১১:২৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫

ভাষার বহুত্ব: শ্রীবিজয়ের শিলালিপিতে ইন্দোনেশীয় পরিচয়ের শেকড়

বিদেশি ভাষার ব্যবহারকে আজ প্রায়ই হুমকি হিসেবে দেখা হলেও শ্রীবিজয়ের যুগের শিলালিপি দেখায় ভিন্ন চিত্র। বহুভাষার চর্চা শুধু যোগাযোগের নয়, বরং শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তি ছিল তখনকার সমাজে।


বিদেশি ভাষার ব্যবহার কি হুমকি?

আজকের প্রজন্মে প্রায়ই প্রশ্ন ওঠে—বিদেশি ভাষার ব্যবহার কি ইন্দোনেশীয় ভাষার জন্য হুমকি? উত্তর খুঁজতে হলে ফিরে যেতে হবে শ্রীবিজয় যুগের শিলালিপিতে। এগুলো শুধু ঐতিহাসিক দলিল নয়, বরং বহুভাষিক ঐতিহ্যের প্রমাণও বটে।


প্রাচীন শিলালিপি ও ভাষার ধাঁধা

১৯৩৫ সালে পালেমবাংয়ে আবিষ্কৃত ‘তেলাগা বাতু’ শিলালিপি কুণ্ডলী পাকানো সাতটি সাপের মাথায় খোদাই করা চিত্রে সাজানো। এতে ব্যবহৃত ভাষা প্রাচীন মালয় ও সংস্কৃত। একে ঘিরেই শুরু হয় ভাষাবিদদের অনুসন্ধান।

প্রখ্যাত ইন্দোনেশীয় এপিগ্রাফার বুচারি একসময় শিলালিপির অদ্ভুত ত্রিশটি শব্দ বিশ্লেষণ করে বলেন—এটি হয়তো চিরকাল রহস্যই থেকে যাবে। তবে ফরাসি পণ্ডিত দেমাই ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন। তাঁর মতে, এটি এক ভিন্ন ধরণের প্রাচীন সুমাত্রীয় উপভাষা, যা মালয় ভাষার পাশাপাশি ব্যবহার হতো।

Raja-raja Minang di Nusantara | Afandri Adya

রহস্যময় ত্রিশটি শব্দ

শিলালিপির শুরুতে পাওয়া ত্রিশটি শব্দে ‘স’ বা ‘ও’ অক্ষরের কোনো ব্যবহার নেই। বরং ‘হ’ বারবার এসেছে, আর ‘-আই’ দ্বিস্বর সাতবার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। এই অস্বাভাবিকতা প্রথমে গবেষকদের বিভ্রান্ত করে। কিন্তু দেমাই প্রমাণ করেন, এখানে ধ্বনিগত পরিবর্তনের এক সুস্পষ্ট ধারা আছে। যেমন, মালয়ের ‘সুম্পাহ’ শব্দটি এখানে হয়ে গেছে ‘হুম্পা’।


ভাষার ফরেনসিক বিশ্লেষণ

১৯৫৬ সালে জাকার্তায় বসে দেমাই ভাষার রহস্য উদ্ঘাটন করেন। তিনি বলেন, এটি কোনো জাদুবাক্য নয়, বরং এক পৃথক উপভাষা। তাঁর গবেষণা প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে। তিনি দেখান, শিলালিপির এই শব্দরীতি আজও কিছু আধুনিক সুমাত্রীয় উপভাষায় টিকে আছে। যেমন, বেনগকুলুর মানুষ আজও ‘মিনাই’ বলে ‘মিন্তা’-কে, আর ‘তুওয়াই’ বলে ‘তুও’।


সমুদ্রপথে ভাষার নেটওয়ার্ক

চমকপ্রদ বিষয় হলো, এই ভাষা শুধু সুমাত্রায় সীমাবদ্ধ ছিল না। এর মিল পাওয়া যায় মালাগাসি, চ্যাম্পা ও বুগিস ভাষায়ও। অর্থাৎ সপ্তম শতকের সুমাত্রীয় ভাষা বিশাল সমুদ্রবাণিজ্যিক নেটওয়ার্কের অংশ ছিল, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে মাদাগাস্কার পর্যন্ত বিস্তৃত।

9 Prasasti Peninggalan Kerajaan Sriwijaya, Isi, dan Gambarnya

বহু ভাষার ব্যবহার ও শ্রীবিজয়ের শক্তি

শ্রীবিজয়ের শিলালিপিগুলোয় তিনটি ভাষার ব্যবহার দেখা যায়—সংস্কৃত (ধর্মীয় ভাষা), মালয় (প্রশাসনিক ভাষা), আর “ভাষা-বি” নামে পরিচিত উপভাষা (আচার ও মন্ত্রের ভাষা)। এভাবে বহুভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে তারা স্থানীয় পরিচয় রক্ষা করেও বৈশ্বিক নেটওয়ার্কে সক্রিয় ছিল।

আজকের ইন্দোনেশীয় ভাষায়ও সেই ধারাবাহিকতা দেখা যায়। ‘কাদাতুয়ান’ থেকে ‘কেদাতোন’, ‘বানুয়া’ থেকে ‘বেনুয়া’—এমন বহু শব্দ আজও ব্যবহৃত হচ্ছে।


বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিকতা

আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে যেখানে বহুভাষা ব্যবহারে বিভ্রান্তি বা বিভাজন তৈরি হতে পারে, শ্রীবিজয়ের শিলালিপি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—বহুত্বই শক্তি। প্রাচীন সমাজে যেমন কোড-সুইচিং (ভাষা পরিবর্তন) ছিল স্বাভাবিক, আজও তা বিদ্যমান। ইন্দোনেশীয় ও ইংরেজি কিংবা আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণ আসলে সেই ঐতিহ্যেরই ধারাবাহিকতা।

এই শিলালিপিগুলো কেবল পাথরে খোদাই করা শব্দ নয়; এগুলো বহুসাংস্কৃতিক কথোপকথনের জীবন্ত দলিল, যা আজকের ইন্দোনেশীয় ভাষার শেকড়ে প্রাণ সঞ্চার করেছে।

#শ্রীবিজয় #ইন্দোনেশিয়া #ভাষারইতিহাস #সংস্কৃতি #শিলালিপি #।

জনপ্রিয় সংবাদ

ভাষার বহুত্ব: শ্রীবিজয়ের শিলালিপিতে ইন্দোনেশীয় পরিচয়ের শেকড়

০৪:০০:১৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৮ অক্টোবর ২০২৫

বিদেশি ভাষার ব্যবহারকে আজ প্রায়ই হুমকি হিসেবে দেখা হলেও শ্রীবিজয়ের যুগের শিলালিপি দেখায় ভিন্ন চিত্র। বহুভাষার চর্চা শুধু যোগাযোগের নয়, বরং শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তি ছিল তখনকার সমাজে।


বিদেশি ভাষার ব্যবহার কি হুমকি?

আজকের প্রজন্মে প্রায়ই প্রশ্ন ওঠে—বিদেশি ভাষার ব্যবহার কি ইন্দোনেশীয় ভাষার জন্য হুমকি? উত্তর খুঁজতে হলে ফিরে যেতে হবে শ্রীবিজয় যুগের শিলালিপিতে। এগুলো শুধু ঐতিহাসিক দলিল নয়, বরং বহুভাষিক ঐতিহ্যের প্রমাণও বটে।


প্রাচীন শিলালিপি ও ভাষার ধাঁধা

১৯৩৫ সালে পালেমবাংয়ে আবিষ্কৃত ‘তেলাগা বাতু’ শিলালিপি কুণ্ডলী পাকানো সাতটি সাপের মাথায় খোদাই করা চিত্রে সাজানো। এতে ব্যবহৃত ভাষা প্রাচীন মালয় ও সংস্কৃত। একে ঘিরেই শুরু হয় ভাষাবিদদের অনুসন্ধান।

প্রখ্যাত ইন্দোনেশীয় এপিগ্রাফার বুচারি একসময় শিলালিপির অদ্ভুত ত্রিশটি শব্দ বিশ্লেষণ করে বলেন—এটি হয়তো চিরকাল রহস্যই থেকে যাবে। তবে ফরাসি পণ্ডিত দেমাই ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন। তাঁর মতে, এটি এক ভিন্ন ধরণের প্রাচীন সুমাত্রীয় উপভাষা, যা মালয় ভাষার পাশাপাশি ব্যবহার হতো।

