চীন–জাপান উত্তেজনা আবার উস্কে উঠল
তাইওয়ানকে ঘিরে সম্ভাব্য যেকোনো সংঘাতে জাপান সামরিক হস্তক্ষেপের চেষ্টা করলে দেশটি “চূর্ণবিচূর্ণ পরাজয়” বরণ করবে—চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই ভাষা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই দেশের মধ্যে অন্যতম কড়া হুঁশিয়ারি। কারণ হিসেবে ধরা হয়েছে জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানা তাকাইচির সংসদীয় মন্তব্য, যেখানে তিনি বলেছেন তাইওয়ানে চীনা আগ্রাসন জাপানের জন্য “অস্তিত্ব-সংশ্লিষ্ট হুমকি” হতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে টোকিও সামরিক পদক্ষেপ বিবেচনা করতে পারে। বেইজিং বলছে, এসব কথা আঞ্চলিক স্থিতাবস্থা ভেঙে দিচ্ছে; টোকিও বলছে, তাইওয়ান প্রণালিতে যুদ্ধ মানে জাপানের সমুদ্রপথ ও দ্বীপ নিরাপত্তার ওপর সরাসরি আঘাত।
চীনা পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জাপানকে আবারও “যুদ্ধোত্তর শান্তিবাদী পথ থেকে সরে আসা” এবং যুদ্ধোত্তর সংবিধানের সীমাবদ্ধতা ভাঙার চেষ্টা করার অভিযোগ তুলেছে। চীনা সরকারি গণমাধ্যমে ধারাবাহিক সম্পাদকীয়তে তাকাইচিকে নাম ধরে আক্রমণ করে বলা হচ্ছে, ডানপন্থী রাজনীতিবিদেরা “চীন হুমকি” ইস্যু তুলে প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়াতে ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক ঘনিষ্ঠতা জোরদার করতে চাইছেন। অন্যদিকে টোকিওর সরকারি ভাষ্য হলো—তারা সংলাপের ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়; তবে তাইওয়ান থেকে অল্প দূরত্ব, জ্বালানি আমদানি ও বাণিজ্য রুটের কারণে সামরিক ঝুঁকি এড়াতে বাস্তব প্রস্তুতিও নিতে হবে।

ইতিহাসের ক্ষত আর নতুন নিরাপত্তা রাজনীতি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ও চলাকালে জাপানের দখলদারিত্ব, নানজিং গণহত্যা থেকে শুরু করে ইয়াসুকুনি মন্দিরে জাপানি নেতাদের শ্রদ্ধা জানানো—এসব স্মৃতিকে সামনে রেখে চীনা গণমাধ্যম জাপানের বর্তমান অবস্থানকে “ইতিহাস বিকৃতির ধারাবাহিকতা” বলে আখ্যা দিচ্ছে। কমিউনিস্ট পার্টির পিপলস ডেইলি বলছে, ডানপন্থী রাজনীতিবিদেরা সংবিধানের বাঁধন কাটিয়ে জাপানকে “স্বাভাবিক সামরিক শক্তি” হিসেবে প্রতিষ্ঠার পথে এগোতে চাইছেন। এই কথাগুলো চীনা জনমতের একাংশের ক্ষোভকে উসকে দেয় এবং তাইওয়ান ইস্যুকে জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে আরও শক্ত করে তুলে।
টোকিওর হিসাব অবশ্য অনেক বেশি তাৎক্ষণিক। তাইওয়ান জাপানি দ্বীপের সীমানা থেকে প্রায় একশ কিলোমিটার দূরে, আর তার চারপাশের সমুদ্রপথই দেশটির জ্বালানি আমদানি ও রপ্তানিবাণিজ্যের লাইফলাইন। জাপানি প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা বারবার সতর্ক করেছেন—তাইওয়ান ঘিরে অবরোধ বা সংঘাত হলে জাপানের অর্থনীতি, সরবরাহচেইন ও উপকূলীয় নিরাপত্তা সরাসরি ঝুঁকিতে পড়বে। এ অবস্থায় মার্কিন ঘাঁটি, যৌথ মহড়া এবং পার্শ্ববর্তী দ্বীপে নতুন অবকাঠামো গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে টোকিও বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক সমন্বয় আরও বাড়াচ্ছে।
দুই দেশের ঘরোয়া রাজনীতিতেও তাইওয়ান বড় বিষয় হয়ে উঠেছে। জাপানে তাকাইচির কঠোর ভাষা ডানঘরানার ভোটারদের সন্তুষ্ট করছে, যারা দীর্ঘদিন ধরেই সংবিধান সংশোধন, উচ্চতর প্রতিরক্ষা ব্যয় ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে “সম-অবস্থানের” পক্ষে। চীনে আবার তাইওয়ান নিয়ে যেকোনো বিদেশি মন্তব্যকে “হস্তক্ষেপ” ও জাতীয় মর্যাদায় আঘাত হিসেবে তুলে ধরা হয়, ফলে নরম ভাষায় ছাড় দেওয়ার সুযোগ রাজনীতিকদের হাতে কম। এই দুই ভিন্ন ঘরোয়া বাস্তবতা মিলেমিশে ভুল বোঝাবুঝি, উস্কানি ও পাল্টা উস্কানির ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।
দক্ষিণ কোরিয়া থেকে শুরু করে আসিয়ান দেশগুলো পর্যন্ত গোটা অঞ্চলই এই উত্তেজনার দিকে তাকিয়ে আছে। কেউই চাইছে না তাইওয়ান–জাপান–চীন অক্ষের কোনো সংঘাতে তারা জোর করে টেনে নেওয়া হোক, কিংবা বাণিজ্য রুট হঠাৎ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ুক। আপাতত টোকিও বলছে, তারা সংলাপের পথ খোলা রাখতে চায় এবং তাইওয়ান প্রণালিতে শান্তিপূর্ণ স্থিতাবস্থা বজায় থাকাই সবার স্বার্থে। কিন্তু যখন চীনা মুখপাত্র “ঘাড় কেটে ফেলার” মতো ভাষা ব্যবহার করেন, তখন বোঝা যায়—এই অতি সংবেদনশীল প্রশ্নে এক ইঞ্চি পিছু হটার মতো পরিবেশ দু’পক্ষেই খুব একটা তৈরি নেই।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















