শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ভোগী নদী স্থানীয় মানুষের জীবন, জীবিকা ও সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। পাহাড়ি ঝরনার পানি থেকে জন্ম নেওয়া এই নদী একদিকে প্রকৃতির সৌন্দর্যকে সমৃদ্ধ করেছে, অন্যদিকে কৃষি, মৎস্য এবং যোগাযোগে যুগ যুগ ধরে অবদান রেখেছে।
উৎপত্তি ও প্রবাহপথ
ভোগী নদীর উৎপত্তি গারো পাহাড়ের ঢালু অঞ্চল থেকে। বর্ষাকালে পাহাড়ি ঝরনার পানি গর্জে নেমে এসে নদীর স্রোতকে প্রমত্ত করে তোলে। নদীটি নালিতাবাড়ীর বিভিন্ন গ্রাম অতিক্রম করে কংস নদীর সঙ্গে মিলিত হয়। অর্থাৎ ভোগী নদী মূলত কংস নদীর একটি অংশ বা শাখা হিসেবে বিবেচিত।
কংস নদীর সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ক
কংস নদী শেরপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনার বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে শতাব্দী ধরে সমৃদ্ধ করেছে। ভোগী নদী যেহেতু কংস নদীর একটি শাখা, তাই এর সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্কও গভীর। পুরোনো নৌপথের বর্ণনায় দেখা যায়, কংস নদী এবং এর শাখা-প্রশাখা দিয়ে নৌবাণিজ্য পরিচালিত হতো। কৃষিজাত পণ্য, বিশেষ করে ধান, পাট ও গুড় এই নদীপথে পরিবাহিত হতো। ভোগী নদী সেই বৃহৎ নৌবাণিজ্যিক ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল।

ভারতীয় অংশে প্রবাহ
ভোগী নদীর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এর আন্তঃসীমান্ত চরিত্র। ভারতের মেঘালয় পাহাড় থেকে প্রবাহিত ঝরনাধারা মিলিত হয়ে ভোগীর জন্ম দেয়। ভারতীয় ভূখণ্ডে এর প্রবাহ পাহাড়ি বনের ভেতর দিয়ে চলে, যেখানে গ্রীষ্মে ঝর্ণার ক্ষীণধারা হলেও বর্ষায় তা প্রবল স্রোতে রূপ নেয়। এই পানি বাংলাদেশের দিকে প্রবাহিত হয়ে স্থানীয় কৃষি, মাছ ও দৈনন্দিন জীবনে অবদান রাখে। ফলে ভোগী নদী শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং ভারতীয় অংশের পাহাড়ি সমাজের সঙ্গেও গভীরভাবে সম্পর্কিত।
আন্তঃসীমান্ত বৈশিষ্ট্য
ভোগী নদী একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। ভারতের মেঘালয় পাহাড় থেকে এর জলধারা প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ফলে নদীটির গুরুত্ব শুধু স্থানীয় নয়, বরং দুই দেশের সীমান্তবর্তী পরিবেশ ও মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গেও যুক্ত। সীমান্ত পেরিয়ে আসা পাহাড়ি জলের প্রবল স্রোত বর্ষায় নদীকে প্রমত্ত করে তোলে এবং এই জলের উপরই স্থানীয় কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের একটি বড় অংশ নির্ভরশীল।
শাখা-প্রশাখা ও স্থানীয় গ্রামসমূহ
ভোগী নদী নালিতাবাড়ী উপজেলার ভেতরে প্রবাহিত হয়ে ছোট ছোট খাল ও শাখায় বিভক্ত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য শাখাগুলো হলো—
- চাপাইখোলা খাল, যা কৃষিজমিতে সেচের জন্য ব্যবহৃত হয়।
- ভোগীর দুধকুমারী শাখা, যা কয়েকটি গ্রামে গিয়ে আবার মূল প্রবাহে মিশে গেছে।
- পাইমারী খাল, যা নালিতাবাড়ীর উত্তরাংশে মাঠঘেরা এলাকায় সেচের বড় উৎস।
ভোগী নদীর তীরে অবস্থিত প্রধান গ্রামগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- ভোগী গ্রাম: নদীর নামানুসারে পরিচিত, এখানে নদীর ঘাটে মানুষের প্রতিদিনের জমায়েত হয়।
- চাপাইখোলা: কৃষিনির্ভর এলাকা, নদীর পানির উপরেই কৃষি নির্ভরশীল।
- চর নকলা ও পাইমারী: মাছ ধরা ও সেচকাজে নদী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- সিধুলী ও গড়জরিপা: এ এলাকায় নদীর পানি গ্রামীণ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
