কোন দেশের পররাষ্ট্রনীতি নির্ভর করে ওই দেশের সরকারের স্থিতিশীলতা, জাতীয় ঐক্য, এবং তার সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক নীতি ও সরকারের সেটা বাস্তবায়নের যোগ্যতার ওপর।
অন্য একটি দেশের সঙ্গে ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক তখনই শক্তিশালী, বন্ধুত্বপূর্ণ বা স্ট্র্যাটেজিক হয় যখন নিজ দেশের সরকার শক্তিশালী ও জনগণ ওই সরকারের প্রতি ঐক্যবদ্ধ হয়।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকার যে দুর্বল সরকার তা যেমন দৃশ্যমান তেমনি সরকারের উপদেষ্টারাও বলছেন- ১০ আগস্ট ২০২৫ দেশের একটি বিশিষ্ট থিঙ্ক ট্যাঙ্কের আলোচনা সভায় সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, সরকারের সব কাঠামো ভেঙে পড়েছে। যা এখনও পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়নি।
অন্যদিকে বর্তমান সরকার দ্রুত দেশে নির্বাচন দিতে সমর্থ হবে কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়। তাছাড়া সরকার এখনও অবধি যেভাবে যে রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে নির্বাচন করতে চাচ্ছে তাতে খুব ভালো নির্বাচন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ, রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক দলের অর্থাৎ আওয়ামী লীগের সরকারের পতন ঘটিয়ে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে ওই আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক ত্রুটি ছিলো ঠিকই -তবে তাদের উন্নয়ন ও জনকল্যাণমূলক কাজ শুধু নয়, দলটি একটি ঐতিহাসিক দল, এই দলটির রাজনীতির ভেতর দিয়ে, তাদের দলের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে সরকার গঠনের ভেতর দিয়ে এবং সেই সরকারের অধীনে সশস্ত্র সংগ্রাম করে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগ যদিও পতনের আগে অনেক বেশি মৌলবাদী তুষ্ট করার নীতি গ্রহণ করেছিলো- তারপরেও যে নীতিতে অর্থাৎ বাঙালি সংস্কৃতি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের নীতিতে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিলো, এই বাঙালি সংস্কৃতি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের সফট পাওয়ার ও এই পাওয়ারের সপক্ষ শক্তি বাংলাদেশের একটি অনেক বড় শক্তি। বর্তমান ইন্টারিম সরকার এই শক্তিকে অনেকখানি তার শত্রুতে পরিণত করেছে। কারণ, এই সরকারকে সেন্টার-রাইট রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সমর্থন করছে এছাড়া জামায়াতে ইসলামী, হিযবুত তাহরির, হেফাজতের মত ধর্মীয় মৌলবাদী দলগুলো এই সরকারের ঘনিষ্ঠ। আবার এ সরকার যে কিংস পার্টি গড়তে চেষ্টা করছে গত বছরের জুলাই আন্দোলনের কিছু ছাত্র নেতা দিয়ে তারাও মূলত ওই কট্টর ধর্মীয় মৌলবাদী দলগুলোর কাছাকাছি বা তাদের থেকে উৎপত্তি।
তাই বাঙালি সংস্কৃতি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী নির্ভর শক্তিকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশে যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার চেষ্টা এখন দেখা যাচ্ছে, তা যেমন ইনক্লুসিভ হবে না তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ এই নির্বাচনের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে বর্তমান যে অস্থিতিশীল ও ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনৈতিক চরিত্র আছে তার কোনো পরিবর্তন হবে না। কারণ, ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তিই ক্ষমতাশালী শুধু নয়, অবাধে তাদের কাজ চালিয়ে যাওয়ার অধিকার পাবে। দেশের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় চরিত্র বদলে যাবে- আর এ পরিবর্তনের পরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে কতটা গ্রহণযোগ্য রাখবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
এ বাস্তবতা শুধু যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের মানুষ বুঝতে পারছে তা নয়, পৃথিবীর যে সকল দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে জড়িত তারাও বুঝতে পারছে।
এ অবস্থায় বাংলাদেশে বর্তমান সরকার যে ধরনের নির্বাচন করতে চাচ্ছে ওই নির্বাচন যদি অনুষ্ঠিত হয় তাহলেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বর্তমানে যা আছে তার থেকে খুব বেশি পরিবর্তন হবে- তা বলা ঠিক হবে না। কারণ, ওই নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার আসবে সেখানে বর্তমানে যে সরকার আছে তার সঙ্গে গুণগত খুব কোনো পরিবর্তন হবে না।
