বার্লিনে জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক উন্মুক্ত প্রদর্শনীতে কানাডার উপস্থিতি ছিল সীমিত ও সংযত। ছোট একটি স্টল, কুইজ আর ম্যাপল সিরাপ ক্যান্ডিতে সীমাবদ্ধ এ আয়োজন আন্তর্জাতিক মহলে কানাডার অবস্থান নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। বিপরীতে ডেনমার্ক ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলো বিশাল আয়োজন করে দর্শকদের আকর্ষণ করে। এই বৈপরীত্যই যেন ইঙ্গিত করছে—কানাডা কি সত্যিই যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে নতুন কোনো গন্তব্যের সন্ধানে বেরিয়েছে?
পুরনো কানাডা বনাম নতুন কানাডা
দীর্ঘদিন ধরে কানাডা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সক্রিয় না থেকে যুক্তরাষ্ট্রের উপরে নির্ভর করেই চলেছে। তবে নতুন প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি দৃশ্যপট পাল্টাতে চাইছেন। সামরিক সংবর্ধনা নিয়ে বার্লিন সফরে তিনি জার্মানির সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ খনিজসম্পদ চুক্তি সই করেন। যদিও এ চুক্তিতে নেই কোনো প্রকল্প বা নির্দিষ্ট সময়সীমা, আর এটি আইনি বাধ্যবাধকতা-হীন।
ইউরোপে ঝোঁক বাড়ানোর প্রেক্ষাপট
কানাডার ৭০ শতাংশ রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রমুখী। নতুন শুল্ক আরোপে অর্থনীতি চাপে পড়েছে। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব আবারও সামনে এসেছে। সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, ৪৬ শতাংশ কানাডিয়ান ইউরোপমুখী এ ধারণাকে সমর্থন করছে। তাই কার্নি বিশেষভাবে জার্মানির মতো বৃহৎ অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে মনোযোগ দিচ্ছেন।
সীমাবদ্ধতা ও বাস্তবতা
তবে ইউরোপমুখী হওয়ার পথ মোটেও সহজ নয়। বার্লিন সফরে জার্মান মিডিয়ার আগ্রহ ছিল সীমিত। তিন বছর ধরে জার্মানিতে কোনো কানাডিয়ান রাষ্ট্রদূত নেই, নেই কোনো চেম্বার অব কমার্সও। অন্যদিকে ভৌগোলিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারই সবচেয়ে সহজলভ্য এবং কয়েক দশক ধরে কানাডার অর্থনীতি সেদিকেই অভ্যস্ত।
অতীত থেকে শিক্ষা
১৯৭০-এর দশকে কানাডা ‘‘থার্ড অপশন’’ নীতি গ্রহণ করে ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সম্প্রদায়ের দিকে ঝুঁকেছিল, কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। বেসরকারি খাত উত্তর আমেরিকার বাইরে ঝুঁকি নিতে রাজি হয়নি। বরং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য বেড়ে যায়। ১৯৮৯ সালের পর মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি কানাডাকে আরও বেশি যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর করে তোলে।
জ্বালানি খাতের চ্যালেঞ্জ
তেল ও গ্যাসসহ প্রাকৃতিক সম্পদ প্রায় পুরোপুরিই যুক্তরাষ্ট্রমুখী। বিকল্প বাজার তৈরির প্রচেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়েছে। পাইপলাইন প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে, বিশাল ক্ষতি গুনতে হয়েছে। নতুন প্রকল্পগুলোও সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়সাপেক্ষ। এলএনজি রপ্তানির জন্য পোর্ট অব চার্চিল ব্যবহারের পরিকল্পনাতেও অন্তত ৫–৭ বছর লাগবে।
বেসরকারি খাতের দৃষ্টিভঙ্গি
বড় কানাডিয়ান কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রমুখী অবস্থান থেকে সরে আসছে না। ব্যাংক, অটোমোবাইল, ইস্পাত, কাঠশিল্প—সবই যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক। এমনকি অনেক প্রতিষ্ঠান সদরদপ্তরও যুক্তরাষ্ট্রে সরিয়ে নিয়েছে। ফলে ইউরোপমুখী বৈচিত্র্য আনার সুযোগ সীমিত।
সরকারের পদক্ষেপ ও সমালোচনা
অটোয়া ইউরোপমুখী বাণিজ্য জোরদারে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। হাইড্রোজেন খাতে জার্মানির সঙ্গে চুক্তি, রপ্তানি সহায়তা তহবিল, এবং ‘মেজর প্রজেক্টস অফিস’ চালুর উদ্যোগ উল্লেখযোগ্য। তবে এসব প্রকল্পে বিলম্ব হচ্ছে, খরচ বাড়ছে। ব্যবসায়ী মহল সতর্ক করছে—আজকের বাড়তি ব্যয় ভবিষ্যতে ঘাটতি ডেকে আনতে পারে।
বিকল্প খাত ও সফট পাওয়ার
কানাডা ভবিষ্যতের খাত যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ও ক্লিন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়াতে পারে। পাশাপাশি সফট পাওয়ার ব্যবহারের দিকেও মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়ার কেপপ বা থাইল্যান্ডের রেস্তোরাঁর মতো সাংস্কৃতিক শক্তিকে বৈদেশিক কৌশলে কাজে লাগানোর প্রয়োজনীয়তার কথাও আলোচনায় এসেছে।
কানাডার জন্য ইউরোপমুখী হওয়া সহজ হবে না। আগামী ২০ বছরে যদি রপ্তানি ১০ শতাংশ থেকে ১৫ বা ২০ শতাংশে উন্নীত করা যায়, তবে সেটিই হবে বড় অর্জন। কিন্তু ইতিহাস বলছে—কানাডা সবসময় যুক্তরাষ্ট্রকেই প্রাধান্য দিয়েছে। এবার প্রশ্ন হলো, কানাডা কি সত্যিই ভিন্ন পথে হাঁটার ধৈর্য ও কল্পনাশক্তি দেখাতে পারবে?