০১:১২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১১ অক্টোবর ২০২৫
চীনে এনবিএর প্রত্যাবর্তন: ম্যাকাওতে প্রাক-মৌসুমে নেটস–সানস, সম্পর্কের নতুন অধ্যায় আদানি গ্রুপের নতুন উদ্যোগ: নবি মুম্বাই বিমানবন্দরের দ্বিতীয় টার্মিনাল নির্মাণ ইংল্যান্ডের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় ‘ভুলে যাওয়া রাজা অ্যাথেলস্টানকে শ্রদ্ধা জানাতে শত মাইলের নতুন ভ্রমণ পথ ‘ দেশের হারিয়ে যাওয়া লাল ডাকবাক্স: ডিজিটাল যুগে বিলুপ্ত চিঠির স্মৃতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঢাকা (পর্ব-৩৩) শরৎ বাধা পেল, বসন্ত কি আসতে পারবে? মোদী-ট্রাম্প বৈঠক: ভারতের জন্য নতুন সম্ভাবনা ইসরাইল ও হামাস কী কী ছাড় দিয়েছে গাজায় বন্দি–যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছাতে? সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের খ্যাতি ছিল একাধারে শিক্ষক, লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সরেজমিন খাগড়াছড়ি: একদিকে ক্ষোভ-আতঙ্ক, আরেকদিকে নজরদারি

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের খ্যাতি ছিল একাধারে শিক্ষক, লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষক এসএমআই বা মঞ্জু স্যারই 'প্রাণের শিক্ষক' হিসেবে ভূমিকা রাখেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষকএবং লেখক, সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মারা গেছেন।

শুক্রবার বিকেল ৫টার দিকে ঢাকার এই বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

গত ৩রা অক্টোবর ঢাকার ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশে (ইউল্যাব) যাওয়ার পথে গাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।

পরে তাকে পার্শ্ববর্তী একটি হাসপাতালে এবং সেখান থেকে ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

পরীক্ষা-নিরীক্ষার করে চিকিৎসকরা জানান, তার ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। এরপর অস্ত্রোপচার করে হার্টে স্টেন্টিং করা (রিং পরানো) হয়।

এর পর থেকেই সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে বলে চিকিৎসকরা জানিয়ে এসেছেন।

তার অক্সিজেন লেভেল কমতে থাকে, ফুসফুসে পানি জমতে শুরু করে। পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে থাকলে রোববার সন্ধ্যায় তাকে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়।

প্রায় ৪৮ ঘণ্টা লাইফ সাপোর্টে থাকার পর তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। তবে পরে আবার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে পুনরায় লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়।

শুক্রবার বিকেল ৫টায় চিকিৎসকেরা লাইফ সাপোর্ট সরিয়ে নিয়ে তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে জানা যায়।

তার মরদেহ আজ বারডেমের হিমঘরে রাখা হবে বলে তার পরিবার, বন্ধু ও স্বজনেরা জানিয়েছেন।

সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য শনিবার সকাল ১১টায় তার মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হবে।

এরপর বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা হবে। পরে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করার কথা রয়েছে

শিক্ষক সৈয়দ মনজুরুল লেখক-সাহিত্যিক হিসেবেই বেশি পরিচিতি পেয়েছিলেন

শিক্ষাবিদ পরিচয় ছাড়াও সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের বিচরণ ছিল বাংলা সাহিত্য ও মুক্ত চিন্তার জগতে। লেখক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক হিসেবেও ব্যাপক পরিচিত তিনি।

তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন ৪৩ বছর। তিনি সর্বশেষ বিশ্ববিদ্যালয়টির ইমেরিটাস অধ্যাপক ছিলেন।

সত্তরের দশকে বাংলার সাহিত্যে বিচরণ শুরু হয় এই শিক্ষক ও লেখকের। এরপর দেড় দশকের দীর্ঘ স্বেচ্ছা বিরতি দিয়েছিলেন।

তবে আশির দশকে আবার একেবারে ভিন্ন রূপে সাহিত্যে পদচারণা শুরু করেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।

