আমেরিকা বাস্তবে ইরানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে বেশ মুশকিলে আছে। কারণ, ইরানের বন্ধুপ্রতিম তিন সামরিক শক্তি চীন, রাশিয়া ও ভারত কোনোক্রমেই ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকার পক্ষ নেয়নি এবং নিকট ভবিষ্যতেও নেবে না। এই তিন দেশের বিশাল ইনভেস্টমেন্ট রয়েছে ইরানে। তাছাড়া চায়না ও ইন্ডিয়ার জ্বালানি নিরাপত্তার একটি বড় উৎস ইরান। এমনকি এই দুই দেশের বড় বাজারও ইরান। তাই ইরান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অর্থ রাশিয়া, চীন ও ভারত আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। কোনো দেশ (যদি প্রকৃত অর্থে দেশ হয়, বাফার স্টেট বা স্যাটেলাইট স্টেট না হয়) কখনই অন্য দেশের স্বার্থে নিজের স্বার্থ ক্ষতি করে এক ইঞ্চি নড়বে না, এটাই স্বাভাবিক।
এক্ষেত্রে তাই বাধ্য হয়ে আমেরিকা পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে চয়েস করেছে। কারণ, পাকিস্তানের ক্ষমতার উৎস ও মূল পলিটিকাল পার্টি সেদেশের সেনাবাহিনী। তাই আসিম মুনীরকে ইতোপূর্বে আমেরিকা ইরানে বি-টু বিমান পাঠানোর আগে ডিনারে ডাকে। আসিফ মুনীর দাওয়াত পেয়েই সানন্দে রাজি হন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ওই সময়ে কানাডায় ছিলেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তাঁকে ডিনারে দাওয়াত দেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দেন, তাকে দ্রুত দেশে ফিরতে হবে কারণ তার একটি রাজ্যে জনসভায় যোগ দেবার প্রোগ্রাম রয়েছে। এর ভেতর দিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শুধু ভদ্রতার সঙ্গে ডিনারের দাওয়াত প্রত্যাখান করেননি, তিনি ওই ডিনার ও তার আগের লাঞ্চের মানটিও ডিপ্লোম্যাটিক ভাষায় জানিয়ে দেন।
এর পরে ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার মতো বাস্তবে পাকিস্তান ছাড়া আর কোনো দেশ হাতে থাকে না আমেরিকার। আর এসব ক্ষেত্রে পাকিস্তানের অবস্থান হেনরি কিসিঞ্জারের আমল থেকে চিহ্নিত হয়ে গেছে। হেনরি কিসিঞ্জার তার ওয়ার্ল্ড গেম চেঞ্জার কূটনৈতিক সাফল্য অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপরীতে চীন-আমেরিকা সম্পর্ক পাকিস্তানের মাধ্যমে গড়তে সমর্থ হন ১৯৭১ সালে। ওই সময়ে একজন বিখ্যাত রেডিও জার্নালিস্ট তার অ্যানালিসিসে ওই চায়না-আমেরিকা সম্পর্ক পৃথিবীতে নাটকীয় ঘটনা শুধু নয়, আরও ঘটনার জন্ম দেবে বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া ওই বিশ্লেষণের ফুটনোটে পাকিস্তান সম্পর্কে বলেছিলেন, পাকিস্তানের অবস্থা এখন এক বেডে থাকা দুই ব্যাচেলর বন্ধুর ছোট তোয়ালেটির মতো।
এবারও দৃশ্যত সৌদি-পাকিস্তান চুক্তিটি সৌদি ও পাকিস্তানের মধ্যে মনে হলেও এটা যে আমেরিকার ইচ্ছার প্রকাশ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর এখানে আমেরিকার ইচ্ছা থাকবে দক্ষিণ এশিয়াকে ডিস্টার্ব না করা। কিন্তু সাধারণত পাকিস্তানের মতো Rouge state গুলিকে নিয়ে কখনও কোনো শেষ কথা বলা যায় না। এসব স্টেটগুলিতে মূলত টেররিজম, স্মাগলিং (ড্রাগস এবং আর্মস) রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে চলে – তাই এ ধরনের দেশ অবৈধ স্বার্থে যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো দেশের সিকিউরিটির জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। এমনকি যে চায়না ও আমেরিকা নিউক্লিয়ার পাওয়ারে শক্তিশালী হতে পাকিস্তানকে সাহায্য করেছে তাদের জন্যও বিপদ। কারণ, নিউক্লিয়ার যুদ্ধে যদি শুরুতেই পাকিস্তানের নিউক্লিয়ার ওয়ারহেডগুলো ইনঅ্যাকটিভ করা সম্ভব না হয় তাহলে তার ক্ষতি সরাসরি চায়নার নাগরিক এমনকি বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা আমেরিকান নাগরিকদেরও বহন করতে হবে।
