০৫:৪৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

চারজন সাংবাদিকের মৃত্যু

  • স্বদেশ রায়
  • ০৫:৩৬:৪১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • 235

সম্প্রতি চারজন সাংবাদিক অপরিণত বয়সে মারা গেছেন। দুইজনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে নদীতে। একজনের দেহ পাওয়া গেছে ঝাউ গাছে ঝুলানো।

এর ভেতর দু’জন আমার পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ। একজন, বিভূরঞ্জন সরকার অন্য জন আলী হাবিব। দুই জনেরই সাংবাদিকতায় দীর্ঘ ক্যারিয়ার। আলী হাবিব নিতান্ত তরুণ। ষাটও পার হয়নি। বিভূরঞ্জন সরকার এবার ৭০ প্লাস ছিলেন।

দুজনের সঙ্গেই কাকতলীয়ভাবে মৃত্যুর আগের দিন কথা হয়েছিল। আলী হাবিবের সঙ্গে একই অফিসে কাজ করেছি ছয় বছর। পরোপকারে তার জুড়ি মেলা ভার ছিল। আলী হাবিবের পুরানো ও প্রথম থেকে শুরু করা অফিসে আমি অনেক পরে যোগ দেই। তারপরে প্রায় পাঁচ ছয় বছর এক সঙ্গে কাজ করি। আমি কাজে যোগ দেবার কয়েকদিন পরেই সে আমার বাসায় আসে। মানুষকে আপন করে নেবার তার একটা সহজাত ক্ষমতা ছিল। আর ছিল পরিশ্রম করার সীমাহীন ক্ষমতা। এবং সিনিয়রদের প্রতি সম্মানবোধ।

অফিস বদল হলেও তার সঙ্গে মাঝে মধ্যে টেলিফোনে কথা হতো। বেশিভাগ সাহিত্য নিয়ে। সে ছড়া লিখতো। রম্য রচনা লিখতো। সাহিত্যের প্রতি ছিল তার তীব্র অনুরাগ। কোনদিন তাকে প্রশ্ন করিনি, কেন সাংবাদিকতায় এসেছে। শুনতে চায়নি অনেকের মতো কবি হবার ইচ্ছে ছিল কিনা, তারপরে নিয়তি ঠেলে নিয়ে এসেছে এই অসহায় পথে।

গত সতের আঠারো বছরে আলী হাবিবের সঙ্গে দেখা হয়েছে মনে হয় একবার কি দু’বার। দোষটা আমার। যেহেতু আমি প্রেসক্লাব বাসিন্দা নই। নব্বইয়ের দশকে কালে ভদ্রে যেতাম। গত বিশ বছরে পাঁচ বার গেছি কিনা বলতে পারি না। যেহেতু কালচক্রে আমার বন্ধু বান্ধব জগতটি একটু ভিন্ন।

তারপরেও কাকতালীয়ভাবে আলী হাবিবের সঙ্গে শেষ কথা হয় সে মারা যাবার আগের দিন। আমিই তাকে টেলিফোন করেছিলাম। কেমন আছেন বলতেই বলে, বুঝতেই তো পারছেন, কেমন আছি? গলায় কিছুটা হতাশার স্বর। বলি শরীর ভালো তো? সে তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে উত্তর দেয়, শরীরের নাম মহাশয়……।

বিভূ রঞ্জন সরকারকে আমি বিভূদা বলে ডাকতাম উনি আমাকে দাদা বলে ডাকতেন। এক সময়ে তার সঙ্গে বেশ কিছু আড্ডা দিয়েছি। তারও আলী হাবিবের মতো কথা বলার ও রসিকতা করার একটা স্বভাবজাত ক্ষমতা ছিল। যা আকর্ষণীয়। এবং চমৎকার সব গল্প বলতে পারতেন। প্রায় সবই থাকত কমিউনিস্ট পার্টি ও তাঁর নিজ এলাকা কেন্দ্রিক। যেমন ৭০ এর নির্বাচন নিয়ে বা ফরহাদ ভাই (কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ) এর ৮৬ এর নির্বাচনী প্রচার নিয়ে তিনি চমৎকার দুটি গল্প বলতেন। ৭০ এর নির্বাচনে তারা (কমিউনিস্ট পার্টি) বিশাল বক্তা হিসেবে এম এম আকাশকে নিয়ে যায় তাদের এলাকায়। এম এম আকাশ, সেখানে লাওস, কম্বোডিয়া ভিয়েতনামের বিপ্লব নিয়ে অনেক লম্বা ভাষণ দেন। তার ভাষণ শেষ হলে, উপস্থিত শ্রোতারা বলতে থাকে, লাউ, কুমড়া নিয়ে তো বললো, তা আমাদের পাট নিয়ে তো কিছু বললো না। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গিয়েছিলেন সেখানে পাঁচ মিনিট বক্তৃতা দেবার জন্য। তিনি বলেন, ভাইসব, আইউব খানের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোন ঝগড়া নেই। আমিও তার ঘরে মেয়ে দেয়নি সেও আমার ছেলেকে তার মেয়ে দেয়নি। তার সঙ্গে ঝগড়া আমার আপনাদের জন্য। কারণ সে আপনাদের পাটের ন্যায্য দাম দেয় না। তাই পাটের ন্যায্য দাম আদায়ের জন্যে আমার এ নির্বাচন, যদি পাটের দাম চান তবে আমার এই পাগলা সিরাজকে ভোট দিয়েন।

বিভূদার এ গল্পের সত্যতা ছিল। কারণ, আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজভাইকে চিনতাম। সবাই তাকে পাগলা সিরাজ বলতেন। কিন্তু পাগলা বলার কোন কারণ আমি দেখিনি। তার থেকে বোঝা যায় বঙ্গবন্ধু পাগলা বলে গেছেন বলেই সেটা তার পদবী হয়ে গেছে। আর বঙ্গবন্ধুর পাগলা বলার কারণ ছিল। সাংবাদিক হিসেবে দেখেছি, মি. সিরাজ বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার প্রতি ছিলেন অন্ধ। পঞ্চগড় থেকে নানান খাবার নিয়ে আসতেন তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার জন্য। যেন নিজের বোনের বাড়িতে আসতেন তিনি। সে সময়ে শেখ হাসিনা মহাখালীতে ওয়াজেদ মিয়ার সরকারি বাসায় থাকতেন। অবশ্য এটাই মূলত মূল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল। বিশেষ করে ২০০৬ এর একটি জরিপ অনুযায়ী আওয়ামী লীগের মোট ভোটের ৪০% জন্মগত ভোটার অর্থাৎ জন্মসূত্রে তারা আওয়ামীলীগার।

যাহোক, বিভূদার সঙ্গে গত বিশ বছরে একবারমাত্র দেখা হয়। তিনি এসেছিলেন ২০১৫ বা ১৬’র দিকে আমার বাসায়। সেদিন তিনি বেশ অনেক সময় কাটিয়েছিলেন।

এর পরে মারা যাবার দিন দুই আগেও তিনি আমার পোর্টালে লেখা পাঠিয়েছিলেন। এর আগেও বেশ কয়েকটি লেখা পাঠিয়েছিলেন। আমি তাকে প্রতিবারই বলেছি, দাদা কিছু অংশ বাদ দিতে হবে। বা ছোটখাট এডিট করতে হবে। তিনি তার স্বভাব সুলভ স্বরে উত্তর দিয়েছেন, আপনি করে নেন।

বিভূদা অনেক বড় সাংবাদিক। তবে তার সঙ্গে আমাদের একটা পার্থক্য ছিল। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির ফুল টাইম ওয়ার্কার ছিলেন। আমরা সংস্কৃতি কর্মী থেকে সাংবাদিকতায় আসি। একটি দলকে ভোট দেই। কিন্তু সাংবাদিকতা করেছি বিভিন্ন মত ও পথের পত্র পত্রিকায়। এ জন্য বিভূদার মতো সতীত্ব হয়তো আমাদের চরিত্রে নেই।

তাছাড়া বাংলাদেশে ওইভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা কখনো ছিল না, এখনো নেই। তাই নানাভাবে আমরা মত প্রকাশ করতে শিখেছি। যেমন, এরশাদ আমলে মিডিয়ায় এমবার্গো এলো হরতাল শব্দ লেখা যাবে না। এই এমবার্গো শোনার পরে, আমরা তরুণরা প্রেসক্লাবে উদ্বিগ্নতার সঙ্গে জটলা করছি দরজার মুখে। এ সময়ে লাঠি হাতে এলেন, সংবাদ সম্পাদক আহমেদুল কবির। তিনি আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে তার স্বভাব সুলভ আভিজাত ভঙ্গিতে বললেন, তোমাদের সমস্যা কী? আমরা ভয়ে ভয়ে বললাম, সরকার এমবার্গো দিয়েছে “হরতাল” শব্দ লেখা যাবে না। আহমেদুল কবির তার গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন, তাতে অসুবিধা কী? তোমরা হরতালের বদলে শুধু কর্মসূচী লিখবে। এরপর থেকে রাজনৈতিকদলগুলো হরতালের কর্মসূচী দিলে আমরা লিখতাম, আগামী এত তারিখে “সকাল-সন্ধ্যা কর্মসূচী”, অর্ধদিবস হলে “৬-১২টা কর্মসূচী”। এরও আগে জহুর হোসেন চৌধুরী সামরিক শাসনকে প্রকাশ করতে গিয়ে লিখেছিলেন, “চলে নীল শাড়ি, নিঙাড়ি নিঙাড়ি পরাণও মোর”।

ভারতের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক অস্থিরতায় আমরা কীভাবে সাংবাদিকতা করেছি বা আমাদের পূর্বসূরীরা করে গেছেন তা নিয়ে বলতে গেলে ওরা ইন্দিরা গান্ধীর ইমার্জেন্সির আমলের মত কিনা জানতে চায়, হেসে উত্তর দিয়েছিলাম, ইন্দিরা গান্ধীর ইমার্জেন্সি ছিল “সফট ইমার্জেন্সি”।

এ কারণে বিভূদার মানসিক সমস্যাটা হয়তো কিছুটা বুঝতাম। তবে খুব বেশি তার সঙ্গে মেলামেশা করা হয়নি বলে হয়তো গভীরে যেতে পারবো না। বিভূদার শেষ লেখাটি পড়েছি। তিনি যে পত্রিকায় না যাওয়া তার জীবনের বড় ভুল বলেছেন, সেটাও তার সঠিক উপলব্ধি কিনা তা ভবিষ্যত বলবে এবং তার ঘনিষ্ঠ মোজাম্মেল ভাই বা প্রণব বলতে পারে।

তারপরেও আলী হাবিব না হয়, হার্ট ফেল করে মারা গেছে। সময় ও যন্ত্রণাকে নিতে পারেনি। বিভূ রঞ্জন সরকার অন্তত সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে আত্মহননের পথ বেছে না নিলে ভালো করতেন। আর আওয়ামী লীগের কাছে তার না পাবার বেদনা! এখানে তার মনে রাখতে হতো, সর্বোপরি তিনি সংখ্যালঘু। হিন্দুরা দুর্গা পূজা করে তাদের বিশ্বাস থেকে সেখানে আওয়ামী লীগ আমলেও কুমিল্লার বাহার মদ, গাজা দেখতে পেতেন এখনও একই বিষয় দেখছে। তাই বিভূদা তার অমূল্য সন্তানদের পিতা হিসেবে থাকতে পারাটাই বড় হিসেবে দেখতে পারতেন। আত্মহনন তিনি বেছে নিয়ে অনেক ভুল করেছেন।

তাছাড়া শিবরাম চক্রবর্তীর কথা মনে রাখতে হয়, নববর্ষকে বরণ করার কোন দরকার নেই- কারণ নতুন বর্ষে নতুনত্ব কিছু নেই। হাজার চেষ্টা করলেও নতুন বছর এক বছরের বেশি টিকবে না। অর্থাৎ সূর্য যেমন ওঠে তেমনি অস্ত যাবে এটাও সত্য।

তারপরেও আজো অবধি বিভূ রঞ্জন সরকারের মৃতদেহ, ভ্যানের ওপর রাখা এ দৃশ্যটি মনে এলে চোখ বন্ধ করে থাকি,- এতটুকু সম্মান কেউ করেনি, এসব মিলে যে কষ্ট তাও মনের গভীরে রাখা ছাড়া কোন পথ নেই।

এর পরে খুলনায় একজন সাংবাদিকের মৃতদেহ পাওয়া গেছে রূপসা নদীতে। তিনিও নাকি আত্মহত্যা করেছেন। রূপসাকে যিনি গোটা বাঙালিকে চিনিয়েছেন, সেই কবি জীবনানন্দ দাশ কলকাতায় রিফিউজি জীবনকালে ট্রামে চাপা পড়ে মারা গিয়েছিলেন। তারও মূল কারণ ছিল অভাব। তাঁর মৃত্যুকেও আত্মহত্যা বলে প্রমাণ করার অনেক লেখা দেখেছি। পড়তে ইচ্ছে হয়নি কখনও।

আরেকজন সাংবাদিকের মৃতদেহ দড়িতে ঝাউগাছে ঝোলানো অবস্থায় পাওয়া গেছে। অর্থাৎ আত্মহত্যা। বাকি এই দুজন সম্পর্কে কিছুই জানি না নিজ বয়সের দূ্রত্বের কারণে।

যদিও শিরোনামে যোগ করা যেত তবু শিরোনামটি বদলাতে ইচ্ছে করছে না। কারণ এই লেখা যখন শেষ করছি তখন খবর পেলাম ডাকসু নির্বাচন কভার করতে গিয়ে এক সাংবাদিকের মৃত্যু। তার দেহ হল থেকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে- ডাক্তার তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেছে। একটি পোর্টাল ইতোমধ্যে লিখেছে, স্ট্রোক বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। স্ট্রোককে আগে সন্ন্যাস রোগ বলা হতো। ছোট বেলায় এ প্রশ্নটা বড় বেশি মনে হতো, মানুষের মনের ভেতর সন্ন্যাস রোগ থাকলে সে সন্ন্যাসী হয়- কিন্তু স্ট্রোককে কেন সন্ন্যাস রোগ বলা হবে?

লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.

চারজন সাংবাদিকের মৃত্যু

০৫:৩৬:৪১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সম্প্রতি চারজন সাংবাদিক অপরিণত বয়সে মারা গেছেন। দুইজনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে নদীতে। একজনের দেহ পাওয়া গেছে ঝাউ গাছে ঝুলানো।

এর ভেতর দু’জন আমার পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ। একজন, বিভূরঞ্জন সরকার অন্য জন আলী হাবিব। দুই জনেরই সাংবাদিকতায় দীর্ঘ ক্যারিয়ার। আলী হাবিব নিতান্ত তরুণ। ষাটও পার হয়নি। বিভূরঞ্জন সরকার এবার ৭০ প্লাস ছিলেন।

দুজনের সঙ্গেই কাকতলীয়ভাবে মৃত্যুর আগের দিন কথা হয়েছিল। আলী হাবিবের সঙ্গে একই অফিসে কাজ করেছি ছয় বছর। পরোপকারে তার জুড়ি মেলা ভার ছিল। আলী হাবিবের পুরানো ও প্রথম থেকে শুরু করা অফিসে আমি অনেক পরে যোগ দেই। তারপরে প্রায় পাঁচ ছয় বছর এক সঙ্গে কাজ করি। আমি কাজে যোগ দেবার কয়েকদিন পরেই সে আমার বাসায় আসে। মানুষকে আপন করে নেবার তার একটা সহজাত ক্ষমতা ছিল। আর ছিল পরিশ্রম করার সীমাহীন ক্ষমতা। এবং সিনিয়রদের প্রতি সম্মানবোধ।

অফিস বদল হলেও তার সঙ্গে মাঝে মধ্যে টেলিফোনে কথা হতো। বেশিভাগ সাহিত্য নিয়ে। সে ছড়া লিখতো। রম্য রচনা লিখতো। সাহিত্যের প্রতি ছিল তার তীব্র অনুরাগ। কোনদিন তাকে প্রশ্ন করিনি, কেন সাংবাদিকতায় এসেছে। শুনতে চায়নি অনেকের মতো কবি হবার ইচ্ছে ছিল কিনা, তারপরে নিয়তি ঠেলে নিয়ে এসেছে এই অসহায় পথে।

গত সতের আঠারো বছরে আলী হাবিবের সঙ্গে দেখা হয়েছে মনে হয় একবার কি দু’বার। দোষটা আমার। যেহেতু আমি প্রেসক্লাব বাসিন্দা নই। নব্বইয়ের দশকে কালে ভদ্রে যেতাম। গত বিশ বছরে পাঁচ বার গেছি কিনা বলতে পারি না। যেহেতু কালচক্রে আমার বন্ধু বান্ধব জগতটি একটু ভিন্ন।

তারপরেও কাকতালীয়ভাবে আলী হাবিবের সঙ্গে শেষ কথা হয় সে মারা যাবার আগের দিন। আমিই তাকে টেলিফোন করেছিলাম। কেমন আছেন বলতেই বলে, বুঝতেই তো পারছেন, কেমন আছি? গলায় কিছুটা হতাশার স্বর। বলি শরীর ভালো তো? সে তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে উত্তর দেয়, শরীরের নাম মহাশয়……।

বিভূ রঞ্জন সরকারকে আমি বিভূদা বলে ডাকতাম উনি আমাকে দাদা বলে ডাকতেন। এক সময়ে তার সঙ্গে বেশ কিছু আড্ডা দিয়েছি। তারও আলী হাবিবের মতো কথা বলার ও রসিকতা করার একটা স্বভাবজাত ক্ষমতা ছিল। যা আকর্ষণীয়। এবং চমৎকার সব গল্প বলতে পারতেন। প্রায় সবই থাকত কমিউনিস্ট পার্টি ও তাঁর নিজ এলাকা কেন্দ্রিক। যেমন ৭০ এর নির্বাচন নিয়ে বা ফরহাদ ভাই (কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ) এর ৮৬ এর নির্বাচনী প্রচার নিয়ে তিনি চমৎকার দুটি গল্প বলতেন। ৭০ এর নির্বাচনে তারা (কমিউনিস্ট পার্টি) বিশাল বক্তা হিসেবে এম এম আকাশকে নিয়ে যায় তাদের এলাকায়। এম এম আকাশ, সেখানে লাওস, কম্বোডিয়া ভিয়েতনামের বিপ্লব নিয়ে অনেক লম্বা ভাষণ দেন। তার ভাষণ শেষ হলে, উপস্থিত শ্রোতারা বলতে থাকে, লাউ, কুমড়া নিয়ে তো বললো, তা আমাদের পাট নিয়ে তো কিছু বললো না। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গিয়েছিলেন সেখানে পাঁচ মিনিট বক্তৃতা দেবার জন্য। তিনি বলেন, ভাইসব, আইউব খানের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোন ঝগড়া নেই। আমিও তার ঘরে মেয়ে দেয়নি সেও আমার ছেলেকে তার মেয়ে দেয়নি। তার সঙ্গে ঝগড়া আমার আপনাদের জন্য। কারণ সে আপনাদের পাটের ন্যায্য দাম দেয় না। তাই পাটের ন্যায্য দাম আদায়ের জন্যে আমার এ নির্বাচন, যদি পাটের দাম চান তবে আমার এই পাগলা সিরাজকে ভোট দিয়েন।

বিভূদার এ গল্পের সত্যতা ছিল। কারণ, আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজভাইকে চিনতাম। সবাই তাকে পাগলা সিরাজ বলতেন। কিন্তু পাগলা বলার কোন কারণ আমি দেখিনি। তার থেকে বোঝা যায় বঙ্গবন্ধু পাগলা বলে গেছেন বলেই সেটা তার পদবী হয়ে গেছে। আর বঙ্গবন্ধুর পাগলা বলার কারণ ছিল। সাংবাদিক হিসেবে দেখেছি, মি. সিরাজ বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার প্রতি ছিলেন অন্ধ। পঞ্চগড় থেকে নানান খাবার নিয়ে আসতেন তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার জন্য। যেন নিজের বোনের বাড়িতে আসতেন তিনি। সে সময়ে শেখ হাসিনা মহাখালীতে ওয়াজেদ মিয়ার সরকারি বাসায় থাকতেন। অবশ্য এটাই মূলত মূল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল। বিশেষ করে ২০০৬ এর একটি জরিপ অনুযায়ী আওয়ামী লীগের মোট ভোটের ৪০% জন্মগত ভোটার অর্থাৎ জন্মসূত্রে তারা আওয়ামীলীগার।

যাহোক, বিভূদার সঙ্গে গত বিশ বছরে একবারমাত্র দেখা হয়। তিনি এসেছিলেন ২০১৫ বা ১৬’র দিকে আমার বাসায়। সেদিন তিনি বেশ অনেক সময় কাটিয়েছিলেন।

এর পরে মারা যাবার দিন দুই আগেও তিনি আমার পোর্টালে লেখা পাঠিয়েছিলেন। এর আগেও বেশ কয়েকটি লেখা পাঠিয়েছিলেন। আমি তাকে প্রতিবারই বলেছি, দাদা কিছু অংশ বাদ দিতে হবে। বা ছোটখাট এডিট করতে হবে। তিনি তার স্বভাব সুলভ স্বরে উত্তর দিয়েছেন, আপনি করে নেন।

বিভূদা অনেক বড় সাংবাদিক। তবে তার সঙ্গে আমাদের একটা পার্থক্য ছিল। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির ফুল টাইম ওয়ার্কার ছিলেন। আমরা সংস্কৃতি কর্মী থেকে সাংবাদিকতায় আসি। একটি দলকে ভোট দেই। কিন্তু সাংবাদিকতা করেছি বিভিন্ন মত ও পথের পত্র পত্রিকায়। এ জন্য বিভূদার মতো সতীত্ব হয়তো আমাদের চরিত্রে নেই।

তাছাড়া বাংলাদেশে ওইভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা কখনো ছিল না, এখনো নেই। তাই নানাভাবে আমরা মত প্রকাশ করতে শিখেছি। যেমন, এরশাদ আমলে মিডিয়ায় এমবার্গো এলো হরতাল শব্দ লেখা যাবে না। এই এমবার্গো শোনার পরে, আমরা তরুণরা প্রেসক্লাবে উদ্বিগ্নতার সঙ্গে জটলা করছি দরজার মুখে। এ সময়ে লাঠি হাতে এলেন, সংবাদ সম্পাদক আহমেদুল কবির। তিনি আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে তার স্বভাব সুলভ আভিজাত ভঙ্গিতে বললেন, তোমাদের সমস্যা কী? আমরা ভয়ে ভয়ে বললাম, সরকার এমবার্গো দিয়েছে “হরতাল” শব্দ লেখা যাবে না। আহমেদুল কবির তার গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন, তাতে অসুবিধা কী? তোমরা হরতালের বদলে শুধু কর্মসূচী লিখবে। এরপর থেকে রাজনৈতিকদলগুলো হরতালের কর্মসূচী দিলে আমরা লিখতাম, আগামী এত তারিখে “সকাল-সন্ধ্যা কর্মসূচী”, অর্ধদিবস হলে “৬-১২টা কর্মসূচী”। এরও আগে জহুর হোসেন চৌধুরী সামরিক শাসনকে প্রকাশ করতে গিয়ে লিখেছিলেন, “চলে নীল শাড়ি, নিঙাড়ি নিঙাড়ি পরাণও মোর”।

ভারতের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক অস্থিরতায় আমরা কীভাবে সাংবাদিকতা করেছি বা আমাদের পূর্বসূরীরা করে গেছেন তা নিয়ে বলতে গেলে ওরা ইন্দিরা গান্ধীর ইমার্জেন্সির আমলের মত কিনা জানতে চায়, হেসে উত্তর দিয়েছিলাম, ইন্দিরা গান্ধীর ইমার্জেন্সি ছিল “সফট ইমার্জেন্সি”।