যেমন বাংলাদেশের বর্তমান এই সরকার দায়িত্বগ্রহণ করার পর থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিদিন খারাপ হচ্ছে। এবং পারস্পরিক বাণিজ্য বন্ধের একের পর এক উদ্যোগ দেখা গেছে।
ভারত সরকারের প্রধানের সঙ্গে বাংলাদেশের ইন্টারিম সরকার প্রধান মুহাম্মদ ইউনুস ব্যাংককে অনুষ্ঠিত বিমস্টেক সম্মেলনের সময় একটি লবি বৈঠক করেন। এছাড়া ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মি. তৌহিদ হোসেন দুটি সম্মেলনে সাইড লাইন বৈঠক করেন।
গত এক বছরে এটাই মূলত দৃশ্যত দুই দেশের সরাসরি যোগাযোগ। এছাড়া মুহাম্মদ ইউনুস ক্ষমতা গ্রহণের পরে ভারতের সরকার প্রধান তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছিলেন।
থাইল্যান্ডে বিমস্টেক বৈঠকের পরে হোটেলের লবিতে ভারতের সরকার প্রধানের সঙ্গে বাংলাদেশের ইন্টারিম সরকার প্রধানের দেখা হওয়ার পরে দুই দেশের প্রেস ব্রিফিং দুই ধরনের ছিলো। যা কূটনীতিতে বা পররাষ্ট্রনীতিতে ভালো কোনো ইঙ্গিত দেয় না।
এর আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশ সফরের সময় এককভাবে প্রেস ব্রিফিং করে- সে ব্রিফিংয়ের মূল বক্তব্য ছিলো, ভারত বর্তমান সরকারের সঙ্গে দৈনন্দিন কাজ করে যাবে এবং ইনক্লুসিভ নির্বাচনের ভেতর দিয়ে যে সরকার আসবে ওই সরকারের সঙ্গে তারা প্রকৃতভাবে যুক্ত হবে। এছাড়া তারা ওই প্রেস ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর ( হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও আদিবাসী) যে নির্যাতন হচ্ছে তা বন্ধ করা ও বিচারের আওতায় আনার জন্যে বাংলাদেশ সরকারকে বলা হয়েছে বলে বলা হয়।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের ওই বক্তব্যের পরে ওই দিনই বাংলাদেশ সরকারের একজন উপদেষ্টা সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান এক প্রেস ব্রিফিং একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক হামলার কথা বলেন, যা সংখ্যালঘুদের ওপর হয়েছে। এবং সেগুলো পুলিশ তদন্ত করছে বলে জানান। যদিও সে তদন্তের পরেও বাংলাদেশ সরকার আগেও যে অবস্থানে ছিলো তদন্ত-পরবর্তী সে অবস্থানকে আরো দৃঢ় করে- অর্থাৎ সংখ্যালঘুদের ওপর যে অত্যাচার চলছে এটা সাম্প্রদায়িক নয়, রাজনৈতিক বিবেচনায়। যেহেতু তারা বিগত সরকারের সমর্থক বা ভোটার।
বাংলাদেশ এ ধরনের একটি নীতি গ্রহনের পর শেষ অবধি শুধু ভারত নয় যে সকল দেশ মানবাধিকারে পক্ষে তারা কী অবস্থান নেবে সে বিষয়টি অবশ্য এখনও পরিষ্কার হয়নি। তাছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মাইনরিটির অধিকারের বিষয়টি অনেক বেশি অবহেলিত, তাই এ বিষয়টি কখনই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়নি। এমনকি আন্তর্জাতিক সংস্থা জাতিসংঘ অন্যদেশের মাইনরিটি নির্যাতন ও তাদের সমস্যা নিয়ে যতটা গুরুত্ব দেয় বাংলাদেশের মাইনরিটির সমস্যা নিয়ে সে হিসেবে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দেয় না। তাই পররাষ্ট্রনীতিতে এ বিষয়টি খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারবে না যতক্ষণ না আন্তর্জাতিক সংস্থা ও পশ্চিমা দেশগুলো বাস্তবতাকে স্বীকার করবে।
অন্যদিকে বাংলাদেশে চলমান ছিলো এমন বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে ভারত নিজেকে প্রত্যাহার করেছে। এবং নতুন কোনো অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এই সরকারের আমলে ভারত শুরু করেনি। বাংলাদেশ থেকেও দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি সেগুলোকে ফিরিয়ে আনার বা কাজ চালু রাখার। বরং ভারত যেমন বাংলাদেশ থেকে তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রত্যাহার করছে তেমনি বাংলাদেশও ভারত থেকে ল্যান্ড বর্ডার দিয়ে যে সুতো আনা হতো সেই সুতো কেনা বন্ধ করেছে। ভারতও পাল্টা অনেকগুলো পণ্য ল্যান্ড বর্ডার দিয়ে ভারতে ঢোকা বন্ধ করে দিয়েছে। সর্বশেষ জুট গুডসও ঢোকা বন্ধ করে দিয়েছে। যা বাংলাদেশের ব্যবসা বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের জুট শিল্পের ওপর একটি বড় আঘাত।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, ভারত থেকে সুতো না আনার ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ শিল্প লাভবান হবে। এর বিপরীতে বাংলাদেশে ল্যান্ড বর্ডার দিয়ে বেশ কিছু পণ্য ভারতে ঢোকা বন্ধ করার ফলে ভারতের লাভ না লোকসান হলো তা নিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কোনো কথা বলেনি। ভারতের বিমানবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশের গার্মেন্টস সহ অন্যান্য পণ্য রপ্তানির যে সুযোগ ভারত বাংলাদেশকে দিতো এটা বন্ধ করার পরে বাংলাদেশ সরকার কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি শুধু পাল্টা কিছু বাণিজ্য প্রতিক্রিয়া জানায়, তবে ব্যবসায়ীরা তাদের নিজস্ব আলোচনায় বলেছেন, এ সুযোগ হারানো তাদের জন্যে বড় ধরনের ক্ষতিকর হয়েছে।
