পহেলা বৈশাখের দুইদিন আগে অর্থাৎ চৈত্রসংক্রান্তির আগেরদিন বাড়ির সবকিছুই মনে হয় ঝাড়পুছ হতো। বাদ যেত না লাইব্রেরীটিও। ওইদিন বড় বড় ছবির বই থেকে বাবা, জ্যাঠামহাশয়রা মরক্কো চামড়ায় বাঁধানো যে বইগুলো পড়তেন, বা অনেকদিন আগে পড়ে রেখে দিয়েছিলেন, ওই বইগুলো খুললে কেমন যেন একটা গন্ধ লাগতো, সে গন্ধটা যে ঠিক কেমন তা আজও বলতে পারি না। তবে একটা অন্যরকম অনুভূতি দোলা দিতো শিশুমনে।
সেসব দিন এখন অতীত। সে সংস্কৃতিও অতীত। এখন ভাড়া বাড়িতে “স্টাডি রুম” । যা এ জীবনে অনেকবারই বদলেছে। তাই এখানে কোনো শিশু কোনো বিশেষ দিনে, বিশেষ উৎসবে কোনো উৎসবের গন্ধ পাবে না। ভাড়া বাড়িতে আসলে কোনো কালচার জন্ম নেয় না। ভাড়া বাড়িতে কালচার অনেকটা সংখ্যালঘু বৈরী রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু জীবনের মতো। যার সামান্যটুকু বাঁচিয়ে রাখতে হয় মনের মধ্যে। পারিপার্শ্বিকতা মেরে ফেলে বেশিটুকু।
একটা সময় ছিলো সপ্তাহ ধরে রাতের পর রাত নিজের বইয়ের ধুলো নিজে ঝেড়ে গোছাতে খুব ভালো লাগতো। বছর দশেক আগেও পারতাম। এখন ক্লান্তি নয়, সীমাবদ্ধতা বাধা দেয়। যে কারণে নির্ভর করতে হয় অন্যের ওপর। মাত্র দুইদিন আগে মামুন বই এর ধুলো ঝাড়তে গিয়ে রবীন্দ্ররচনাবলীর সারি থেকে সহজপাঠের চারখন্ড, বিদ্যাসাগর রচনাবলীর পাশ থেকে প্রথমভাগ, দ্বিতীয়ভাগ এমনকি তার পাশে রাখা রামসুন্দর বসাকের বাল্যশিক্ষা ও সীতানাথ বসাকের আদর্শ লিপি নিয়ে এক সঙ্গে একটা সেলফের নিচের দিকে রেখে দেয়।
বুঝতে পারি, ওর কাছে এগুলো ছোটদের বই। তাই মনে করেছে এগুলো আমার খুব একটা দরকারী নয়। ওকে কিছু না বলে আবার সেগুলো যথাস্থানে রাখি। কারণ, ওর তো জানার কথা নয়, এই বইগুলো শুধু আমার কাছে বই নয়। এটুকুই আমার সংস্কৃতি। স্কুল বোর্ডিং, মিশন বোর্ডিং, হোস্টেল, হল হয়ে ভাড়া বাড়িতে বা ফ্ল্যাটে ঢোকার আগের জীবনের ওইটুকুই শুধু আমার সংস্কৃতির সম্বল হিসেবে এখনও আছে- যার সঙ্গে একটি অনেক মানুষের পরিবার, অনেক উৎসবে ঘেরা দিন জুড়ে আছে। আজও যেমন কোরিয়ান ডেভেলপমেন্ট, ভিয়েতনাম ডেভেলপমেন্ট এসবে চোখ বোলানোর পরেও দিন শেষে মুক্তি খুঁজি রবীন্দ্রনাথে- শিশু বেলাতেও পড়াতে আনন্দ আর মুক্তি এনে দিয়েছিলো রবীন্দ্রনাথের “সহজপাঠ” । শুধু ঝুল বারান্দা নয়, পুকুর ঘাটে বসেও গলা ছেড়ে বলতাম,
“ গগনে গগনে বরষন- শেষে
মেঘেরা পেয়েছে ছাড়া-
বাতাসে বাতাসে ফেরে ভেসে ভেসে ,
নাই কোনো কাজে তাড়া।
……………..
