জলমহালের বহুমাত্রিক গুরুত্ব
ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এএসএম সালেহ আহমেদ বলেছেন, নদী, খাল, বিল, হাওর, বাওড়সহ দেশের জলমহালগুলো বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যের এক অমূল্য অংশ। এগুলো শুধু মাছের উৎপাদন ও মানুষের জীবিকার উৎস নয়, বরং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, কৃষি উৎপাদন, নৌপরিবহন এবং পানির টেকসই সরবরাহেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তিনি বলেন, জলমহালকে কেবল জলাশয় হিসেবে দেখা ভুল হবে। এগুলো দেশের অর্থনীতি, খাদ্যনিরাপত্তা, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং সমাজজীবনে একাধিক মাত্রায় অবদান রেখে আসছে।
সংকট ও চ্যালেঞ্জ
সিনিয়র সচিবের মতে, বর্তমানে জলমহালগুলো নানা সংকটে রয়েছে।
- • দখল: অনেক জলমহাল দখল হয়ে যাচ্ছে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে, যা স্থানীয় জনগণের জন্য বড় সমস্যা তৈরি করছে।
- • দূষণ: শিল্পকারখানার বর্জ্য, প্লাস্টিক ও কীটনাশকের কারণে পানির গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে।
- • অপরিকল্পিত উন্নয়ন: অবৈজ্ঞানিক সেতু, রাস্তা বা প্রকল্প জলপ্রবাহের স্বাভাবিক ধারা নষ্ট করছে।
- • অতিরিক্ত আহরণ: অতিমাত্রায় মাছ ধরার কারণে মাছের প্রজাতি কমে যাচ্ছে এবং জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে।
এসব কারণে জলমহালের অস্তিত্ব এবং টেকসই ব্যবহার এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরকারি উদ্যোগ ও নতুন আইন
“সরকারি জলমহাল অধ্যাদেশ” প্রণয়নের উদ্যোগকে সময়োপযোগী হিসেবে বর্ণনা করেন সিনিয়র সচিব। তিনি বলেন, সরকারি মালিকানাধীন জলমহাল সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখা, রেকর্ড সংরক্ষণ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি।
এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে—
- • জলমহালের সুরক্ষা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হবে।
- • পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার পাশাপাশি রাজস্ব আয়ের উৎসকে শক্তিশালী করা হবে।
- • স্থানীয় জনগণের জীবিকা, খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশ রক্ষায় সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে।
সবার অংশগ্রহণ অপরিহার্য
সিনিয়র সচিব এএসএম সালেহ আহমেদ বলেন, জলমহালের সংরক্ষণ ও উন্নয়নে সরকার একা নয়, সমাজের সব অংশকে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি স্থানীয় জনগণ, নীতিনির্ধারক, গবেষক ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান।
কর্মশালার মূল বক্তব্য
রবিবার বিকালে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আয়োজিত কর্মশালায় তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নিজেই।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন—
- • এ. জে. এম. সালাহউদ্দিন নাগরী, চেয়ারম্যান (সচিব), ভূমি সংস্কার বোর্ড
- • ড. মাহমুদ হাসান, চেয়ারম্যান (সচিব), ভূমি আপিল বোর্ড
- • মো. সাইদুর রহমান, মহাপরিচালক (গ্রেড), ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর
- • ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিববৃন্দ
- • মো. হান্নান মিয়া, ল্যান্ড পলিসি স্পেশালিস্ট, এলামস
- • মো. হামিদুর রহমান, ল্যান্ড সার্ভিসেস স্পেশালিস্ট, এলামস
- • ভূমি মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ
ভবিষ্যৎ করণীয়
জলমহাল রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে ভবিষ্যতে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে অর্থনীতি, কৃষি ও পরিবেশে। এজন্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন:
- • আইন বাস্তবায়ন: নতুন আইন যেন বাস্তবায়নযোগ্য হয় এবং স্থানীয় জনগণ এতে সম্পৃক্ত থাকে।
- • বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা: মাছের উৎপাদন বাড়াতে এবং প্রজাতি রক্ষা করতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে।
- • দূষণ নিয়ন্ত্রণ: শিল্পবর্জ্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
- • জনসচেতনতা: স্থানীয় জনগণকে সচেতন ও সম্পৃক্ত করতে হবে।
- • গবেষণা ও তথ্যভিত্তিক নীতি: জলমহাল নিয়ে নিয়মিত গবেষণা ও তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় জলমহাল একটি অপরিহার্য অংশ। তবে দখল, দূষণ ও অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে এটি টিকে থাকার সংকটে রয়েছে। তাই সরকারি পদক্ষেপের পাশাপাশি সামাজিক ও স্থানীয় অংশগ্রহণই জলমহাল রক্ষার মূল চাবিকাঠি।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 




















