১১:০৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫

স্বাধীনতার খোঁজ

দীর্ঘ যাত্রা ও ফেরত পাঠানোর আঘাত

চীনের উত্তরাঞ্চলীয় শহরে ফেরত যেতে তাওকে দুটি বিমান, তিনটি যাত্রাবিরতি ও ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় কাটাতে হয়। কিন্তু তার হাত-পা ছিল লোহার বেড়িতে বাঁধা। যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন খারিজ হওয়ায় তাকে জোর করে ফেরত পাঠানো হচ্ছিল। প্রশ্ন জাগছিল—চীনেই বা তার জন্য কী অপেক্ষা করছে?

তাও (ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে পরিবারকে রক্ষা করার জন্য) যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস সীমান্তে হাজির হয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন। আবেদন নাকচ হলে সামনে ছিল দুটি পথ—নিজ দেশে ফিরে আত্মগোপনে রাজনৈতিক মত লুকিয়ে অচল চাকরি করা, নতুবা আবারও পালানোর চেষ্টা। কিন্তু তার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত হয়েছে, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফাঁকা আর কর্তৃপক্ষের নজরে নাম উঠেছে।


শৈশব ও প্রশ্নের শুরু

১৯৯০-এর দশকে জন্ম নেওয়া তাও শৈশব থেকেই শুনেছেন ১৯৫৯ সালের মহাদুর্ভিক্ষের গল্প, যেখানে তার পূর্বপুরুষদের এলাকায় প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষ মারা যায়। দারিদ্র্য তখনও তাড়া করছিল পরিবারকে। পাঠ্যপুস্তক তাকে “শীঘ্রই মধ্যম আয়ের দেশ” হওয়ার স্বপ্ন দেখাত, অথচ চারপাশে ছিল অভাব।

শিশু বয়সে ইউটিউবে দেখে ফেলেছিলেন ১৯৮৯ সালে তিয়েনআনমেন স্কয়ারে গণতন্ত্রকামী আন্দোলন দমন অভিযানের ভিডিও। তখন থেকেই তার মনে প্রশ্ন জমা হতে থাকে।


রাজনৈতিক ভিন্নমত ও নজরদারি

পেশায় ইলেকট্রনিকস মেরামতকারী হলেও বিদেশি ওয়েবসাইট পড়ে, টুইটারে লিখে শাসক কমিউনিস্ট পার্টির নানা সমালোচনা করতেন তাও। খাদ্য নিরাপত্তা, আয় বৈষম্য, শি জিনপিংয়ের ব্যক্তিত্বকেন্দ্রিকতা—সবকিছুই ছিল তার সমালোচনার বিষয়।

২০১৮ সালে পুলিশ তাকে ডেকে পাঠায়। শি জিনপিংয়ের মেয়াদ সীমা বাতিলের সমালোচনা করায় তাকে জরিমানা করা হয় এবং লিখিত প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য করা হয়। এরপর জাপানে ভাষা শিক্ষার ভিসায় গিয়েছিলেন, যা শেষ হয় ২০২২ সালে। তখন যুক্তরাষ্ট্রের পথ খুঁজতে শুরু করেন।


বিপজ্জনক পথ পাড়ি

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রায় ২০ হাজার ডলার নিয়ে যাত্রা শুরু করেন তিনি। ইকুয়েডর হয়ে পাড়ি জমানো যায় বলে সেই পথ বেছে নেন। দুই মাসের যাত্রায় দারিয়েন গ্যাপের ভয়ঙ্কর জঙ্গল, কলম্বিয়ার দুর্নীতি, হন্ডুরাসে প্রতারণা, মেক্সিকোয় আটকে পড়া—সবই সহ্য করেন। অবশেষে টেক্সাসে প্রবেশের পর আটক হন এবং আশ্রয়ের আবেদন করেন।

কিন্তু ডিসেম্বরেই তার আবেদন খারিজ হয়। জানুয়ারিতে বিচারকও আবেদন নাকচ করেন। হতাশ তাও আত্মহত্যার কথাও ভাবেন এবং বাবা-মাকে চিঠিতে কারণ ব্যাখ্যা করেন। মার্চ ২০২৩-এ ফেরত পাঠানোর সময় তিনি নিজেকে সিঁড়ি থেকে ফেলে দেন, হাসপাতালে ভর্তি হন, পরে আবার আটক হন। বছর শেষে আবারও বিমানে তুলে দেওয়া হয় তাকে।