এর পাশাপাশি বাংলাদেশের সব ধরনের ভিসা দেওয়া সংকুচিত করেছে ভারত। এমনকি এর ফলে অনেকগুলো দেশ যারা তাদের মূল দূতাবাস ভারতের নয়াদিল্লিতে রাখে এবং সেখান থেকেই বাংলাদেশিদের ভিসা নিতে হয়- তা নিয়ে বেশ অসুবিধা হয়। এই অসুবিধা সৃষ্টির পরে বাংলাদেশের ইন্টারিম সরকার প্রধান ওই সকল দেশের বাংলাদেশে যে অফিস আছে তাদের প্রধানদের ডেকেছিলেন, এবং ভারতে যারা আছেন তাদেরও এখানে আসার জন্য আহ্বান করেছিলেন, তারা যাতে মূল অফিস বাংলাদেশেও চালু করে। কিন্তু এখনও অবধি তা ঘটেনি।
অন্যদিকে ভারত কেন ভিসা দেওয়া সংকুচিত করেছে তা নিয়ে তারা কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। তবে শুরুতে ভারত বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সংকুচিত করলেও এখন দেখা যাচ্ছে শুধু ভারত নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশ, মধ্যপ্রাচ্যের অনেকগুলো দেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভিসা অর্থাৎ শেঙ্গেন ভিসা- সর্বোপরি মার্কিন ভিসাও সংকুচিত হয়েছে। এমনকি ভারতের পরে বাংলাদেশের টুরিস্ট ও রোগীদের জন্যে যে পরবর্তী গন্তব্য ছিলো থাইল্যান্ড এবং থাইল্যান্ডের ভিসা পাওয়া বাংলাদেশের জন্য এতদিন খুবই সহজ ছিলো । এখন তা বেশ জটিল ও সংখ্যায় অনেক কমে এসেছে। আগে যে ভিসা ৩ কর্মদিবসে পাওয়া যেতো এখন সেটা পেতে যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হয়। সংখ্যায়ও অনেক কম ভিসা পাওয়া যায়।
কেন বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ভিসা পাওয়ার অধিকার এভাবে অনেকগুলো দেশ সংকুচিত করে দিলো তা ওই দেশগুলো এখনও কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়নি। এমনকি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। মিডিয়াতে বিষয়টি বার বার রিপোর্ট হওয়ার পরেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ নিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে কিছু বলা হয়নি ।
তবে কোনো দেশের মানুষের অন্যদেশের ভিসা পাওয়ার অধিকার যখন সংকুচিত হয় সে সময়ে ধরে নেয়া হয় ওই দেশের পররাষ্ট্রনীতি বা দেশের অভ্যন্তরীণ নীতি নিয়ে অন্যান্য দেশের ভেতর কোনো না কোনো কারণে একটি উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে তারা এই ভিসা দেওয়া সংকুচিত করেছে। আর মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি ৩৬ জন জঙ্গি ধরা পড়ার পরে ভিসা সংকোচনের একটি কারণ মানুষের মনে উঁকি দেয়।
বাংলাদেশকে ভারত ছাড়া অন্য যে দেশগুলো ভিসা দেওয়া সংকুচিত করেছে তারা অবশ্য এ নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়নি। এমনকি ভারত যে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয় সেখানেও তারা বলে ভিসা নীতি আগের মতোই রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এবং বাস্তবতা থেকে বের হয়ে আসার কোনো উদ্যোগ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দৃশ্যমান নয়।
তাছাড়া এটাও সত্য বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক যে মাপের শীতল এমন শীতল সম্পর্ক ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কখনও হয়নি। এর আগে ভারত অভিযোগ করেছে, বাংলাদেশের ভেতর ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, পরবর্তীতে তা সত্যও প্রমাণিত হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ অভিযোগ করেছে ভারত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, আশ্রয় দিচ্ছে, ১৯৭৫-পরবর্তী একটা সময়ে আওয়ামী লীগের তরুণদের সশস্ত্র ট্রেনিং দিয়েছিলো বলে অভিযোগ করাও হয়েছিলো বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। এবং তারা কেউ কেউ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কিছু হামলাও করেছিলো তাও সত্যে পরিণত হয়। আবার বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ভারতের আসাম, ত্রিপুরা ও অন্যান্য রাজ্যে হামলা চালাতো তাও পরবর্তীতে স্পষ্ট হয়। কিন্তু তারপরেও দুই দেশের বাণিজ্য ও কূটনীতিক এবং সরকার প্রধান পর্যায়ে সম্পর্ক এমন শীতল হয়নি, যা বর্তমানে। এমনকি জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদ নির্বাচিত সরকার হওয়ার আগেও দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় সফর ও সর্বোচ্চ পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় সফর হয়েছে।
বর্তমান সরকারের আমলে কর্মকর্তা পর্যায়ে রুটিন মিটিং ছাড়া কোনোরূপ রাষ্ট্রীয় সফর কোনো পর্যায়ে হয়নি। নীতি নির্ধারক পর্যায়ে কোনো সফর হয়নি গত এক বছরে।
এ ক্ষেত্রে দুই দেশের সমস্যা কোথায় সেটা কেউ বলছে না। তবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে যা সামনে আসছে তাহলো, ভারত তার ইন্টারনাল সিকিউরিটি নিয়ে উদ্বিগ্ন। এবং তাদের মিডিয়া সহ নানান থিঙ্ক ট্যাঙ্কের বক্তব্য, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার অনেক বেশি মৌলবাদীদের দ্বারা পরিচালিত এবং তারা ভারত বিরোধী।
অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দেওয়া এবং সেখানে বসে তাঁর নিজস্ব সোশ্যাল ফোরাম ব্যবহার করে বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে কথা বলা বা রাজনীতি করা বাংলাদেশ পছন্দ করে না। এটা ভারতকে বন্ধ করতে হবে। তাছাড়া শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড নির্বাহী আদেশে বাংলাদেশ সরকার বন্ধ করেছে।
ভারতই একমাত্র দেশ যাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করাকে অযৌক্তিক ও সঠিক নয় বলে জানিয়েছে। অন্যদিকে ভারতের সরকার প্রধান বাংলাদেশের ইন্টারিম সরকার প্রধানকে জানিয়েছে, ভারত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সেখানে কাউকে তাঁর নিজস্ব সোশ্যাল মিডিয়া বা ফোরাম ব্যবহার করে তার ব্যক্তিগত কাজে বাধা দেওয়ার মতো মৌলিক অধিকার হরণ করার ক্ষমতা সে দেশের সরকারের নেই।
এছাড়া বাংলাদেশে যেহেতু শেখ হাসিনার বিচার শুরু হয়েছে সে কারণে বাংলাদেশ সরকার বার বার বলছে, ভারত সরকারের উচিত তাকে ফিরিয়ে দেওয়া। বাস্তবে বাংলাদেশ সরকার কতটা আনুষ্ঠানিকভাবে শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়েছে তা দুই দেশ খুব বেশি তথ্য প্রকাশ করেনি। যার ফলে বিষয়টি নিয়ে একটা ধোঁয়াশা আছে।
অন্যদিকে ভারতে সর্বদলীয় সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তারা শেখ হাসিনাকে সম্মানিত অতিথি হিসেবে আশ্রয় দিয়েছে।
তবে এ ধরনের একটি বা দুটি ঘটনা যে দুই দেশের সম্পর্কের এ ধরনের অবনতির কারণ হতে পারে তা কিন্তু কোনো মতেই আন্তর্জাতিক কূটনীতি কেন, বাংলাদেশের কূটনীতিতেও এর আগে ঘটেনি।
বাংলাদেশের রীতি হলো, যেহেতু এখানে স্বাভাবিকভাবে সরকার পরিবর্তন হয় না- রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমে না হয় সামরিক অভ্যূত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হয়। তাই স্বাভাবিকই রাজপথে বিজয়ীরা পূর্ববর্তী সরকারের প্রতি সদয় থাকে না, তাদেরকে আদালতের কাঠগড়ায় তোলে। বা অন্য রকম অত্যাচারও করে। বর্তমান সরকারেরও তার বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, যদিও তারা প্রথমে তাদের রাজপথের বিজয়কে একটা বিপ্লব বলার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু বিপ্লবের যে আদর্শ, কর্মসূচি ও প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক অবস্থানের প্রয়োজন হয়- তা না থাকায় সরকারকে এখন যারা রাজপথে বিভিন্নভাবে অবস্থান নিয়েছিলো তাদের ভবিষ্যত নিরাপত্তা ও নিজ সরকারের একটা গ্রহণযোগ্যতার জন্য পূর্ববর্তী সরকারের বিচার ও ক্রটিগুলো খুঁজে বের করার কাজে হাত দিয়েছে। এটা মূলত বাংলাদেশে কম বেশি একটা রাজনৈতিক কালচার। এর আগের সরকারও তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মূল নেতা থেকে শুরু করে অনেক নেতার বিচার করেছিল বা বিচার প্রক্রিয়ায় রেখেছিলো। যার ভেতর লন্ডনে অবস্থিত বিএনপির নেতা তারেক রহমানও ছিলো।
তারেক রহমানকে ব্রিটেনে রাষ্ট্রীয়ভাবে আশ্রয় দেওয়া হয়নি যেমনটি ভারত শেখ হাসিনাকে দিয়েছে। তারপরেও তারেক রহমানের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে আগের সরকার ব্রিটেনকে দোষারোপ করেনি এবং ব্রিটেনের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের কোনো ঘাটতি হয়নি। তাই শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়া নিয়ে ভারত- বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষতি হয়েছে- এ যুক্তি কূটনীতির ক্ষেত্রে খুব একটা গ্রহণযোগ্য নয়।
এজন্য স্বাভাবিকই প্রশ্ন আসে, বাংলাদেশের আগের সরকার শুধু ভারতের বন্ধু সরকার ছিলো বলে নয়, আবার ভারত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে বলেও নয়- অভ্যন্তরে আরো কোনো একটা জটিল বিষয় আছে যা দুই দেশের সম্পর্ককে এমন শীতল অবস্থায় নিয়ে এসেছে। কারণ শেখ মুজিব সরকার ভারতের বন্ধু সরকার ছিলো- তার পতনের পরে জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার দ্রুত দেশে স্থিতিশীলতা আনার পরে তাঁর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অনেকখানি স্বাভাবিক হয়। আর শেখ হাসিনা দিল্লিতে থাকার ফলে যে দুই দেশের সম্পর্ক খারাপ হবে এ যুক্তি টেকে না। কারণ, তারেক রহমান লন্ডনে থাকায় শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে ব্রিটেনের সম্পর্ক শীতল হয়নি বরং অনেক বেশি উষ্ণ ছিলো- তাই শেখ হাসিনার দিল্লি থাকা বড় কারণ নয়- দুই দেশের এই এ যাবতকালের শীতলতম সম্পর্ক হওয়া।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যেহেতু বলা হচ্ছে তারা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করেছিলো কিন্তু হয়নি। তাহলে এখানে কোনো গবেষক বা বিশ্লেষক কি খুঁজবে ইতিপূর্বে বাংলাদেশে রাজপথের আন্দোলনে সরকার পরিবর্তন হলেও দেশে স্থিতিশীলতা ছিলো, রাজপথে মৌলবাদীরা নামেনি, সর্বোপরি কোনো সরকার জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কমিশনের লোকাল অফিস খুলে দেশকে গাজা বা সুদানের পর্যায়ে নিয়ে যায়নি- এটাই কি মূল কারণ? কারণ যে প্রতিবেশী দেশ অস্থিতিশীল রাজনৈতিক ও মৌলবাদী মবের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে নাজুক অবস্থায় আছে , যার গায়ে ইউএন এর লোকাল অফিসের ছাপ- তার থেকে কি নিরাপদ দূরত্বে থাকছে অন্য প্রতিবেশীরা?
অনেকে বলছে ভারত ও বাংলাদেশের এই দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ নিয়ে চায়না বাংলাদেশে তাদের অবস্থান দৃঢ় করার সুযোগ নিচ্ছে। চায়না বাংলাদেশের মৌলবাদী দলগুলোর নেতাদেরও তাদের দেশে ইতোমধ্যে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সেন্টার রাইট বা আগে বেশ কয়েকবার ক্ষমতায় থাকা দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকেও বেশ কয়েকবার গত এক বছরে তাদের দেশে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও তারা বিভিন্ন মৌলবাদী রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলছে। এমনকি ভারত বাংলাদেশের জন্যে চিকিৎসা ভিসা সংকুচিত করে দিলে চায়না তাদের কুনমিং-এ বাংলাদেশিদের জন্যে চিকিৎসার বিকল্প অবস্থান খোলার চেষ্টা করেছে। সেটা যেহেতু বাংলাদেশের নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত যারা বেশিরভাগ ভারতে যায় তাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে তাই বিষয়টি অনেকটা উদ্যোগের মধ্যে থেকে গেছে।
তবে ইতোমধ্যে চীনও যেমন একটি রেল সেতু প্রকল্প থেকে তাদের অর্থ প্রত্যাহার করেছে তেমনি চীন কোনো দৃশ্যমান বিনিয়োগ করেনি। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে তারা একটি হাসপাতাল করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এটা কিছুটা আগের পরিকল্পনা। কারণ ওই এলাকায় চায়না তাদের একটি শিল্প এলাকা গড়েছে। সেখানে তাদের দেশের অনেক শ্রমিক ও কর্মকর্তারা থাকে। একটি চাইনিজ ডাক্তার ও চিকিৎসা ব্যবস্থা পরিচালিত হাসপাতাল তাদের জন্য সেখানে প্রয়োজন।
এছাড়া একটি বেসরকারি ফোরামে গিয়ে চায়নার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মুহাম্মদ ইউনুস দেখা করলেও দৃশ্যত চায়নার যে বাংলাদেশ নীতি অর্থাৎ তাদের সুদহারে বাংলাদেশে অর্থ বিনিয়োগ তা গত এক বছরে দৃশ্যমান হয়নি। এ ক্ষেত্রে চায়না অন্যান্য দেশ যেমন বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে “ওয়েট অ্যান্ড সি পলিসি” গ্রহণ করেছে- তারাও সে পথে সেই ইঙ্গিত মেলে।
এখানে স্মরণ করা যেতে পারে আফগানিস্তানে তালেবান রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করলে তালেবান প্রতিনিধিদের সঙ্গে চায়নারই প্রথম আলোচনা হয়। কিন্তু তারা সেখানে কপার খনিতে পুনরায় ফিরে যাচ্ছে এমন একটা সময়ে যে সময়ে ভারতের মতো দেশও আফগান তালেবানদের সঙ্গে কথা বলছে।
আরো একটি ধারণা সামনে আসছে, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য সহ অনেক মৌলবাদ কবলিত দেশে চায়নার অনেক বিনিয়োগের অবস্থা সুখকর নয়। তেমনি তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ নিয়ে তালেবান-কবলিত আফগানিস্তানকে নিয়ে অভিজ্ঞতা ভালো নয়। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকার চায়নার সঙ্গে প্রথম বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ চুক্তি করে। আর সেটা করেছিলো এমন একটা সময়ে যখন বাংলাদেশ সরকার মৌলবাদীদের দমন করে একটি স্বাভাবিক স্থিতিশীল অবস্থান তৈরি করেছিলো।
পাকিস্তানের সঙ্গে চায়নার বন্ধুত্ব হলেও পাকিস্তানের ক্ষমতা পরিবর্তনের জন্যে আমেরিকা যে সেদেশের সামরিক বাহিনী প্রধানকে উসকে দিচ্ছে এ বিষয়ে চায়নার সামনে দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আসে। পাকিস্তানের সব থেকে পপুলার নেতা ইমরান খান অনেক বেশি চায়নার পক্ষে তবে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান তার পক্ষে নয়। আমেরিকা সেই সেনাপ্রধানকে বেছে নিয়েছে। ইতোমধ্যে সে দেশে তার অবস্থান অনানুষ্ঠানিকভাবে সেদেশের সরকার প্রধানের ওপরে। আমেরিকার কূটনীতিতে সেনাপ্রধানকে বেছে নেবার দৃশ্যত কারণ দুটো বলেই অনেকে মনে করছেন। চায়নার থেকে পাকিস্তানকে কিছুটা সরিয়ে আনা ও নিকট ভবিষ্যতে ইরানের সঙ্গে কোনো রূপ সংঘাতে গেলে সেখানে পাকিস্তানকে ব্যবহার করা।
এক্ষেত্রে চায়নার জন্যে মূল সমস্যা ইরানে ও পাকিস্তানে তার বিনিয়োগ। যে বিনিয়োগ পাকিস্তানে সামরিক শাসক হিসেবে আসিম মুনির এলে সমস্যায় পড়তে পারে। অপরদিকে বাংলাদেশ যেভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছে এর যে সম্ভাব্য প্রভাবগুলো বাংলাদেশের ওপর পড়তে পারে তা চায়নার জন্য কতটা ভালো হবে! পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে যত বেশি ঘনিষ্ঠ হবে ততই বাংলাদেশের মৌলবাদীরা শক্তিশালী হবে। বাংলাদেশের মৌলবাদীরা শক্তিশালী হলে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা মৌলবাদীরাও শক্তিশালী হবে। রোহিঙ্গা মৌলবাদীরা ইতোমধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অনেক কিছু করেছে বলে কিছু প্রমাণ মিলছে, ভবিষ্যতে তা আরো প্রকাশিত হবে। তবে এই রোহিঙ্গা মৌলবাদীরা অনেক বেশি ক্ষতিকর হবে আরাকান ঘিরে মিয়ানমারের যে সমুদ্র বন্দর বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করতে চায় চায়না এবং আরাকানে তাদের যে গ্যাস পাইপলাইন ও ইপিজেড প্রকল্প আছে সেক্ষেত্রে। তাছাড়া মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের সৃষ্ট এই সমস্যা বাংলাদেশ, ভারত ও চায়নার জন্যে ক্ষতিকর হতে পারে ভবিষ্যতে। আর তা নির্ভর করছে পাকিস্তান সরকার ও তাদের লালিত জঙ্গি সংগঠনগুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কতটা তাদের কাজের সুযোগ নানান ছদ্মাবরণে তৈরি করতে পারবে। এমনকি তাদের কার্যক্রম যদি ভারত সীমান্ত অতিক্রম করতে চায় সে সময় চায়নার ভূমিকা কী হবে তাও চিন্তার বাইরে রাখার কোনো সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তন কীভাবে হয়েছে তা নিয়ে যে যাই বলুক না কেন, বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা নিজে মুখে যা বলেছেন, সেটাই সত্য ধরতে হবে। তিনি বলেছেন, ইট ইজ অ্যান অ্যামেজিং মেটিকুলাস ডিজাইন। আর এটা যে শুধু কোনো ছাত্র আপরাইজিং নয় এটা মেটিকুলাস ডিজাইনের ফল তা তিনি আমেরিকায় গিয়ে ক্লিন্টন ফাউন্ডেশনে আমেরিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি তার ঘনিষ্ঠ মি. ক্লিন্টনকে জানান। ক্লিন্টনকে এভাবে জানানোর মধ্যে দিয়ে প্রমাণ করে বিষয়টি ক্লিন্টন আগে জানতেন না। যদিও ক্লিন্টন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট- তারপরেও এই মেটিকুলাস ডিজাইনের কথা তাকে কেন জানানো হয়নি ব্যক্তিগত এত ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও? তাই এই মেটিকুলাস ডিজাইন এর সঙ্গে যদি বাইরের কোনো রাষ্ট্র বেশিভাবে জড়িত থাকে তাহলে কি সেটা আমেরিকা ও চায়নার অজান্তে পাকিস্তান এটাই বেশি প্রমাণ করে?