কিন্তু এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ, সৌদি ও পাকিস্তান মিলিটারি প্যাক্ট মূলত মিডল ইস্ট কনফ্লিক্ট দক্ষিণ এশিয়া অবধি টেনে নিয়ে এলো। কারণ, সৌদির থেকে ইসরায়েল আমেরিকার অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ মিত্র হলেও, ইসরায়েলের ও সৌদির চরিত্র ভিন্ন। আমেরিকা যা বলে সৌদি সেটা বিনা বাক্যে মেনে নেয়। অন্যদিকে ইসরায়েল তার নিজস্ব স্বার্থে চলে। আমেরিকার শত অনুরোধ বা নির্দেশ যাই হোক না কেন, তা যদি তার স্বার্থ বা পলিসির বাইরে হয় সেটা ইসরায়েল কখনও মানে না। মানে না জাতিসংঘকেও। যার প্রমাণ দেখা যাচ্ছে গাজা দখলের ক্ষেত্রে। আমেরিকা বার বার অনুরোধ করেও বা জাতিসংঘ অনেক বাক্য ব্যয় করেও ইসরায়েলকে তার অবস্থান থেকে সরাতে পারছে না। তাছাড়া ঐতিহাসিকভাবে সমগ্র মিডল ইস্ট সেই নাসেরের আমল থেকে বার বার ধাক্কা খাচ্ছে বা পরাজিত হচ্ছে ইসরায়েলের কাছে।
ইরানের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র আছে এমন ধারণায় কিছুদিন আগেও ইসরায়েল হামলা করেছে ইরানে। পরবর্তীতে চীন ও রাশিয়ার মধ্যস্থতায় সেটা তারা বন্ধ করে। এখন সৌদির সঙ্গে পাকিস্তানের মিলিটারি প্যাক্ট এর অর্থ হলো সৌদিও বনামে পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হলো। কারণ এখন থেকে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র বৈধভাবে ব্যবহার করার অধিকারী সৌদি বা সৌদির পক্ষে এটা বৈধভাবে ব্যবহার হবে।
২০০৬ সালে সাইপ্রাস টাইম একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেছিলো, সেখানে বলা হয়েছিলো পারমাণবিক স্টোরেজে রাখা পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রগুলো কোনো দেশে আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত করতে সময় লাগে ২০ মিনিটের বেশি। আর এই প্রস্তুতিসহ ওই স্টোরেজ ইসরায়েলের রাডারে। এগুলো তাদের রাডারে গভীর পর্যবেক্ষণে রাখার উদ্দেশ্য, তারা তাদের নিউক্লিয়ার ওয়েপনস ইনঅ্যাকটিভ মিসাইল পাকিস্তানের জন্যে এমনভাবে স্থাপন করেছে যাতে তের থেকে চৌদ্দ মিনিটের মধ্যেই তারা পাকিস্তানের নিউক্লিয়ার স্টোরেজে আঘাত হানতে পারে।
সাইপ্রাস টাইমের নিউজ সবটুকু সঠিক কিনা তা বলা কঠিন। কারণ, সঠিক অনুসন্ধানী রিপোর্টও তো আর মূল সিকিউরিটি রিপোর্ট নয়, সেখানে কিছু ঘাটতি থাকতে পারে। তবে বিষয়টি যে এমন সেটা ধরে নেয়া যায়।
তাই এটা স্পষ্ট সৌদি-পাকিস্তান মিলিটারি প্যাক্টের মাধ্যমে মিডল ইস্ট পাকিস্তান অবধি চলে আসায় মিডল ইস্টের কনফ্লিক্ট পাকিস্তান অবধি চলে এসেছে। এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় যদি কিছু দিন পর থেকে যখন তখন মিসাইল হামলা বা অন্য কোনো নতুন ক্ষেপণাস্ত্র হামলার খবর জানতে হয়, আর তার হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির রিপোর্ট ওয়ার্ল্ডের মূল মিডিয়াগুলোর রিপোর্ট হয়—তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। সেই দরজা খোলা হয়েছে।
লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.