চীনে ফেরার পর নিপীড়ন

দেশে ফিরেই কাস্টমস কর্মকর্তারা তার চিঠির কপি পেয়ে যান। অস্বীকার করলে তাকে চড় মারা হয়। সহযাত্রী এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে চোরাকারবারির অভিযোগ চাপিয়ে দিতে বলা হয়। বাধ্য হয়ে তাও মেনে নেন। এরপর তার পাসপোর্ট জব্দ করা হয়।

পিতামাতার সহায়তায় দক্ষিণ চীনে গিয়ে কারখানায় চাকরি নেন। কিন্তু এক মাসের মধ্যেই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা ফোন করে ডেকে পাঠান। তারা তার বাবা-মাকে পাঠানো চিঠি দেখিয়ে জানান, তিনি জাতীয় নিরাপত্তা ও ইন্টারনেট আইন ভঙ্গ করেছেন। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় অন্য কোনো বিরোধী বা বিদেশে পালাতে ইচ্ছুক লোকজনের তথ্য।


আবারও পালানোর চেষ্টা

কয়েক মাস কর্মকর্তাদের প্রশ্ন সহ্য করার পর নতুন পাসপোর্টের আবেদন করেন, কিন্তু ‘এক্সিট-ব্যান তালিকায়’ নাম থাকায় তা বাতিল হয়। পরে অন্য শহরে গিয়ে চেষ্টা করলে অবাক হয়ে দেখেন সফল হয়েছেন।

একটি শ্রম এজেন্সির মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কাজের ভিসা পান। ২০২৪ সালের অক্টোবরেই দেশ ছাড়েন। ইলেকট্রনিকস কারখানায় ১২ ঘণ্টার শিফটে কাজ করছেন। ভিসার মেয়াদ দুই বছর, এরপর ইউরোপ বা মেক্সিকোয় যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন।


স্বাধীনতার খোঁজ

তাও বলেন, তার কাছে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা। প্রতিবাদ, টুইট করা গুরুত্বপূর্ণ হলেও সবকিছু নয়। তিনি শুধু স্বাভাবিক একজন মানুষ হয়ে বাঁচতে চান।

“স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারলেই আমি সন্তুষ্ট,” বলেন তাও। “আমি শুধু চাই, জীবন বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা।”

জনপ্রিয় সংবাদ

প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার গানের জগতে ফিরে আসা: ‘লাস্ট ক্রিসমাস’ ডেসি ভার্সন নিয়ে নেটিজেনদের কটাক্ষ

স্বাধীনতার খোঁজ

০১:৪৭:৫৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২ অক্টোবর ২০২৫

দীর্ঘ যাত্রা ও ফেরত পাঠানোর আঘাত

চীনের উত্তরাঞ্চলীয় শহরে ফেরত যেতে তাওকে দুটি বিমান, তিনটি যাত্রাবিরতি ও ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় কাটাতে হয়। কিন্তু তার হাত-পা ছিল লোহার বেড়িতে বাঁধা। যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন খারিজ হওয়ায় তাকে জোর করে ফেরত পাঠানো হচ্ছিল। প্রশ্ন জাগছিল—চীনেই বা তার জন্য কী অপেক্ষা করছে?

তাও (ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে পরিবারকে রক্ষা করার জন্য) যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস সীমান্তে হাজির হয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন। আবেদন নাকচ হলে সামনে ছিল দুটি পথ—নিজ দেশে ফিরে আত্মগোপনে রাজনৈতিক মত লুকিয়ে অচল চাকরি করা, নতুবা আবারও পালানোর চেষ্টা। কিন্তু তার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত হয়েছে, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফাঁকা আর কর্তৃপক্ষের নজরে নাম উঠেছে।


শৈশব ও প্রশ্নের শুরু

১৯৯০-এর দশকে জন্ম নেওয়া তাও শৈশব থেকেই শুনেছেন ১৯৫৯ সালের মহাদুর্ভিক্ষের গল্প, যেখানে তার পূর্বপুরুষদের এলাকায় প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষ মারা যায়। দারিদ্র্য তখনও তাড়া করছিল পরিবারকে। পাঠ্যপুস্তক তাকে “শীঘ্রই মধ্যম আয়ের দেশ” হওয়ার স্বপ্ন দেখাত, অথচ চারপাশে ছিল অভাব।

শিশু বয়সে ইউটিউবে দেখে ফেলেছিলেন ১৯৮৯ সালে তিয়েনআনমেন স্কয়ারে গণতন্ত্রকামী আন্দোলন দমন অভিযানের ভিডিও। তখন থেকেই তার মনে প্রশ্ন জমা হতে থাকে।