দৃশ্যত বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তনের পরে বাংলাদেশে তুরস্ক ও পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতা মূলত চায়না ও আমেরিকার থেকে বেশি। তুরস্ক শেখ হাসিনার সরকারের প্রথম দিকে তাঁর সরকারের অনেক বেশি বিরোধী ছিলো যেমনটি পাকিস্তানও ছিলো। পরে শেখ হাসিনার সঙ্গে এই রোহিঙ্গা শরণার্থী ঘিরে ও অদৃশ্য কিছু কারণে সম্পর্কের উষ্ণতা শুরু হয় তুরস্কের সঙ্গে। অবশ্য তখন শেখ হাসিনার সরকারের নীতিও অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে- শেখ হাসিনার সরকারের ক্ষমতাশালীরা ওই সময়ে বাংলাদেশের মৌলবাদীদের সন্তুষ্টিতে ব্যস্ত। এবং ক্ষমতাবানদের অনেকে প্রশাসনের, রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী হলেও মূলত মৌলবাদীদের পক্ষের ব্যক্তি ছিলেন।
তাই আমেরিকার ঘনিষ্ঠ তুরস্ক ও পাকিস্তান যদি বাংলাদেশে নানা ছদ্মাবরণে ঢোকার সুযোগ পায় তার ফলে বাংলাদেশের রাজনীতি ও তার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের যে পরিবর্তন ঘটবে তার রূপ এবং তা চায়নার জন্যে কতটা বিনিয়োগ-বান্ধব ও রাজনৈতিক-বান্ধব হবে সেটা ভবিষ্যতের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।
ট্যারিফ নিয়ে আমেরিকা পৃথিবীতে যে নতুন যুদ্ধ শুরু করেছে তা অনেকটা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি অর্থনৈতিক ফরম্যাট বলা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমেরিকার লক্ষ্য চায়নার বড় বাজার ও ভারতের বড় বাজার। ভারত ও চায়না তাদের নিজ নিজ শক্তিতে এখানে লড়বে। ভারত ও চায়নার ভেতর অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির পার্থক্য থাকলেও এ মাপের দেশগুলো কখনও একটি বা কয়েকটি দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব সীমাবদ্ধ রাখে না- তারা মূলত তাদের নিজস্ব শক্তি দিয়েই নিজের অবস্থান তৈরি করে। তারপরেও এখানে আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়, আমেরিকায় জন্মহার কমছে, চায়নায় বার্ধক্য বেড়ে গেছে- ভারতে বার্ধক্য অনুপাতে শ্রমশক্তিতে এখন তরুণ অনেক গুণ বেশি। তাই এই দুই বড় বাজার ও ভারতের মতো কর্মশক্তির সঙ্গে আমেরিকার ট্রেড ওয়ার খুব বেশি লড়তে পারবে না।
এখন এখানে একটি বিষয় বড় হয়ে দেখা দেবে এই ট্রেড ওয়ার কি মূলত কোয়াড বা সাউথ চায়না সি ঘিরে যে সমুদ্র যুদ্ধ বা সমুদ্র সম্পদ যুদ্ধ তাকেও কি ট্রেডের দিকে ঠেলে দেবে? কোয়াডের সর্বশেষ পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে ট্রেড গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। অন্যদিকে আমেরিকার এই ট্রেড ওয়ারের চাপে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে চায়নাকে অনেক বেশি ঢোকার সুযোগ দেবে। ভারত ও জাপান কিছুটা হলেও সুযোগ নেবে।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সহ তার পার্শ্ববর্তী ভারতের কিছু এলাকার অর্থনৈতিক গেম চেঞ্জার হিসেবে বাংলাদেশের আগের সরকার মাতারবাড়ি ডিপ সি পোর্ট তৈরির কাজ শুরু করে। যার পরিপূর্ণ অপারেশন দ্রুত হওয়ার কথা ছিলো। ওয়ার্ল্ড ট্রেড ওয়ার ও সমুদ্র যুদ্ধ দুটোতেই এই ডিপ সি পোর্টের একটা বড় ভূমিকা থাকবে বলে অনেকেই ধারণা করেছিলো।
বাংলাদেশের অর্থনীতি আগের সরকার রাজপথের মাধ্যমে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যে ধাক্কা খেয়েছে- বিশেষ করে সরকার পরিবর্তনের পরে শিল্প কারখানায় হামলার ফলে বিদেশি বিনিয়োগের বিশ্বস্ততা অর্জন এখন অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক কূটনীতি সহ অনেক কূটনীতিতে বাংলাদেশ এখন সাইডলাইন মিটিং এ চলে গেছে। এই অবস্থায় মাতারবাড়ি ডিপ সি পোর্টের ভবিষ্যৎ এবং জাপান, চায়না, আমেরিকা ও ভারতের কাছে এ পোর্ট কতটা গুরুত্বপূর্ণ হবে ভবিষ্যতে -সেটাও একটা প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে গেছে।
