। ভারতে কেবল জিএম তুলা চাষের অনুমতি রয়েছে। জিএম বেগুন ও সরিষা এখনও পরীক্ষাধীন। সমালোচকদের মতে, জিএম ভুট্টা খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করলে এর সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে বড় ধরনের উদ্বেগ তৈরি হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি ব্যবস্থা ও রপ্তানি প্রয়োজন

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য হলো বিশাল জমি, উচ্চ যান্ত্রিকীকরণ ও ব্যাপক উৎপাদন। সেখানে ভুট্টার ফলন ভারতের তিন গুণ। কৃষিকাজ মূলত পুঁজিবাদী ধাঁচে পরিচালিত হয় এবং উৎপাদন মূলত পশুখাদ্য, ইথানল, শিল্পজাত পণ্য ও রপ্তানির জন্য।

প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন টন ভুট্টা উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে ৪৫ মিলিয়ন টন রপ্তানি হয়। দেশটির কর্ন বেল্ট অঞ্চল (মধ্যপশ্চিম) রিপাবলিকানদের ভোটব্যাংক, যেখানে ভুট্টা ও সয়াবিন উৎপাদন কেন্দ্রীভূত। রাজনৈতিক কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও কংগ্রেসে শক্তিশালী কৃষি লবি সক্রিয় থাকে।

China's Soybean Boycott Threatens U.S. Agriculture: Tariffs, Stockpiles,  and Export Collapse

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য দ্বন্দ্ব ও সয়াবিন সংকট

চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন কেনা বন্ধ করেছে, যা মধ্যপশ্চিমের কৃষকদের জন্য বড় ধাক্কা। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় বাজারে ভুট্টা রপ্তানির সুযোগ খুঁজছে।

ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা

ভারত জিএম ফসলের প্রতি অনীহা থাকায় জিএম ভুট্টা আমদানির প্রশ্নে রাজনৈতিকভাবে বিপাকে পড়তে পারে। এছাড়া মেক্সিকোর অভিজ্ঞতা ভারতকে সতর্ক করেছে। নাফটা চুক্তির পর সস্তা মার্কিন ভুট্টা আমদানিতে এক মিলিয়নেরও বেশি মেক্সিকান কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কৃষিকাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।

মার্কিন ভুট্টার দাম ভারতীয় ভুট্টার প্রায় ৭০%। পরিবহন ও বিপণন খরচ বাদ দিলেও এটি ডাম্পিংয়ের শামিল হবে। বর্তমানে ভারতের কৃষকরা ভুট্টা উৎপাদনে ব্যাপকভাবে যুক্ত হয়েছেন—শুধু বিহারেই ভুট্টার জমি গত মৌসুমে সাড়ে দশ লাখ হেক্টর বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে সস্তা ভুট্টা আমদানি কৃষকদের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে।

Dólar à vista [chevron_left]brby[chevron_right] fecha em baixa de 0,30%, a  r$5,3911 na venda | Reuters

ইথানল কর্মসূচি ও আমদানির বিপরীত প্রভাব

ভারতের ইথানল মিশ্রণ কর্মসূচির লক্ষ্য শুধু কার্বন নিঃসরণ কমানো নয়, বরং বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ও। প্রতি বছর পেট্রলে ২০% ইথানল মেশালে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় বাঁচানো সম্ভব, যা কৃষকদের হাতেই ফিরবে।

এই প্রেক্ষাপটে বিদেশি ভুট্টা আমদানি করলে পুরো কর্মসূচির উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক চাপ সত্ত্বেও ভারত আপাতত মার্কিন ভুট্টা আমদানি করছে না। দেশীয় উৎপাদন বাড়ানো, কৃষকদের সুরক্ষা, জিএম ফসলের ঝুঁকি এবং ইথানল কর্মসূচির কৌশলগত লক্ষ্য—সব মিলিয়ে ভারতের জন্য এটি একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত।