থানা চৌগ্রামের অন্তর্গত তাজপুর গ্রামে একটি প্রসিদ্ধ চতুষ্পাঠী ছিল। উহার অধ্যাপক শ্রীপতি বিদ্যালঙ্কার ছিলেন। এই চতুষ্পাঠী রক্ষা জন্য মহারাণী ভবানী বার্ষিক ৯০ টাকা দান করিতেন। শ্রীপতি বিদ্যালঙ্কারের মৃত্যুর পর, তাহার পুত্র চন্দ্রশেখর তর্কবাগীশ ঐ দান ভোগ করেন। আবার চন্দ্রশেখরের পরলোক গমনের পর, তাহার তিন পুত্র কাশীশ্বর বাচস্পতি, গোবিন্দরাম সিদ্ধান্ত এবং হররাম ভট্টাচার্য ঐ বৃত্তির উত্তরাধিকারী হন। ইহাদের বৃত্তি রহিত হইলে রেবিনিউ বোর্ডের অনুরোধ ক্রমে ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে বৃত্তি দিবার জন্য গবর্ণমেন্ট আদেশ করেন। কিন্তু এক্ষণে বৃত্তি রহিত হইয়া আছে।
প্রায় তিনশত বৎসর পূর্বে রাজসাহী জেলার অন্তর্গত আগদিঘার ভট্টাচার্য মহাশয়দের বংশে পণ্ডিতপ্রবর গদাধর ভট্টাচার্য জন্মগ্রহণ করেন। বগুড়ার নিকট কোন একটি গ্রামে গদাধরের জন্ম হয়। ইনি রাজসাহী ত্যাগ করিয়া নবদ্বীপে বাস করেন। নবদ্বীপের বিখ্যাত পণ্ডিতপ্রবর ভুবনবিদ্যারত্ব গদাধরের বংশসম্ভূত। গদাধর ন্যায়শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তিবাদ ও শক্তিবাদ গ্রন্থ রচনা করেন। এই সকল গ্রন্থ বঙ্গদেশের ন্যায়শাস্ত্রের চতুষ্পাঠীতে আদরের সহিত প্রচলিত আছে।
প্রায় তিনশত বৎসর পূর্বে রাজসাহী জেলার অন্তর্গত বুড়ির ভাগ গ্রামে পুরুষোত্তম দেব তর্কালঙ্কার জন্মগ্রহণ করেন। ইনি পাণিনি ব্যাকরণের বৃত্তি প্রস্তুত করেন। ঐ বৃত্তি “ভাষাবৃত্তি” নামে প্রসিদ্ধ। বেলঘরিয়া নিবাসী প্রসিদ্ধ পণ্ডিতপ্রবর শিবচন্দ্র সিদ্ধান্ত অতি শ্রদ্ধার সহিত “ভাষাবৃত্তি” অধ্যয়ন করেন এবং তাহার নিজ চতুষ্পাঠীতে প্রচলিত করিয়া ছাত্রবৃন্দদের রীতিমতো শিক্ষা দিতেন। পাণিনি ব্যাকরণ অতি প্রাচীন গ্রন্থ।’ এই ব্যাকরণ অত্যন্ত দুরূহ অথচ সম্পূর্ণ। ইহাতে শব্দ, ধাতু, বিভক্তি, প্রত্যয়, সন্ধি, সমাস প্রভৃতি যে রূপ বিস্তৃতভাবে লিখিত আছে, সেরূপ কোন ব্যাকরণে লিখিত হয় নাই। এই ব্যাকরণ সুচারুরূপে অধ্যয়ন করিলে, সংস্কৃত ভাষার শিক্ষাও উৎকৃষ্ট হয়। বেদের ভাষা এত কঠিন, যে অনেক শব্দের বা পদের ব্যাখ্যা পাণিনি ব্যাকরণের সাহায্য ব্যতিরেকে করিতে পারা যায় না। বেদের ভাষা শিক্ষার জন্য পাণিনিতে একটি পরিচ্ছেদ আছে। “ভাষা-বৃত্তি” প্রণয়নে এই দুরূহ ব্যাকরণ শিক্ষার এত সুবিধা হইয়াছিল এবং তাহাতে তর্কালঙ্কার এত বিদ্যাবুদ্ধির পরিচয় দিয়াছিলেন যে, শিবচন্দ্রের ন্যায় বুদ্ধিমান ও পণ্ডিত অবশ্যই গ্রন্থের সমাদর করিবেন।
রাজসাহী জেলার অন্তর্গত মাটিকোপা গ্রামে রমানাথ তর্কপঞ্চানন জন্মগ্রহণ করেন। ইনি একজন প্রধান নৈয়ায়িক ছিলেন। ইহার প্রণীত কোন গ্রন্থের পরিচয় পাওয়া যায় না। ইনি মহারাণী ভবানীর সময় বর্তমান থাকিয়া তাহার বৃত্তি ভোগ করিতেন।
রাজসাহী জেলার অন্তর্গত নাটোরের নিকট আমহাটি গ্রামে কালিকাপ্রসাদ চক্রবর্তী নামে নানা শাস্ত্রে সুপণ্ডিত জনৈক ব্রাহ্মণ জন্মগ্রহণ করেন। এই রাজসাহী জেলার মাটিকোপা গ্রামের প্রসিদ্ধ চতুষ্পাঠীতে তিনি অধ্যয়ন করেন। ইহারই একজন অধস্তন সন্তান গদাধর সিদ্ধান্ত পাণিনি ব্যাকরণে এবং স্মৃতিশাস্ত্রে অদ্বিতীয় পণ্ডিত হইয়া উঠেন। ইনি ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে প্রাতঃস্মরণীয়া মহারাণী ভবানীর অনুগ্রহে নিজ বাটি আমহাটিতেই একটি চতুষ্পাঠী স্থাপিত করেন এবং মাসিক ১০০ টাকা বৃত্তি ব্যতীত সেকালে মহারাণীর নিকট হইতে প্রভূত সাহায্য প্রাপ্ত হইতেন। তাহার প্রণীত কোন গ্রন্থ আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। তাহারই পৌত্র শ্রীযুক্ত চন্দ্রকান্ত বিদ্যাভূষণ মহাশয় মহারাণী প্রদত্ত মাসিক ১০ টাকা বৃত্তি এখনও ব্রিটিশ গবর্ণমেন্ট হইতে প্রাপ্ত হইতেছেন এবং পূর্বপুরুষের অক্ষয় কীর্তি স্থির রাখিয়াছেন।
রাজসাহী জেলার অন্তর্গত নাটোরের নিকট আমহাটি গ্রামে কাশীকান্ত ন্যায়পঞ্চানন নিজ বাটিতে এক চতুষ্পাঠী স্থাপিত করেন। তাহার চতুষ্পাঠীতে মহারাণী ভবানী মাসিক ১০ টাকা বৃত্তি দান দিতেন। ন্যায়পঞ্চাননের পরলোক গমনের পর ব্রিটিশ গবর্ণমেন্ট আমলে ঐ বৃত্তি রহিত হয়।
রাজসাহী জেলার অন্তর্গত চৌগ্রামের নিকট “বড়ে” গ্রামে রুদ্রকান্ত ভট্টাচার্যের এক চতুষ্পাঠী ছিল। এই চতুষ্পাঠীতে মহারাণী ভবানী মাসিক ৫ টাকা বৃত্তি দিতেন। ভট্টাচার্যের পরলোক গমনের পর ব্রিটিশ গবর্ণমেন্ট আমলে ঐ বৃত্তি রহিত হয়।
রাজসাহী জেলার অন্তর্গত পুঁঠিয়া নিবাসী ঈশানচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ সংস্কৃত সাহিত্য ও ব্যাকরণে একজন অদ্বিতীয় পণ্ডিত ছিলেন। তাহার প্রণীত কাব্য চন্দ্রিকার টীকা অতি প্রসিদ্ধ।
প্রায় ৬০/৭০ বৎসর পূর্বে রাজসাহী জেলার অন্তর্গত বেলঘরিয়া গ্রামে শিবচন্দ্র সিদ্ধান্ত নামে একজন অদ্বিতীয় পণ্ডিত জন্মগ্রহণ করেন। ইহার নাম শিব আবার আকৃতিতেও ঠিক শিবের ন্যায় ছিলেন। স্বদেশে সাহিত্য, ব্যাকরণ, স্মৃতি প্রভৃতি অনেক শাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়া পুঠিয়ার রাজা হরেন্দ্রনারায়ণ রায়ের সাহায্যে নিজ পুঠিয়াতেই চতুষ্পাঠী স্থাপিত করেন। শিবচন্দ্র একজন শুতিধর ছিলেন এবং পাঠ্যাবস্থা হইতে তাহার অতি সরল, সুমিষ্ট ও পবিত্র শ্লোক রচনা করিবার শক্তি হয়। নানা শাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়াও শিবচন্দ্রের জ্ঞান পিপাসার শান্তি হইল না। ব্রাহ্মণের বেদবেদান্ত শিক্ষাই প্রধান। অতএব বেদবেদান্ত অধ্যয়নের জন্য টোল ত্যাগ করিয়া তিনি বারাণসী ধামে গমন করেন। তথায় তিনি অনেকদিন বেদাদি অধ্যয়ন করিয়া একজন বেদজ্ঞ প্রসিদ্ধ পণ্ডিত হন। বারাণসী হইতে প্রত্যাগমন করিয়া নিজ জন্ম স্থান বেলঘরিয়া গ্রামেই তিনি চতুষ্পাঠী করিলেন। ইনি বেদান্ত আদি নানা শাস্ত্রে একজন প্রসিদ্ধ পণ্ডিত ছিলেন। ইহার কবিতা ও বিচারশক্তি অতি প্রশংসনীয়। লেখক অনেকবার ইহার শাস্ত্র বিচার সময় কোন কোন সভায় উপস্থিত ছিল। ইহার শাস্ত্রীয় বিচারপ্রণালী অতি সুন্দর এবং ন্যায়সঙ্গত। ইনি অনেকগুলি সংস্কৃত
