বেসিয়াসের শুরু ও নতুন লক্ষ্য
১১ বছর আগে শেনঝেনে পাওয়ার ব্যাংক উৎপাদন দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল চীনা কোম্পানি বেসিয়াস। তখন ইউরোপীয় বাজার তাদের কাছে অনেক দূরের স্বপ্ন মনে হয়েছিল। কিন্তু এ বছর বার্লিনে অনুষ্ঠিত ইউরোপের সবচেয়ে বড় কনজিউমার ইলেকট্রনিক্স মেলা আইএফএতে কোম্পানিটি হেডফোন ও ইয়ারবাড বিশ্ববাজারে উন্মোচন করেছে।
প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী হে শিয়ু বলেছেন, শেনঝেনে তীব্র প্রতিযোগিতা তাদের বিদেশমুখী করেছে। বিশ্ববাজারে প্রবেশ সরবরাহ চেইন শক্তিশালী করার পাশাপাশি গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতেও জরুরি। তার ভাষায়, “পেছনে তাকিয়ে মনে হচ্ছে আমাদের পাঁচ বছর আগেই শুরু করা উচিত ছিল।”
কেন বিদেশমুখী হচ্ছে চীনা কোম্পানিগুলো
চীনে দুর্বল ভোক্তা চাহিদা ও অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতার কারণে মূল্য প্রতিযোগিতা তীব্র হয়েছে। এতে অনেক কোম্পানি লোকসানে পড়ছে। ফলে বিশেষজ্ঞদের মতে, মুনাফা করার অন্যতম পথ হলো বিদেশি বাজার দখল করা।
কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান টাইডালওয়েভ সলিউশনসের পার্টনার ক্যামেরন জনসনের মতে, “আপনি যদি বিদেশমুখী না হন, তাহলে প্রতিযোগীর কাছে বাজার হারানোর ঝুঁকি অনেক বেশি।”
বেসিয়াসের বাজার অবস্থান
তিন বছর আগে বেসিয়াস বিদেশি বাজারের জন্য বিশেষ টিম গঠন করে। বর্তমানে তারা বৈশ্বিক স্মার্ট অডিও বাজারের প্রায় ২ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। শাওমির মতো প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানি যেখানে ৪.৯ শতাংশ বাজার দখল করে আছে।
কোম্পানির মোট আয়ের ৪৫ শতাংশই আসে বিদেশ থেকে, যার মধ্যে ইউরোপ সবচেয়ে বড় বাজার। সিইও হে শিয়ু বলেছেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখানে ভোক্তার সংখ্যা বড় এবং প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাও বেশি।”
প্রতিযোগিতায় আলাদা হওয়ার কৌশল
চীনা প্রতিদ্বন্দ্বীদের (যেমন কিউওয়াইসি ও অ্যাঙ্কর) থেকে আলাদা হতে বেসিয়াস বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের সঙ্গে অংশীদারিত্ব করছে। তারা শুধু কম দামে প্রতিযোগিতা নয়, বরং ব্র্যান্ড মূল্য ও উচ্চমানের ইমেজ তৈরিতে মনোযোগী।
ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক বিশ্লেষক আফরা ওয়াং মনে করেন, বেসিয়াসের সাফল্য নির্ধারণ করবে চীনা ব্র্যান্ডগুলো বিশ্বমঞ্চে টেকসই প্রভাব ফেলতে পারবে কি না।
বোসের সঙ্গে অংশীদারিত্ব
আইএফএ বার্লিনে বেসিয়াস “ইনস্পায়ার সিরিজ” চালু করেছে। তরুণ ভোক্তাদের লক্ষ্য করে তৈরি এই হেডফোন ও ইয়ারবাড বানানো হয়েছে বোস, নোলস এবং জার্মান কোম্পানি মিমির সহযোগিতায়।
জার্মানিতে বোসের সবচেয়ে সস্তা ইয়ারবাডের তুলনায় ইনস্পায়ার প্রায় ১০ ইউরো কম দামে বিক্রি হচ্ছে, তবে অন্য চীনা ব্র্যান্ডগুলোর তুলনায় এগুলো অনেক বেশি দামি।
ক্যানালিসের বিশ্লেষক জ্যাক ল্যাথেমের মতে, “বোসের সঙ্গে অংশীদারিত্ব বেসিয়াসকে উচ্চমানের বাজারে ঠেলে দিচ্ছে। ধাপে ধাপে তারা মধ্য-উচ্চ শ্রেণির মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করছে।”
বোসও এ অংশীদারিত্বকে দেখছে তাদের বাজার বাড়ানোর সুযোগ হিসেবে। বোসের কৌশল কর্মকর্তা নিক স্মিথ বলেছেন, “আমরা বেসিয়াসের গ্রাহকদের জন্য শ্রবণ অভিজ্ঞতা উন্নত করছি এবং আমাদের অডিও প্রযুক্তিকে আরও বড় দর্শকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি।”
নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রক চ্যালেঞ্জ
তবে ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করা চীনা নির্মাতাদের জন্য সহজ নয়। এখানে পণ্যের নিরাপত্তা মানদণ্ড খুব কঠোর। গত বছর ইইউ ও যুক্তরাজ্যে বেসিয়াসের দুটি ওয়্যারলেস পাওয়ার ব্যাংক অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকির কারণে প্রত্যাহার করা হয়।
এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি ও প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধও ইউরোপে চীনা কোম্পানির বাড়তি উপস্থিতি নিয়ে সন্দেহ বাড়িয়েছে। যদিও কনজিউমার ইলেকট্রনিক্স এখনো সেমিকন্ডাক্টর বা ইলেকট্রিক ভেহিকেলের মতো কঠোর নজরদারির আওতায় পড়েনি।
বার্লিনভিত্তিক চিন্তাধারা প্রতিষ্ঠান মারকেটর ইন্সটিটিউটের বিশ্লেষক আলেকজান্ডার ব্রাউন বলছেন, ভোক্তা খাতে ২০২৪ সালে চীন থেকে ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যে ১ বিলিয়ন ইউরোর বিনিয়োগ হয়েছে। তবে তিনি সতর্ক করেছেন, যত চীনা কোম্পানি মূল্য শৃঙ্খলে ওপরে উঠবে, ততই সাইবার নিরাপত্তা ও প্রতিযোগিতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়বে।
ইউরোপ দখলের লক্ষ্য
সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বেসিয়াসের সিইও হে শিয়ুর বিশ্বাস, ইউরোপ এখন তাদের জন্য উপযুক্ত সময়। তার ভাষায়, “বিশেষ করে পোল্যান্ড, স্পেন ও জার্মানির মতো বাজারে আমাদের লক্ষ্য খুব পরিষ্কার: আমরা এখানে নম্বর ওয়ান হতে চাই।”