স্কটল্যান্ডের অনেক গ্রামীণ অঞ্চল দ্রুত জনশূন্য হয়ে পড়ছে। পশ্চিমা বিশ্বে যখন অভিবাসনবিরোধী মনোভাব বাড়ছে, তখন স্কটল্যান্ডের বহু এলাকা বিদেশি শ্রমিকের অভাবে টিকে থাকতেই হিমশিম খাচ্ছে। কর্মসংস্থানের সংকট, বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়া, স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতি—সব মিলিয়ে স্কটিশ সরকার অভিবাসন বৃদ্ধির পক্ষে জোর দিচ্ছে।
জনসংখ্যা হ্রাস ও শ্রমিক সংকট
স্কটল্যান্ডের পশ্চিমা দ্বীপপুঞ্জে ২০১১ সাল থেকে জনসংখ্যা ৫.৫ শতাংশ কমে গেছে। অন্যান্য গ্রামীণ অঞ্চলও একই সমস্যায় ভুগছে। স্থানীয় কারখানাগুলো শ্রমিক পাচ্ছে না, রেস্তোরাঁগুলো সপ্তাহে মাত্র চারদিন খোলা থাকে এবং তরুণরা সুযোগের অভাবে শহরে চলে যাচ্ছে। এসব কারণে বিদ্যালয় থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবা—সবখানেই সংকট তৈরি হয়েছে। ২০০৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১৪৭টি গ্রামীণ স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে।
সীফুড শিল্পে শ্রমিক সংকটের প্রভাব
উত্তর-পশ্চিম স্কটল্যান্ডের কাইল অব লখালশ অঞ্চলে স্কট ওয়েস্ট সিফুডস নামের একটি শেলফিশ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান শ্রমিক সংকটের কারণে চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। অপারেশন ম্যানেজার জোহান দিওস জানান, হোটেল, রেস্তোরাঁ ও নৌকা—সবখানেই একই অবস্থা; সবাই কর্মী খুঁজছে। শ্রমিক না পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি কাজের একটি অংশ গ্লাসগোতে সরিয়ে নেওয়ার কথাও বিবেচনা করছে, যদিও সেখানে পৌঁছাতে চার ঘণ্টা লাগে।
সংকটের মূল কারণসমূহ
স্থানীয় আইনপ্রণেতা এবং জোহান দিওসের মতে শ্রমিক সংকটের প্রধান কারণ বাসস্থানের অভাব, ব্রেক্সিটের ফলে ইউরোপীয় কর্মী নিয়োগে বাধা সৃষ্টি এবং কোভিড–১৯ পরবর্তী সময়ে বিদেশি শ্রমিকদের দেশে ফিরে যাওয়া। ফলে পর্যটন, মাছধরা, খাদ্য ও পানীয় খাতসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই একই সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
ব্রিটেনের কঠোর অভিবাসন নীতি ও স্কটল্যান্ডের দোটানা
যুক্তরাজ্যে অভিবাসনবিরোধী রাজনীতি দ্রুত বাড়ছে। নাইজেল ফারাজের নেতৃত্বাধীন রিফর্ম ইউকে দল জরিপে এগিয়ে রয়েছে এবং ক্ষমতায় গেলে তারা ছয় লাখ অনথিভুক্ত অভিবাসীকে বহিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছে। এর প্রভাবে লেবার সরকারের কিয়ার স্টার্মার কঠোর অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের নীতি ঘোষণা করেছেন।
কিন্তু স্কটল্যান্ড সম্পূর্ণ বিপরীত সমস্যায় ভুগছে—তার দরকার আরও শ্রমিক। স্কটিশ প্রথম মন্ত্রী জন সুইনি সতর্ক করে বলেছেন, অভিবাসন সীমিত রাখার ব্রিটিশ নীতি স্কটল্যান্ডের অর্থনীতির জন্য বড় হুমকি। বিশেষ করে বয়স্কদের সেবা, স্বাস্থ্য খাত ও জরুরি সেবায় শ্রমিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে।
স্কটল্যান্ডের প্রস্তাবিত বিশেষ ভিসা পরিকল্পনা
শ্রমিক সংকট মোকাবিলায় স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি একটি ‘গ্রামীণ ভিসা পাইলট’ চালুর প্রস্তাব দিয়েছে, যাতে অভিবাসীরা প্রথম চার বছর নির্দিষ্ট অঞ্চলে কাজ করবেন। এছাড়া স্কটিশ গ্র্যাজুয়েট ভিসার মাধ্যমে পড়াশোনা শেষে দুই বছর স্কটল্যান্ডে কাজের সুযোগ দেওয়া এবং বিশেষ গ্রামীণ কর্মী ভিসা চালুর কথাও বলা হয়েছে। তবে লন্ডনভিত্তিক ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এসব প্রস্তাব অনুমোদনের সম্ভাবনা খুবই কম।
গ্রামীণ জীবনের চ্যালেঞ্জ
সাউথ উইস্ট দ্বীপের বোরোডেল হোটেলের ম্যানেজার শিলা পিটারান্না জানান, অনির্ভরযোগ্য ফেরি যোগাযোগ, বিনোদনের অভাব এবং তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান ও সামাজিক সুযোগের সীমাবদ্ধতার কারণে মানুষ এসব অঞ্চলে থাকতে আগ্রহী হয় না। তার সন্তানরাও দ্বীপ ছেড়ে মূল ভূখণ্ডে স্থায়ী হওয়ার পরিকল্পনা করছে।
চিকিৎসক নিয়োগে অতিরিক্ত ব্যয়
উচ্চশিক্ষিত পেশাজীবী নিয়োগ করাও ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়েছে। গত বছর পশ্চিমা দ্বীপপুঞ্জে পরিবার-চিকিৎসক নিয়োগে বছরে ১.৫–১.৬ লাখ পাউন্ড বেতনের অফার দিতে হয়েছে—যা স্কটল্যান্ডের সাধারণ বেতনের তুলনায় অনেক বেশি।
বাসস্থানের সংকট: তরুণদের সবচেয়ে বড় বাধা
স্কট ওয়েস্ট সিফুডসের কর্মী অ্যান্ড্রু পাওরি বলেন, সাধারণ মানুষের পক্ষে বাসা কেনা এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে, কারণ সবকিছু অত্যন্ত ব্যয়বহুল। স্কাই দ্বীপে পর্যটকদের কাছে বাড়ি ভাড়া দিলে আয় বেশি হওয়ায় স্থানীয়দের জন্য বাড়ি দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাচ্ছে। ফলে অধিকাংশ তরুণ পড়াশোনা শেষে গ্লাসগো, এডিনবার্গ বা অ্যাবারডিনে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
যখন ব্রিটেনের রাজনীতি অভিবাসন কমানোর দিকে এগোচ্ছে, তখন স্কটল্যান্ডের গ্রামীণ এলাকাগুলো উল্টোভাবে অভিবাসীদের জন্য সুযোগ বাড়ানোর দাবি তুলছে। শ্রমিক সংকট, জনসংখ্যা হ্রাস, স্বাস্থ্যসেবা ঘাটতি—সব মিলিয়ে স্কটল্যান্ডের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য অভিবাসনই বড় ভরসা হয়ে উঠতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 




















