তিস্তা নদীকে ঘিরে বিলিয়ন-ডলারের মেগা প্রকল্প আসলে এক বহুমাত্রিক বিপর্যয় ডেকে আনতে যাচ্ছে, একই সঙ্গে এক শ্রেণির মানুষের জন্য তৈরি করছে সীমাহীন মুনাফার সুযোগ—এমনই সতর্কবার্তা দিয়েছেন পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এবং কর্মীরা।
প্রকল্পটি নিয়ে সরকারি কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রায় নেই। তবে এটি শিগগিরই বাস্তবায়িত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা ক্ষতিগ্রস্ত করবে মানুষ, পরিবেশ, অর্থনীতি ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে।
প্রচারপত্র, সম্ভাব্যতা যাচাই ও সংবাদ প্রতিবেদনের তথ্য ঘেঁটে বিশেষজ্ঞরা দেখিয়েছেন, এই প্রকল্পটি না প্রযুক্তিগতভাবে দৃঢ়, না বৈজ্ঞানিকভাবে গ্রহণযোগ্য, না পরিবেশগতভাবে টেকসই।
যে সব সংকট মোকাবিলার যুক্তি দেখিয়ে প্রকল্পটি আনা হয়েছে—যেমন আকস্মিক বন্যা, নদী ভাঙন ও শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাব—তা আরও তীব্র হবে বলেই বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।
কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ায় ভূবিজ্ঞান পড়ান মো. খালেকুজ্জামান। তিনি বলেন, “এই প্রকল্পের ফলে বাংলাদেশকে লাগাতার তিস্তা খনন করতে হবে এবং এর তীর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে ব্যস্ত থাকতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “এতে লাভবান হবে মূলত ঠিকাদার, প্রকল্প ব্যবস্থাপক, রাজনীতিবিদ এবং চীনা সরকার।”
চীনা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পাওয়ার চায়নার বড় ঋণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তায় ‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট’ নামের এই উদ্যোগের লক্ষ্য নদীর চরিত্রকে ‘ব্রেইডেড’ অবস্থা থেকে ‘মিয়ান্ডারিং’-এ রূপান্তর করা। এজন্য ১১৪ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ এবং নদীর প্রস্থ সর্বোচ্চ ১ কিলোমিটারে নামিয়ে আনা হবে। বর্তমানে নদীর গড় প্রস্থ প্রায় ৩ কিলোমিটার।
প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি—১৭০ বর্গকিলোমিটার জমি উদ্ধার, বন্যা ও নদী ভাঙন নিয়ন্ত্রণ, নৌপথ ও সেচ ব্যবস্থা উন্নত করা।
প্রকল্পের পরিকল্পনা
প্রকল্পটি নদীকে একটি নির্দিষ্ট মূল চ্যানেলে আটকে রাখবে, যেখানে থাকবে স্কাওয়ার খাল। নদীর দুই তীরে ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি বাঁধ নির্মাণ করা হবে।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, যতই খনন করা হোক, শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাব দূর করা সম্ভব হবে না।
পানির প্রবাহ সংকট
হিমালয়ের পূর্ব অংশ থেকে উৎপন্ন তিস্তার প্রায় ২,০০০ বর্গকিলোমিটার অববাহিকা বাংলাদেশের মধ্যে পড়ে, যা মোট অববাহিকার ১৭ শতাংশ। ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গে বাঁধ ও পানির প্রত্যাহারের কারণে গত কয়েক দশকে তিস্তার প্রবাহ ও পলি কমে গেছে যথাক্রমে ৬০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার থেকে ২৫ বিলিয়ন কিউবিক মিটার এবং ৪৯ মিলিয়ন টন থেকে ৩ মিলিয়ন টনে।
ভারত একতরফাভাবে শুষ্ক মৌসুমে প্রায় সমস্ত পানি সরিয়ে দেয় এবং বর্ষায় অতিরিক্ত পানি বাংলাদেশে ফেলে দেয়। ১৯৯০-৯৬ সময়কালে বাংলাদেশ শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা থেকে ১০,০০০ কিউসেক পানি পেত। ২০০৬ সালে তা নেমে আসে মাত্র ৭০০ কিউসেকে। ২০১৬ সালে শুকনো মৌসুমে প্রবাহ কমে দাঁড়ায় মাত্র ৩০০ কিউসেকের কিছু বেশি।
খালেকুজ্জামানের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, নদীর তলদেশ গভীর করার পর মূল চ্যানেলে যে পানি পাওয়া যাবে, তা আসলে ভূগর্ভস্থ অগভীর পানি ছাড়া আর কিছু নয়।