জাপান এশিয়াতে কোয়াডে বা ইন্দো-প্যাসিফিক জোটের আমেরিকার মূল স্তম্ভ। জাপানের একটি বড় বিনিয়োগ চলছে ভারতের দক্ষিণপূর্ব অঞ্চলের রাজ্যগুলোতে। এই বিনিয়োগ বাংলাদেশ অবধি বিস্তৃত হওয়ার কথা ছিলো মাতারবাড়ি ডিপ সি পোর্টকে ঘিরে। এ মুহূর্তে ভারত তার অধিকাংশ ল্যান্ডপোর্ট দিয়ে বাংলাদেশি অনেক পণ্য আমদানি রপ্তানি বন্ধ করেছে- যার ফলে স্বাভাবিকভাবে জাপানের ওই বিনিয়োগের গতি জাপান ও ভারত ভিন্নভাবে প্রবাহিত করবে।
অন্যদিকে জাপান ও আমেরিকার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে কোয়াডের অর্থনৈতিক রূপকে ফিলিপাইন্স, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার দিকে বিস্তৃত করা। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় সমুদ্র সম্পদের রাষ্ট্র মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা আবার অনেক বেশি ভারতের দিকে চলে আসার অর্থ দাঁড়াচ্ছে কোয়াড অর্থনীতির সঙ্গে তাদেরও একটা যোগ থাকবে।
পৃথিবী জুড়ে বর্তমানের এই ট্রেড ওয়ার সম্পর্কে এ মুহূর্তে শুধু এটুকু বলা যায়- এর গতি কখনও কমবে, কখনও বাড়বে- আর মাঝে মাঝে দিক পরিবর্তন করবে। বাস্তবে ওই দিক পরিবর্তনের কম্পাসের কাঁটাটি কে কখন ঘুরাবে তা নিশ্চিত কেউ বলতে পারে না। সবই নির্ভর করবে সময়ের ওপর। কারণ যদিও মনে করা হচ্ছে এখনও পৃথিবী একটি বড় শক্তির নিয়ন্ত্রণে কিন্তু অনেকগুলো দেশের অর্থনৈতিক অবস্থান বাস্তবে ইতোমধ্যে তা বদলে দিয়েছে।
এ সময়ে বাংলাদেশ অনেক বেশি অর্থনীতির ট্রেন থেকে নেমে গেছে। অন্যদিকে প্রকাশ্য মৌলবাদীদের চলাফেরা খুব সহজে তাকে আমেরিকা, চায়না ও ভারতের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করবে কি? আবার আমেরিকা ও জাতিসংঘ যেখানে মৌলবাদের সহায়ক শক্তি হয় সে দেশগুলোর বাস্তবতাও পৃথিবীতে চিহ্নিত।
তবে ওই দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের পার্থক্য হলো এদেশের সংস্কৃতি নির্ভর একটি জাতীয়তাবাদী শক্তি। সে শক্তির কতটুকু অবশিষ্ট আছে তা সত্যি অর্থে প্রকাশ পাবার পরেই বলা যাবে ভারত- চায়না ও আমেরিকার এই ত্রিমুখী অবস্থানে ও্ই জাতীয়তাবাদী শক্তি নিজেকে প্রকাশ করতে পারবে। এবং কীভাবে এবং কখন প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী ওই শক্তি নিজেকে শক্তিশালী করতে পারবে। বাংলাদেশের একজন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ন্যায়ের বদলে প্রতিহিংসা প্রতিস্থাপন করেছে।
বাস্তবে বিশ্ব রাজনীতির খেলায় যেহেতু যে কোনো দেশকে তার নিজ শক্তির ওপর নির্ভর করে দাঁড়াতে হয় বা খেলতে হয়। বাংলাদেশকেও তাই নিজ শক্তিবৃদ্ধির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আর সেটা তখনই হবে যে মুহূর্তে বাংলাদেশ একটি ইনক্লুসিভ নির্বাচনের মাধ্যমে রুল অব ল প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। এবং তখনই বাংলাদেশ তার মাপের সেই শক্তি অর্জন করতে পারবে দুই বড় অর্থনীতি ও বড় প্রতিবেশীর সঙ্গে সে কীভাবে কতটুকু সম্পর্ক স্থাপন করবে বা তাদের কার কতটুকু সহায়তা পাবে।
লেখক: বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.
(India Foundation এর জার্নালে প্রকাশিত লেখাটির অনুবাদ ) India Foundation এ প্রকাশিত লেখার link – From Street Movement to State Uncertainty: Bangladesh in Regional and Global Context – India Foundation