যাত্রার অভিজ্ঞতা বদলাতে পারে কেবিন ডিজাইন
উড়োজাহাজে যাত্রা অনেক সময় কেবল গন্তব্যে পৌঁছানোর মাধ্যম মনে হলেও প্রতিটি আসন, জানালা বা আলোর পেছনে লুকিয়ে থাকে বছরের পর বছর গবেষণা, পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ। ইউরোপের বৃহত্তম এয়ারোস্পেস কোম্পানি এয়ারবাসের কেবিন মার্কেটিংয়ের সহ-সভাপতি ইনগো উগেটজার জানান, প্রতিটি অংশ—সিট থেকে শুরু করে লাইটিং সিস্টেম পর্যন্ত—কঠোর পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যায়।
লুফথানসা গ্রুপ উদাহরণ হিসেবে €২.৫ বিলিয়ন বিনিয়োগ করেছে কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে তাদের সেবা ও কেবিন উন্নয়নে। এর মধ্যে রয়েছে আরও প্রশস্ত সিট, ব্লুটুথ-সংযুক্ত ইন-ফ্লাইট এন্টারটেইনমেন্ট সিস্টেমসহ নানা সুবিধা। লুফথানসার অনবোর্ড এক্সপেরিয়েন্স প্রধান মার্কো উইলা বলেন, “সফলভাবে ডিজাইন করা একটি কেবিন সত্যিই এক ধরনের মাস্টারপিস।”
অগ্রাধিকার: ওজন কমানো ও পরিবেশবান্ধব উপকরণ
গত দশকে কেবিন ডিজাইনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে দুটি বিষয়—ওজন হ্রাস এবং টেকসই উপকরণের ব্যবহার। তবে যাত্রীদের অভিযোগ হলো, আসন কমে যাওয়া বা জায়গার স্বাচ্ছন্দ্য হারানো সত্ত্বেও ভাড়া কমছে না। ফলে যাত্রীরা বেশি বিশ্বস্ত হচ্ছে সেইসব এয়ারলাইনের প্রতি, যারা আরাম ও অভিজ্ঞতায় সেরা সেবা দিচ্ছে।
যাত্রী ও এয়ারলাইনের স্বার্থের ভারসাম্য
নিরাপত্তা সবসময় কেবিন ডিজাইনের প্রথম অগ্রাধিকার হলেও আরাম, কার্যকারিতা, সৌন্দর্য এবং আয়ের ভারসাম্য রাখাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সিটের সংখ্যা বাড়াতে গিয়ে অনেক সময় যাত্রীদের পায়ের জায়গা কমে যায়। এর ফলে অর্থনীতিশ্রেণীর কেবিনে নিরাপত্তা বেড়েছে বটে, তবে আসনের আরাম ও নকশার মান সময়ের সঙ্গে কমেছে।
যেসব ফিচার যাত্রাকে করে আরও নিরাপদ ও আরামদায়ক
১. আগুনে না জ্বলা সিট
প্রতিটি আসনের কুশনে আগুন প্রতিরোধী স্তর থাকে, যা সাধারণত সিন্থেটিক বা গ্লাস ফাইবার দিয়ে তৈরি। কাপড়, ফোম ও কার্পেটও বিষাক্ত ধোঁয়া সৃষ্টি না করে দ্রুত নিভে যাওয়ার মতো মানসম্মতভাবে তৈরি হয়।
২. ১ কোটি ৬০ লাখ রঙের এলইডি আলো
এয়ারবাস এ৩৫০ উড়োজাহাজে ব্যবহৃত উন্নত এলইডি আলো যাত্রীদের জেটল্যাগ কমাতে সাহায্য করে। বিশেষ অ্যালগরিদম আলোকে সময়, মৌসুম ও গন্তব্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য করে বায়োরিদম ঠিক রাখে। এতে মাথাব্যথা, ক্লান্তি ও মাথা ঘোরা কম হয়।
৩. কেবিনের বাতাস হাসপাতালের মতো পরিষ্কার
অধিকাংশ আধুনিক উড়োজাহাজে ব্যবহৃত হাই-এফিশিয়েন্সি পার্টিকুলেট এয়ার (হেপা) ফিল্টার ৯৯.৯ শতাংশ জীবাণু, ভাইরাস ও ছত্রাক দূর করতে সক্ষম। প্রতি ছয় মিনিটে কেবিনের বাতাস সম্পূর্ণ বদলে যায়। বাতাস লম্বালম্বি নয়, বরং ওপর থেকে নিচে বৃত্তাকারভাবে প্রবাহিত হয়, ফলে দূষণ ছড়াতে পারে না।
৪. কেবিনের বায়ুচাপ ও ফিউজলেজ প্রযুক্তি
৩০-৪০ হাজার ফুট উচ্চতায় মানুষের শ্বাস নেওয়া সম্ভব নয়। তাই কেবিন প্রেসারাইজেশন ব্যবস্থায় কৃত্রিমভাবে নিচু উচ্চতার সমান চাপ তৈরি করা হয়। কম্পোজিট উপকরণ দিয়ে তৈরি ফিউজলেজ শক্তিশালী হওয়ায় এয়ারবাস এ৩৫০ বা বোয়িং ৭৮৭-এর মতো উড়োজাহাজে ৬,০০০ ফুট সমতুল্য চাপ দেওয়া সম্ভব হয়, যা যাত্রীদের আরাম বাড়ায় ও জেটল্যাগ কমায়।
৫. বড় জানালা, খোলা স্পেসের অনুভূতি
নতুন প্রজন্মের উড়োজাহাজে জানালা আরও বড় করা হয়েছে। এতে কেবিনে প্রাকৃতিক আলো বেশি প্রবেশ করে, ফলে জায়গা বড় মনে হয় এবং ঘনত্বের অনুভূতি কমে। স্কুট এয়ারলাইনসের সর্বশেষ এমব্রেয়ার ই১৯০-ই২ উড়োজাহাজে জানালার প্রস্থ ৩০.৯ সেন্টিমিটার, যা এয়ারবাস এ৩২০নিওর ২৩ সেন্টিমিটার জানালার তুলনায় অনেক বড়।

উড়োজাহাজ কেবিন ডিজাইন শুধুই প্রযুক্তি নয়, বরং যাত্রীদের আরাম, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক জটিল শিল্প। আলো থেকে শুরু করে বাতাস, সিট থেকে জানালা—প্রতিটি উপাদান যাত্রার মান উন্নত করতে ভূমিকা রাখে। সঠিক ভারসাম্যে সাজানো এই কেবিনই একটি নিখুঁত আকাশযাত্রার অভিজ্ঞতা তৈরি করতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 
.jpg)



