যে দিকে তাকাই সোনার আলোয়
দেখি যে ছুটির ছবি-
পূজার ফুলের বনে ওঠে ওই
পূজার দিনের রবি” ।
না এখন আর পূজার ছুটি নেই, আমলকির পাতাও ঝরে না। পূজার দিনের সূর্য সেদিনের মতো ওঠে কিনা তাও বলা কঠিন।
তারপরেও দুর্গাপূজা বা শক্তিপূজা বাঙালি হিন্দুর জীবনের আনন্দ হোক আর সংস্কৃতি হোক জড়িয়ে আছে দীর্ঘকাল ধরে। রামমোহন ব্রাহ্ম ছিলেন। মূর্তি পূজা না করলেও চলে এটা তিনি বিশ্বাস করতেন। তারপরেও তিনি মৃন্ময়ীকে মূল্য দিতে ভোলেননি। তার উদ্যোগেই দুই হাজারের বেশি দুর্গা পূজা হতো কলকাতায়।
আর এই তো মাত্র কিছুদিন আগেও অর্থাত সর্বজনীন বা ক্লাবের পূজো শুরু হবার আগেও বাড়িতে মণ্ডপে বা নাটমন্দিরে ঠিকই লগ্ন অনুযায়ী অধিষ্ঠান হতো দেবী দুর্গার।
ছোট বেলা থেকে আজ অবধি ঠিক বুঝতে পারিনা বাঙালি হিন্দু এই ছোট খাট শরীর নিয়ে শক্তির পূজো কেনো বেশি করে। যে লক্ষ্মী ধন দেয়। সেই লক্ষ্মীকে নিয়ে বাঙালি হিন্দুর কিন্তু খুব বেশি আড়ম্বর নেই। ওটা ঘরের লক্ষ্মীরা আলপনা এঁকেই দেবী লক্ষ্মীকে ঘরে তুলে নেয়। পুরুষের যেনো সেদিকে খেয়ালই নেই। অথচ কালী বা দুর্গা এই দুই শক্তিকে নিয়েই তার যত রব।
আবার ভাবি ক্ষুদ্রকায় বাঙালি শক্তির পূজা করে বলেই হয়তো, এক ক্ষুদ্রকায় স্কুল শিক্ষক- মাস্টার দা সূর্য সেন হয়েছিলেন। এই বাঙালি হিন্দু ঘরের ছেলে সুভাষ বোস তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে, সাত সাগরের তল পেরিয়ে গিয়েছিলো স্বাধীনতার জীয়নকাঠি খুঁজতে। এমনকি ধর্ম ভুলে বাঙালির ছেলে শেখ মুজিবের ডাকে বাঙালি হিন্দু ছেলেরা গিয়েছিলো স্বাধীনতার সূর্যটা আনতে। মনে হয় এই তো সেদিনও যেন দেখেছি চট্টগ্রামের রমা কাকিমা খালি পায়ে হাতে বই নিয়ে ঘুরতেন। জুতো পরতেন না তিনি- শুনেছি, ২০০৯ এর দিকে সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি কেন তার স্বামী ও সন্তানের জন্যে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা নেন না, জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেন তিনি খালি পায়ে চলেন। রমা কাকিমা উত্তর দিয়েছিলেন, আমার স্বামী ও সন্তান তো এই দেশের জন্য জীবন দিয়েছে, তাদের জীবনদানের মূল্য তো তারা পেয়েছে “স্বাধীনতা” । এরপরে ভাতা কেন? আর জুতো তিনি পরবেন কীভাবে? যে মাটিতে মিশে আছে তার স্বামী ও সন্তানের রক্ত। সে মাটির ওপর দিয়ে তিনি তো জুতো পরে চলতে পারবেন না।
এমনি রুমির মায়ের মতো, জাহিদের মায়ের মতো কত রমা কাকিমা, গুরুদাসীর স্বামী ও ছেলের রক্ত মিশে আছে এ মাটিতে। কত কত লাখ লাখ – কেউ সত্যি অর্থে শ্রদ্ধা জানালো না।
যে সব ছেলেরা কবিতা লিখতো, সাহিত্য ভালোবাসতো- ছোট ভাই বা অনেকটা সন্তানের মতো ভালোবেসেছি। নিজ থেকে ফোন করে তাদের সঙ্গে বয়সের বাধা পেরিয়ে অনেক কথা বলেছি- তারাও যখন বলে ৭১ এ নিহতরে সংখ্যা ২০০০ হবে না। তখন মনে হয় মহাকবি বাল্মীকির সীতার মতো আমরাও বলি, ধরনী দ্বিধা হও। তোমার বুকের মধ্যে গলিত লাভা থাকলেও নিয়ে নেও। সে লাভাও এর থেকে অনেক অনেক সহনীয়।
এদের কেউ কেউ জানে, পাকিস্তানি ও তাদের এদেশীয় দোসরদের ধর্ষণের ফলে বাঙালি মা বোনের গর্ভে জন্ম নেয়া যুদ্ধ শিশুরা বিদেশে আছে। দেশে এর কোনো পরম্পরা আছে কিনা তা কেউ নির্ণয় করেনি। সেটা না করাই ভালো। তবে কেউ কি জানে ভারতের কত মন্দিরে কত বোন ছিলো যারা ৭১ এ সর্বস্ব হারিয়ে নিজ পরিবারে স্থান নিতে না পেরে নীরবে ওই মন্দিরে চোখের জল ফেলে সেখানে জীবন শেষ করে দিয়েছে বা আজও বার্ধক্য নিয়ে সেখানে বেঁচে আছে।
এই হিন্দুরা এ মুহূর্তের বাংলাদেশে শুধু সংখ্যালঘু নয়। তারা অচ্যুত। কেন তাদের অচ্যুত বলতে বাধ্য হচ্ছি- কারণ, ৫ আগস্টের পর থেকে এ দেশে তাদের আর কোনো রাজনৈতিক অধিকার নেই। তাদের ওপর যা ঘটছে তা তাদের অতীত রাজনৈতিক সমর্থনের কারণেই নাকি। এর পরে তো আর বলা যায় না তাদের রাজনৈতিক অধিকার আছে। আর আধুনিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক অধিকার না থাকলে তাদের সংস্কৃতিও ধীরে ধীরে মুছে যায়।
পৃথিবীর সব দেশেই সংখ্যালঘু আছে। পৃথিবীর শিক্ষাহীনতা- এই ধর্ম, বর্ণ, গোত্রীয়, ভাষা কেন্দ্রিক এমনি নানান সংখ্যালঘু সৃষ্টি করেছে। ধর্মের কারণে বাংলাদেশে যারা সংখ্যাগুরু সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গেলে দেখা যায় ওই ধর্মের মানুষই সংখ্যালঘু। পার্থক্য এখন এখানেই, ওখানে ফিরহাদ হাকিম থেকে শুরু করে ক্যানিং এর সাধারণ কাঠের দোকানদার লিয়াকত মোল্লার যে রাজনৈতিক অধিকার আছে- ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশের হিন্দুদের সেটা নেই। ফিরহাদ হাকিম তো ডেপুটি মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমতা রাখেন। তিনি কাঁপিয়ে দিতে পারেন পশ্চিমবঙ্গ। এমনকি ক্যানিং এর লিয়াকত মোল্লাও আমাকে ২০২৪ এর মার্চে বলেছে, মামা আমরা এখনও সেই ৭১ সালের মতো কংগ্রেস করি। তৃণমূল এখন আছে, কাল যদি বিজেপি আসে আমাদের কিছু যায় আসে না – আব্বা যেমন কংগ্রেস করতেন আমরা কংগ্রেস করি এখনও । আর বড় চাচার ছেলেরা এখনও তার বাপের মতো সিপিএম করে।
বাংলাদেশে ৫ তারিখ সরকার পরিবর্তনের পরে ৮ তারিখ যখন ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অনেক এনজিও ব্যক্তিদের নিয়ে সরকার গঠিত হয় সে সময়ে অনেকের মতো আমারও এনজিও ব্যক্তিদের নিয়ে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিলো। কারণ এ সত্য মানতে হবে, এনজিও ব্যক্তিত্বদের মধ্যে স্যার ফজলে হাসান আবেদ ছাড়া বাদবাকি সবাইকে নিয়ে সমাজের প্রতিক্রিয়া মিশ্র। ফজলে হাসান আবেদকে তার পারিবারিক ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধের পর ত্রাণ ও পুনর্বাসন করতে গিয়ে বেগম সুফিয়া কামালকে নিয়ে গড়ে তোলা এই ব্র্যাক বা যুদ্ধ বিধ্বস্তদের জন্য পুনর্বাসন সহায়ক সমিতি, পরবর্তীতে ওরস্যালাইন চালুর কাজ করা, প্রাথমিক শিক্ষা আবার আড়ং এর মতো বাংলা ও বাঙালিকে প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করায় তাঁর অবস্থান ভিন্ন স্থানে। বাদবাকীদের নিয়ে এটাই এ সমাজে সত্য- প্রতিক্রিয়া মিশ্র।
