ফাস্টফুড বাজারে ব্র্যান্ড পরিচয়ের কেন্দ্রে একটিই সস
মার্কিন ফাস্টফুড চেইন রেইজিং কেইন’স তাদের বিখ্যাত চিকেন সসকে ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার করছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিযোগীরা যেন সহজে রেসিপি নকল করতে না পারে, সে জন্য কোম্পানি সরবরাহ ব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরে বাড়তি কৌশল নিয়েছে; এর মধ্যে অন্যতম হলো—মূল উপাদানগুলো নামহীন বা সাধারণ ব্যাগে পাঠানো, যাতে বাইরে থেকে কেউ বুঝতে না পারে ঠিক কী যাচ্ছে কোথায়। ভাজা মুরগি আর ফ্রাইয়ের ভিড়ে ঠাসা মার্কেটে যেখানে মেনু কাছাকাছি, সেখানে এক চামচ আলাদা স্বাদই পুরো ব্র্যান্ডের পরিচয় তৈরি করছে।
রেইজিং কেইন’স-এর চিকেন ফিঙ্গার আর ক্রিঙ্কল-কাট ফ্রাই প্রায় সব সময়ই আসে ওই সসের সঙ্গে; অনেকের কাছে এটিই চেইনটির ‘সিগনেচার’। অনলাইনে ভক্তরা নিজ নিজ কপি-ক্যাট রেসিপি শেয়ার করেন, কেউ বলেন এতে গোলমরিচ বেশি, কেউ বলেন রসুন বা মেওনিজের টানটাই আলাদা। কিন্তু কোম্পানির ভেতরে নাকি মাত্র অল্প কয়েকজন জানেন পুরোটাই কীভাবে মেশানো হয়। বিভিন্ন সরবরাহকারী থেকে উপাদান আনা হলেও এগুলোর প্যাকেটকে যতটা সম্ভব সাধারণ রাখা হয়, যাতে লেবেল বা বিল দেখে কেউ অনায়াসে আনুপাতিক হিসাব করতে না পারেন।
বাণিজ্যিক গোপনীয়তা ও ব্র্যান্ডের গল্প
খাবার শিল্পে গোপন রেসিপি নতুন কিছু নয়। কোকা-কোলার ফর্মুলা কিংবা কেএফসির “১১টি গোপন মসলা” নিয়ে কত গল্পই না প্রচলিত। রেইজিং কেইন’স সেই পুরোনো ধারা ধরে এগোচ্ছে, তবে নতুন সময়ের বাস্তবতায়। চেইনটি যত বড় হচ্ছে, দেশজুড়ে ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক ও থার্ড-পার্টি লজিস্টিকস তত জটিল হচ্ছে। ফলে ভাবতে হচ্ছে, শুধু কারা রেসিপি জানে তা নয়, বরং সরবরাহ শৃঙ্খলের কোন ধাপে কত তথ্য উন্মুক্ত হয়ে পড়ছে।
উপাদানের চালান একই ধরনের প্যাকেটে পাঠানো, কাগজপত্রে অতিরিক্ত বর্ণনা না দেওয়া কিংবা নির্দিষ্ট কয়েকটি কেন্দ্রের মধ্যেই মিশ্রণ প্রক্রিয়া সীমিত রাখা—এসবের মাধ্যমে কোম্পানি একদিকে রেসিপি আড়াল করে রাখছে, অন্যদিকে শত শত শাখায় একই স্বাদ নিশ্চিত করছে। খুব সীমিত আইটেমের এক সরল মেনু নিয়ে শুরু করা এই ব্র্যান্ডের জন্য সেই সস এখন মূল সম্পদ; সেটি সহজে নকল করা গেলে পার্থক্য তৈরি করার জায়গা অনেকটাই সরে যাবে।
![]()
গোপন সস, কিন্তু প্রকাশ্য প্রতিযোগিতা
ভোক্তার চোখে হয়তো এই সব নিরাপত্তা ব্যবস্থার কিছুই ধরা পড়ে না; তারা শুধু জানে—এটা একটা ‘সিক্রেট সস’। তবু এই অদৃশ্য গোপনীয়তাই গল্প হয়ে ছড়ায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনার জন্ম দেয়, আর বন্ধুদের নিয়ে খেতে গিয়ে বাড়তি কৌতূহল যোগ করে। একই সময়ে খাবার সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বেড়েছে; অ্যালার্জি, সংরক্ষণ উপাদান, পুষ্টিগুণ—এসব নিয়ে প্রশ্নও ওঠে। তাই ফাস্টফুড চেইনগুলোকে একদিকে বাণিজ্যিক গোপনীয়তা বজায় রাখতে, অন্যদিকে উপাদান ও সতর্কতামূলক তথ্য যথেষ্ট পরিমাণে প্রকাশ করতে হয়।
বিশ্লেষকদের মতে, এখন পর্যন্ত বড় ব্র্যান্ডগুলো সেই ভারসাম্য মোটামুটি ধরে রাখতে পেরেছে। তারা সাধারণত অ্যালার্জেন বা সাধারণ উপাদানের তালিকা দেয়, কিন্তু সুনির্দিষ্ট অনুপাত ও স্বাদের কম্বিনেশন নিজেদের কাছে রেখে দেয়। এতে ভোক্তা নিরাপত্তা নিয়ে আশ্বস্ত থাকে, আবার ব্র্যান্ডও আলাদা থাকার সুযোগ পায়।
ফাস্টফুড দৌড়ে এক রেসিপির গুরুত্ব
চিকেন স্যান্ডউইচ ও টেন্ডার নিয়ে বিশ্বজুড়ে যে প্রতিযোগিতা চলছে, সেখানে নতুন নতুন সীমিত সময়ের আইটেম, তারকা সহযোগিতা, চকচকে স্টোর ডিজাইন—সব মিলিয়ে এক ধরনের অস্ত্র দৌড় তৈরি হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে একটি সসের রেসিপি শুধু স্বাদের প্রশ্ন নয়; এটি একটি বৌদ্ধিক সম্পদ, যা দীর্ঘমেয়াদে ব্র্যান্ডকে আলাদা অবস্থান এনে দিতে পারে।
ছোট কিংবা মাঝারি রেস্তোরাঁর জন্য এ গল্পটা ইঙ্গিত দেয়—প্রচুর আইটেম রাখাই সবসময় সাফল্যের শর্ত নয়। কখনও কখনও মাত্র এক-দুটি অনন্য আইটেমই পুরো ব্র্যান্ডের শক্ত ভিত্তি গড়ে দেয়, যদি সেগুলোকে ধারাবাহিকভাবে ভালো রাখা যায় এবং সহজে নকল করা না যায়। রেইজিং কেইন’স সেই জোরটাই বাড়াচ্ছে; গ্রাহকরা হয়তো কখনও জানতে পারবেন না ঠিক কী দিয়ে বানানো সস তারা খাচ্ছেন, কিন্তু সেই অজানাই তাদের বারবার একই জায়গায় টেনে আনতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