ও বাংলা গ্রন্থ প্রণয়ন করেন, তন্মধ্যে নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলি প্রসিদ্ধ। (১) সিদ্ধান্ত চন্দ্রিকা, (২) সুধাসিন্ধু, (৩) কাশিনী নাম্নী রুদ্রাধ্যায়ের টীকা, (৪) বিদ্ধম্মনোরঞ্জন কাব্য, (৫) বাসুদেব বিজয় কাব্য, (৬) কালীয়দমন কাব্য। এই সকল গ্রন্থগুলি সংস্কৃত ভাষায় লিখিত হয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ মত খণ্ডন করিয়া শিবচন্দ্র যে “বিধবা বিবাহ খণ্ডন” পুস্তক লিখেন, সেই পুস্তক কেবল বাংলা ভাষায় লিখিত হয়। তাহার সংস্কৃত ভাষায় লিখিত পুস্তক পাঠে ইহা বেশ প্রতীত হয় যে তিনি নানা শাস্ত্রে একজন অদ্বিতীয় পণ্ডিত ছিলেন। আবার কাব্যাদিতেও তিনি বেশ রসিকতার পরিচয় দিয়াছেন।
রাজসাহী জেলা ব্যতীতও অন্য জেলার সংস্কৃত চতুষ্পাঠীতে মহারাণী ভবানী বৃত্তি দিয়া যশস্বিনী হইয়াছেন। বীরভূম জেলার একটি পণ্ডিত রাণী ভবানী প্রদত্ত বার্ষিক ১০০ টাকা বৃত্তি পাইতেন। রাণীর মৃত্যুর পর বৃত্তি রহিত হয়।”
যে সময়ে মহাত্মা আডাম সাহেব রাজসাহীর শিক্ষা বিষয় অনুসন্ধান করেন, সে সময়ে চতুষ্পাঠীর পণ্ডিতগণের এই বিশ্বাস ছিল যে শিক্ষার উন্নতির জন্য গবর্ণমেন্ট পক্ষ হইতে অনুসন্ধান হইতেছে এবং গবর্ণমেন্ট কিছু কবিরার ইচ্ছা করিয়াছেন। এই পণ্ডিতগণ অতি সরল, বাসগৃহ ও পরিচ্ছদ নিতান্ত সামান্য; কিন্তু তাহারা পাণ্ডিত্যে ও মন পবিত্রতায় উচ্চাসন প্রাপ্ত হন। আডাম সাহেব পণ্ডিতগণকে ইংলন্ডের এবং স্কটলন্ডের কৃষকদের ন্যায় অসভ্য বলিয়াও তাহাদের পাণ্ডিত্যের প্রশংসা করিয়াছেন। কোন কোন বিষয়ে আমরা আডাম সাহেবের সহিত ঐক্য হইতে পারি না। বিদেশীয়ের চক্ষুতে পণ্ডিতগণ পরিচ্ছদে ও বাসগৃহে অসভ্য হইতে পারে; কিন্তু তাহাদের সংস্কৃত ভাষায় ও ব্যাকরণের পাণ্ডিত্যে; দর্শন ও ন্যায় শাস্ত্রে গবেষণায় ও বেদের তত্ত্বানুসন্ধানে ধর্মের ও জ্ঞানের জ্যোতিঃ সর্বত্র বিকীর্ণ করিয়াছে এবং যাহারা ধর্ম ও জ্ঞানে শ্রেষ্ঠ, তাহারাই প্রকৃত সভ্য। গৃহ ও পরিচ্ছদ বাহ্যিক সভ্যতার লক্ষণ। ধর্ম ও জ্ঞানই আভ্যন্তরিক সভ্যতার লক্ষণ। উদ্ধৃত অংশ পাঠে আডাম সাহেবের মত জানা যাইবে। ১০
মহারাণী ভবানী রাজত্বের পরে কিছুদিন রাজসাহীতে সংস্কৃত চর্চ্চা বিলুপ্তপ্রায় দেখা যায়। কিন্তু এই উনবিংশতি শতাব্দীর প্রারম্ভে শিবচন্দ্র সিদ্ধান্তের বেদবেদান্তের জ্ঞানে রাজসাহীর নষ্ট গৌরবকে কিয়দংশে উদ্ধার করিয়াছিল। অধুনা রাজসাহীতে সেরূপ সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতের অভাব। রাজসাহী আর সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতের গৌরব করিতে পারে না।