তারপরেও ড. ইউনূস দীর্ঘদিন পশ্চিমা উদার গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে জড়িত। এমনকি আমেরিকার দু’জন প্রেসিডেন্ট তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ। ক্লিন্টন ও ওবামা। তবে একজন ক্ষুদ্র সাংবাদিক হলেও এই দু’জন প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে আমার কখনও উঁচু ধারণা নয়। ইতিহাসের শেষ বিচারে ক্লিন্টনকে চিনবে ভিন্ন শ্রেণীর মানুষ মনিকা লুইনস্কির জন্য। আর বারাক ওবামাকে চিনবে গাদ্দাফীকে হত্যার জন্য। তাছাড়া পশ্চিমাদের মানবাধিকারের সংজ্ঞা আটলান্টিকের ওপারের জন্য এক, এপারের জন্য আরেক। সে অভিজ্ঞতা ১৯৭১ সালে শরণার্থী শিবিরে বসেই আমাদের হয়েছে। তারপরেও ৮ আগস্ট ২০২৪ অবধি ড. ইউনূসের ওপর সংখ্যালঘুদের বিষয় একটা ভিন্ন আস্থা ছিলো। যে কারণে তারা শপথ নেবার পরদিনই ড. আসিফ নজরুলকে সংখ্যালঘুদের বিষয়টা টেক কেয়ার করার অনুরোধ জানিয়ে একটা এসএমএস করেছিলাম। উত্তর না দিলেও সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেটা দেখেন। এক সাংবাদিক ছোট ভাইয়ের মাধ্যমে ওই সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত সাহেবের সঙ্গে দেখা করার একটা উদ্যোগ নিতেই- দেখি ভদ্রলোকও সে পদ থেকে অন্য পদে চলে যান।
তারপরে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। এখন বিষয়টি পরিষ্কার যে, এই সরকারের আমলে এ দেশে হিন্দুরা স্বাধীন রাজনৈতিক অধিকার পাবে না। মুখে না বললেও এটাই এখন সত্য। এ বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। মেনে নিতে হবে আগস্ট ২০২৫ এ যেমন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী সংখ্যালঘু কেন্দ্রিক ১০ টি হামলা হয়েছে। তার ভেতর দুটো প্রতিমা ভাঙচুরও আছে। এটাই এখন চলমান নিয়তি এদেশের হিন্দুদের।
তবে তারপরেও শরৎ এসেছে। আমলকি গাছ হয়তো কোনো গ্রামে কোথাও আছে। সেখানে তার পাতা ঝরার কাঁপুনি লেগেছে। আর মাত্র দুই সপ্তাহের কিছু বেশি সময় পরেই দুর্গা পূজা। এ পূজার রঙ এ আকাশে দেখা যাবে না। তবুও পূজা! আর এই পূজার মাসেই আবেদন করা হয়েছে চিম্ময় দাসের ( চিম্ময় প্রভু) নামে হত্যা মামলাসহ আর যে পাঁচটি মামলা করা হয়েছে তার জামিনের জন্য। বিষয়টি সম্মানিত আদালতে। তাই এ নিয়ে কিছু বলার নেই।
হঠাৎই রবীন্দ্রনাথের সহজ পাঠ এভাবে সেলফ থেকে নেমে আসায় কেবলই মনের পর্দায় ভেসে উঠছে পূজার রঙ, উৎসবের রঙ। সঙ্গে সঙ্গে বিষণ্ণতা গ্রাস করছে, চিম্ময়ের এ পূজাও কি জেলে কাটবে? আর চিম্ময়কে জেলে রেখে বাংলাদেশের হিন্দু তরুণরা কতটা উৎসব করতে পারবে পূজা ঘিরে। না কি সকলেরই চোখে নেমে আসবে জেলে বসে থাকা চিম্ময়ের উদাস দৃষ্টি।
লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.