Raja-raja Minang di Nusantara | Afandri Adya

রহস্যময় ত্রিশটি শব্দ

শিলালিপির শুরুতে পাওয়া ত্রিশটি শব্দে ‘স’ বা ‘ও’ অক্ষরের কোনো ব্যবহার নেই। বরং ‘হ’ বারবার এসেছে, আর ‘-আই’ দ্বিস্বর সাতবার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। এই অস্বাভাবিকতা প্রথমে গবেষকদের বিভ্রান্ত করে। কিন্তু দেমাই প্রমাণ করেন, এখানে ধ্বনিগত পরিবর্তনের এক সুস্পষ্ট ধারা আছে। যেমন, মালয়ের ‘সুম্পাহ’ শব্দটি এখানে হয়ে গেছে ‘হুম্পা’।


ভাষার ফরেনসিক বিশ্লেষণ

১৯৫৬ সালে জাকার্তায় বসে দেমাই ভাষার রহস্য উদ্ঘাটন করেন। তিনি বলেন, এটি কোনো জাদুবাক্য নয়, বরং এক পৃথক উপভাষা। তাঁর গবেষণা প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে। তিনি দেখান, শিলালিপির এই শব্দরীতি আজও কিছু আধুনিক সুমাত্রীয় উপভাষায় টিকে আছে। যেমন, বেনগকুলুর মানুষ আজও ‘মিনাই’ বলে ‘মিন্তা’-কে, আর ‘তুওয়াই’ বলে ‘তুও’।


সমুদ্রপথে ভাষার নেটওয়ার্ক

চমকপ্রদ বিষয় হলো, এই ভাষা শুধু সুমাত্রায় সীমাবদ্ধ ছিল না। এর মিল পাওয়া যায় মালাগাসি, চ্যাম্পা ও বুগিস ভাষায়ও। অর্থাৎ সপ্তম শতকের সুমাত্রীয় ভাষা বিশাল সমুদ্রবাণিজ্যিক নেটওয়ার্কের অংশ ছিল, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে মাদাগাস্কার পর্যন্ত বিস্তৃত।

9 Prasasti Peninggalan Kerajaan Sriwijaya, Isi, dan Gambarnya

বহু ভাষার ব্যবহার ও শ্রীবিজয়ের শক্তি

শ্রীবিজয়ের শিলালিপিগুলোয় তিনটি ভাষার ব্যবহার দেখা যায়—সংস্কৃত (ধর্মীয় ভাষা), মালয় (প্রশাসনিক ভাষা), আর “ভাষা-বি” নামে পরিচিত উপভাষা (আচার ও মন্ত্রের ভাষা)। এভাবে বহুভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে তারা স্থানীয় পরিচয় রক্ষা করেও বৈশ্বিক নেটওয়ার্কে সক্রিয় ছিল।

আজকের ইন্দোনেশীয় ভাষায়ও সেই ধারাবাহিকতা দেখা যায়। ‘কাদাতুয়ান’ থেকে ‘কেদাতোন’, ‘বানুয়া’ থেকে ‘বেনুয়া’—এমন বহু শব্দ আজও ব্যবহৃত হচ্ছে।


বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিকতা

আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে যেখানে বহুভাষা ব্যবহারে বিভ্রান্তি বা বিভাজন তৈরি হতে পারে, শ্রীবিজয়ের শিলালিপি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—বহুত্বই শক্তি। প্রাচীন সমাজে যেমন কোড-সুইচিং (ভাষা পরিবর্তন) ছিল স্বাভাবিক, আজও তা বিদ্যমান। ইন্দোনেশীয় ও ইংরেজি কিংবা আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণ আসলে সেই ঐতিহ্যেরই ধারাবাহিকতা।

এই শিলালিপিগুলো কেবল পাথরে খোদাই করা শব্দ নয়; এগুলো বহুসাংস্কৃতিক কথোপকথনের জীবন্ত দলিল, যা আজকের ইন্দোনেশীয় ভাষার শেকড়ে প্রাণ সঞ্চার করেছে।

#শ্রীবিজয় #ইন্দোনেশিয়া #ভাষারইতিহাস #সংস্কৃতি #শিলালিপি #।