তিনি বলেন, যদি নিচের দিকে কোনো বাঁধ বা ব্যারাজ তৈরি করা হয়, তবে খননের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে পানি সংরক্ষণ সম্ভব হতো। কিন্তু প্রকল্পে তেমন কোনো পরিকল্পনা নেই। উপরন্তু বাঁধ তৈরি হলে নতুন সমস্যা দেখা দেবে—পলি আটকে নদী দ্রুত ভরাট হয়ে যাবে।
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, “নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে হস্তক্ষেপ করলে পরিবেশগত বহু প্রভাব দেখা দেবে। নদীর তীরে কংক্রিটের আবরণ দিলে ভূগর্ভস্থ পানির পুনর্ভরণ এবং প্লাবনভূমি থেকে পানি নিষ্কাশন ব্যাহত হবে। পুরো পরিবেশ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
ভারতের প্রভাবকে বৈধতা দেওয়ার আশঙ্কা
বিশেষজ্ঞরা একমত হয়েছেন, এই প্রকল্প আসলে ভারতের অন্যায় ও একতরফা তিস্তা দখলকে বৈধতা দেবে। কারণ মূল সমস্যাটি আন্তঃসীমান্ত পানির, যা সমাধান ছাড়া প্রাকৃতিক প্রবাহ ফেরানো সম্ভব নয়।
খালেকুজ্জামান লিখেছেন, “তিস্তা শুধু পরিবহনের চ্যানেল নয়। প্রবল বৃষ্টিপাত ও সক্রিয় পাহাড় থেকে বিপুল পলি এসে এ ধরনের ব্রেইডেড নদী তৈরি করে।”
পলি ও নদী ভাঙনের আশঙ্কা
তিস্তা বাংলাদেশের অন্য সব নদীর তুলনায় বেশি পলি বহন করে। বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ভূতাত্ত্বিক কারণে নদী ভাঙন ও পলি জমার মাধ্যমে নদী আবার ব্রেইডেড অবস্থায় ফিরে যাবে। তিস্তার অববাহিকা প্রতি বর্গকিলোমিটারে বছরে ৩২০০ টন পলি উৎপন্ন করে—যা সর্বোচ্চ।
তিস্তা আকারের তুলনায় অস্বাভাবিক বেশি পলি বহন করে। ফলে সংকুচিত চ্যানেল দ্রুত পলিতে ভরে যাবে। এর ফল—চরের সৃষ্টি, পানির ধারণক্ষমতা কমে যাওয়া এবং ঘন ঘন আকস্মিক বন্যা।
বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, নদী সচল রাখতে নিয়মিত খনন করতে হবে। তিস্তা বছরে প্রায় ৪৯ মিলিয়ন টন পলি বহন করে। যদি সব পলি নদীর তলদেশে জমে, তবে মাত্র সাত বছরেই খননকৃত চ্যানেল ভরে যাবে।
“নদীর প্রস্থ গড়ে ৩ কিলোমিটার থেকে ৭০০ মিটারে নামালে প্রবাহের গতি বাড়বে, তীর ভাঙন তীব্র হবে এবং সেতুর উজানে পানি জমে বন্যার তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে।”
বড় বন্যায় প্রকল্প ব্যর্থ
যদি ৫০ বছর পরপর হওয়া বন্যা (প্রতি সেকেন্ডে ১০,৬৮০ ঘনমিটার পানি) আসে, তবে সংকীর্ণ ও অগভীর চ্যানেল পাঁচ ঘণ্টারও কম সময়ে ভরে যাবে। অথচ তিস্তায় বন্যা সাধারণত এক দিনের বেশি স্থায়ী হয়। ফলে বড় ধরনের বন্যায় নদী খননকৃত খালের বাইরে গিয়ে প্লাবনভূমি দখল করবে। অর্থাৎ ১৯৬৮ সালের মতো বড় বন্যায় খাল একদিনও টিকবে না।
বিশ্লেষণে আরও বলা হয়েছে, যদি নদীর প্রস্থ ৫ কিলোমিটার থেকে ১ কিলোমিটারে নামানো হয়, তবে নদীর তীর প্রায় ৬০ ডিগ্রি খাড়া হবে। মূল চ্যানেলের ভেতরের স্কাওয়ার খাল হবে ৯০ ডিগ্রি ঢালবিশিষ্ট। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তীর প্রাকৃতিক ঢাল (২৫-৩০ ডিগ্রি) ফিরে পাবে—অর্থাৎ তীর ভাঙন ও নদী প্রশস্ত হওয়া অবশ্যম্ভাবী।
আইন ও জনগণের মতামত
পানি আইন অনুযায়ী, প্রকল্প অনুমোদনের আগে স্থানীয় মানুষ, পানি বিশেষজ্ঞ, সমাজবিজ্ঞানী ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনা করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু পানি বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, “আমরা জানিই না এই প্রকল্পে কী আছে বা সরকারের ভাবনা কী।”
ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের প্রধান শরীফ জামিল বলেন, “প্রকল্পটি থামানো উচিত, যদি না মানুষের স্বার্থ ও পরিবেশ রক্ষার জন্য এটি অপরিহার্য প্রমাণিত হয়।”
তিনি আরও বলেন, “প্রকল্পটি ভূ-রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল এক স্থানে হচ্ছে, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে ভারত-চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিদ্যমান।”
তার ভাষায়, “উজানের দেশ থেকে ন্যায্য পানির ভাগ না পেলে তিস্তা বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়।”
( ইউএনবি থেকে অনূদিত)