এ কারণে বিভূদার মানসিক সমস্যাটা হয়তো কিছুটা বুঝতাম। তবে খুব বেশি তার সঙ্গে মেলামেশা করা হয়নি বলে হয়তো গভীরে যেতে পারবো না। বিভূদার শেষ লেখাটি পড়েছি। তিনি যে পত্রিকায় না যাওয়া তার জীবনের বড় ভুল বলেছেন, সেটাও তার সঠিক উপলব্ধি কিনা তা ভবিষ্যত বলবে এবং তার ঘনিষ্ঠ মোজাম্মেল ভাই বা প্রণব বলতে পারে।

তারপরেও আলী হাবিব না হয়, হার্ট ফেল করে মারা গেছে। সময় ও যন্ত্রণাকে নিতে পারেনি। বিভূ রঞ্জন সরকার অন্তত সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে আত্মহননের পথ বেছে না নিলে ভালো করতেন। আর আওয়ামী লীগের কাছে তার না পাবার বেদনা! এখানে তার মনে রাখতে হতো, সর্বোপরি তিনি সংখ্যালঘু। হিন্দুরা দুর্গা পূজা করে তাদের বিশ্বাস থেকে সেখানে আওয়ামী লীগ আমলেও কুমিল্লার বাহার মদ, গাজা দেখতে পেতেন এখনও একই বিষয় দেখছে। তাই বিভূদা তার অমূল্য সন্তানদের পিতা হিসেবে থাকতে পারাটাই বড় হিসেবে দেখতে পারতেন। আত্মহনন তিনি বেছে নিয়ে অনেক ভুল করেছেন।

তাছাড়া শিবরাম চক্রবর্তীর কথা মনে রাখতে হয়, নববর্ষকে বরণ করার কোন দরকার নেই- কারণ নতুন বর্ষে নতুনত্ব কিছু নেই। হাজার চেষ্টা করলেও নতুন বছর এক বছরের বেশি টিকবে না। অর্থাৎ সূর্য যেমন ওঠে তেমনি অস্ত যাবে এটাও সত্য।

তারপরেও আজো অবধি বিভূ রঞ্জন সরকারের মৃতদেহ, ভ্যানের ওপর রাখা এ দৃশ্যটি মনে এলে চোখ বন্ধ করে থাকি,- এতটুকু সম্মান কেউ করেনি, এসব মিলে যে কষ্ট তাও মনের গভীরে রাখা ছাড়া কোন পথ নেই।

এর পরে খুলনায় একজন সাংবাদিকের মৃতদেহ পাওয়া গেছে রূপসা নদীতে। তিনিও নাকি আত্মহত্যা করেছেন। রূপসাকে যিনি গোটা বাঙালিকে চিনিয়েছেন, সেই কবি জীবনানন্দ দাশ কলকাতায় রিফিউজি জীবনকালে ট্রামে চাপা পড়ে মারা গিয়েছিলেন। তারও মূল কারণ ছিল অভাব। তাঁর মৃত্যুকেও আত্মহত্যা বলে প্রমাণ করার অনেক লেখা দেখেছি। পড়তে ইচ্ছে হয়নি কখনও।

আরেকজন সাংবাদিকের মৃতদেহ দড়িতে ঝাউগাছে ঝোলানো অবস্থায় পাওয়া গেছে। অর্থাৎ আত্মহত্যা। বাকি এই দুজন সম্পর্কে কিছুই জানি না নিজ বয়সের দূ্রত্বের কারণে।

যদিও শিরোনামে যোগ করা যেত তবু শিরোনামটি বদলাতে ইচ্ছে করছে না। কারণ এই লেখা যখন শেষ করছি তখন খবর পেলাম ডাকসু নির্বাচন কভার করতে গিয়ে এক সাংবাদিকের মৃত্যু। তার দেহ হল থেকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে- ডাক্তার তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেছে। একটি পোর্টাল ইতোমধ্যে লিখেছে, স্ট্রোক বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। স্ট্রোককে আগে সন্ন্যাস রোগ বলা হতো। ছোট বেলায় এ প্রশ্নটা বড় বেশি মনে হতো, মানুষের মনের ভেতর সন্ন্যাস রোগ থাকলে সে সন্ন্যাসী হয়- কিন্তু স্ট্রোককে কেন সন্ন্যাস রোগ বলা হবে?

লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.