এই গ্রামগুলোতে নদীর পানির উপর নির্ভর করে কৃষি, মাছ ধরা, দৈনন্দিন গৃহস্থালি কাজ এবং সামাজিক জীবনের নানা দিক পরিচালিত হয়।
কৃষি ও অর্থনীতিতে অবদান
ভোগী নদীর পানি বর্ষায় মাঠে সেচের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ধান, পাট, শাকসবজি ও তিলসহ নানা ফসল এই নদীর তীরবর্তী জমিতে ফলানো হয়। শুকনো মৌসুমে যখন বৃষ্টির অভাব দেখা দেয়, তখনো নদীর পানিই কৃষকদের ভরসা। অনেক স্থানে ছোট ছোট বাঁধ ও খাল কেটে কৃষকরা সেচের ব্যবস্থা করেন।
মৎস্য সম্পদ
নদীটি একসময় নানা প্রজাতির স্বাদুপানির মাছের আধার ছিল। পুঁটি, শিং, মাগুর, টেংরা, কৈ, রুই, কাতলা ইত্যাদি মাছ সহজেই পাওয়া যেত। স্থানীয় জেলেরা মৌসুমভেদে নদীতে জাল ফেলে জীবিকা নির্বাহ করতেন। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে অতিরিক্ত মাছ ধরা, নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া ও দূষণের কারণে মাছের প্রাচুর্য কমে গেছে।
পরিবহন ও গ্রামীণ জীবন
এক সময় ভোগী নদী ছিল নৌযান চলাচলের গুরুত্বপূর্ণ পথ। পণ্য পরিবহনে নৌকা ব্যবহৃত হতো, গ্রামের মানুষও নৌকা ভ্রমণ করতেন বাজারে বা অন্য গ্রামে যাওয়ার জন্য। যদিও বর্তমানে সড়কপথ ও যানবাহনের আধিক্যে নদীপথের ব্যবহার কমেছে, তবুও অনেক গ্রামে এখনো নৌকাই মানুষের প্রধান যাতায়াতের মাধ্যম।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
ভোগী নদী স্থানীয় মানুষের সংস্কৃতিতেও প্রভাব ফেলেছে। বর্ষাকালে নদীকে ঘিরে গ্রামীণ উৎসব, নৌকা বাইচ এবং গান-বাজনার আসর বসতো। নদীর ঘাটে গ্রামীণ জীবনের নানা আচার-অনুষ্ঠান যেমন স্নান, পূজা বা মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হতো।
নদীর সংকট
আজকের দিনে ভোগী নদী নানা সংকটে জর্জরিত।
- নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে, ফলে নৌযান চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
- বর্ষার সময় অতিরিক্ত ভাঙনে অনেক জমি ও ঘরবাড়ি বিলীন হচ্ছে।
- দূষণ ও বালু উত্তোলন নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে ব্যাহত করছে।
- জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বর্ষায় প্রবল স্রোত আর শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্যতা – দুই বিপরীত চিত্রই নদীকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
ভবিষ্যৎ ভাবনা
ভোগী নদীর অস্তিত্ব রক্ষা করা মানে নালিতাবাড়ীর কৃষি, জীববৈচিত্র্য ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করা। নদী খনন, অবৈধ দখল ও বালু উত্তোলন বন্ধ, তীর সংরক্ষণ এবং পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এছাড়া যেহেতু নদীটি আন্তঃসীমান্ত, তাই বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ উদ্যোগে পানি প্রবাহ ও পরিবেশ রক্ষার টেকসই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
ভোগী নদী শুধু একটি জলস্রোত নয়, বরং কংস নদীর শাখা হিসেবে এটি স্থানীয় ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে এক গুরুত্বপূর্ণ জলধারা। নালিতাবাড়ীর একাধিক গ্রাম ও খালভিত্তিক কৃষি ও জীবনধারার মূল উৎস এই নদী। আন্তঃসীমান্ত বৈশিষ্ট্যের কারণে এর প্রভাব দুই দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলেও পড়ে। প্রকৃতি ও মানুষের সহাবস্থানের সাক্ষ্য বহনকারী এই নদীকে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের দায়িত্ব।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