রাজনৈতিক ভিন্নমত ও নজরদারি

পেশায় ইলেকট্রনিকস মেরামতকারী হলেও বিদেশি ওয়েবসাইট পড়ে, টুইটারে লিখে শাসক কমিউনিস্ট পার্টির নানা সমালোচনা করতেন তাও। খাদ্য নিরাপত্তা, আয় বৈষম্য, শি জিনপিংয়ের ব্যক্তিত্বকেন্দ্রিকতা—সবকিছুই ছিল তার সমালোচনার বিষয়।

২০১৮ সালে পুলিশ তাকে ডেকে পাঠায়। শি জিনপিংয়ের মেয়াদ সীমা বাতিলের সমালোচনা করায় তাকে জরিমানা করা হয় এবং লিখিত প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য করা হয়। এরপর জাপানে ভাষা শিক্ষার ভিসায় গিয়েছিলেন, যা শেষ হয় ২০২২ সালে। তখন যুক্তরাষ্ট্রের পথ খুঁজতে শুরু করেন।


বিপজ্জনক পথ পাড়ি

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রায় ২০ হাজার ডলার নিয়ে যাত্রা শুরু করেন তিনি। ইকুয়েডর হয়ে পাড়ি জমানো যায় বলে সেই পথ বেছে নেন। দুই মাসের যাত্রায় দারিয়েন গ্যাপের ভয়ঙ্কর জঙ্গল, কলম্বিয়ার দুর্নীতি, হন্ডুরাসে প্রতারণা, মেক্সিকোয় আটকে পড়া—সবই সহ্য করেন। অবশেষে টেক্সাসে প্রবেশের পর আটক হন এবং আশ্রয়ের আবেদন করেন।

কিন্তু ডিসেম্বরেই তার আবেদন খারিজ হয়। জানুয়ারিতে বিচারকও আবেদন নাকচ করেন। হতাশ তাও আত্মহত্যার কথাও ভাবেন এবং বাবা-মাকে চিঠিতে কারণ ব্যাখ্যা করেন। মার্চ ২০২৩-এ ফেরত পাঠানোর সময় তিনি নিজেকে সিঁড়ি থেকে ফেলে দেন, হাসপাতালে ভর্তি হন, পরে আবার আটক হন। বছর শেষে আবারও বিমানে তুলে দেওয়া হয় তাকে।


চীনে ফেরার পর নিপীড়ন

দেশে ফিরেই কাস্টমস কর্মকর্তারা তার চিঠির কপি পেয়ে যান। অস্বীকার করলে তাকে চড় মারা হয়। সহযাত্রী এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে চোরাকারবারির অভিযোগ চাপিয়ে দিতে বলা হয়। বাধ্য হয়ে তাও মেনে নেন। এরপর তার পাসপোর্ট জব্দ করা হয়।

পিতামাতার সহায়তায় দক্ষিণ চীনে গিয়ে কারখানায় চাকরি নেন। কিন্তু এক মাসের মধ্যেই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা ফোন করে ডেকে পাঠান। তারা তার বাবা-মাকে পাঠানো চিঠি দেখিয়ে জানান, তিনি জাতীয় নিরাপত্তা ও ইন্টারনেট আইন ভঙ্গ করেছেন। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় অন্য কোনো বিরোধী বা বিদেশে পালাতে ইচ্ছুক লোকজনের তথ্য।


আবারও পালানোর চেষ্টা

কয়েক মাস কর্মকর্তাদের প্রশ্ন সহ্য করার পর নতুন পাসপোর্টের আবেদন করেন, কিন্তু ‘এক্সিট-ব্যান তালিকায়’ নাম থাকায় তা বাতিল হয়। পরে অন্য শহরে গিয়ে চেষ্টা করলে অবাক হয়ে দেখেন সফল হয়েছেন।

একটি শ্রম এজেন্সির মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কাজের ভিসা পান। ২০২৪ সালের অক্টোবরেই দেশ ছাড়েন। ইলেকট্রনিকস কারখানায় ১২ ঘণ্টার শিফটে কাজ করছেন। ভিসার মেয়াদ দুই বছর, এরপর ইউরোপ বা মেক্সিকোয় যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন।


স্বাধীনতার খোঁজ

তাও বলেন, তার কাছে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা। প্রতিবাদ, টুইট করা গুরুত্বপূর্ণ হলেও সবকিছু নয়। তিনি শুধু স্বাভাবিক একজন মানুষ হয়ে বাঁচতে চান।

“স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারলেই আমি সন্তুষ্ট,” বলেন তাও। “আমি শুধু চাই, জীবন বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা।”