এবার লেখালেখির জগতে বিশেষত ‘গল্পে’ নিয়মিত হয়েছেন এই লেখক।

সাহিত্য জগতে তার সহকর্মী ও বন্ধুরা জানান, এবার প্রথাগত গল্পধারার বাইরে বেরিয়ে এসে এক ভিন্ন শৈলীতে লিখতে শুরু করেন তিনি।

অত্যন্ত, সহজ, সাবলীল ভাষায় লেখা তার গল্পগুলো সবসময় পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে- বিষয়টি এমন নয় বলে জানিয়েছেন কথা সাহিত্যিক ও লেখক মঈনুল আহসান সাবের।

কিন্তু কোনো দশকওয়ারি বিভাজনে না পড়েও বাংলা গল্প সাহিত্যের প্রথম সারির একজন লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।

সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম।

কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮১ সালে ইয়েটস এর কবিতায় ইমানুয়েল সুইডেনবার্গের দর্শনের প্রভাব বিষয়ে পিএইচডি করেন এই শিক্ষক।

জন্ম, শৈশব ও শিক্ষা জীবন

সিলেটে ১৯৫১ সালে জন্মগ্রহণ করেন এই লেখক ও শিক্ষক। বাবা সৈয়দ আমীরুল ইসলাম ও মা রাবেয়া খাতুন।

সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ সালের মাধ্যমিক পাস করেন তিনি।

দুই বছর পরে সিলেট এমসি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন।

পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭১ সালে স্নাতক ও পরের বছরই বাহাত্তর সালে স্নাতকোত্তর শেষ করেন।

কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮১ সালে ইয়েটস এর কবিতায় ইমানুয়েল সুইডেনবার্গের দর্শনের প্রভাব বিষয়ে পিএইচডি করেন এই শিক্ষক।

কর্মজীবন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে মূল পেশাগত জীবন পার করেছেন সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন তিনি।

দীর্ঘদিনের কর্মজীবন শেষে ২০১৭ সালের জুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অবসর নেন এই শিক্ষক।

এরপর ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ, বেসরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন তিনি।

পরে ২০২৩ সালের ২৭শে অগাস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে ‘ইমেরিটাস অধ্যাপক’ করে।

ব্যক্তি জীবনে এক সন্তানের জনক লেখক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম। ছেলে এখন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন।

ছাত্র হিসেবে নিজ শিক্ষকের কাছে কেমন ছিলেন?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন যাদের শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন তিনি, একই বিভাগে যোগদান করার পর তাদের কয়েকজনকেই সহকর্মী হিসেবেও পেয়েছেন।

এমনই একজন শিক্ষক ও তার সহকর্মী বরেণ্য শিক্ষাবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এ এফ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

মি. চৌধুরী জানান, যেসব মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে তিনি গর্ব বোধ করেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন গল্পকার সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম।

“খুবই মেধাবী ছাত্র ছিলো। আমি যেসব ছাত্রদের নিয়ে গর্ব করি তাদের মধ্যে একজন মনজুরুল। প্রথমে তাকে ছাত্র হিসেবে পেয়েছি পরে সহকর্মী হিসেবে” বলেন মি. চৌধুরী।

উত্তরাধিকার সূত্রে শিক্ষক বাবার মতো কর্মজীবনে শিক্ষকতা পেশাকেই তিনি বেছে নিয়েছেন।

“শিক্ষকতাটাকেই পেশা হিসেবে নেয়া তার জন্য স্বাভাবিক ছিল। অন্য কোনো পেশাতে সে যায়নি, তার সাথে মানাতোও না” বলেন ইমেরিটাস অধ্যাপক মি. চৌধুরী।

গবেষণা, সাহিত্যচর্চা, লেখালেখি তার বেশ আগ্রহের জায়গা ছিলো বলেও মনে করেন এই শিক্ষক।

সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামের শিক্ষক এবং সহকর্মী মি. চৌধুরী মনে করেন, শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের মাঝেও বেশ জনপ্রিয় তার এই ছাত্র।

বইয়ের প্রচ্ছদ

স্বেচ্ছা বিরতির দেড় দশক পর ১৯৮৯ সালে, ঈদসংখ্যা বিচিন্তায় একটি গল্পের মধ্য দিয়ে সাহিত্যের জগতে আবার পদার্পণ করেন এই লেখক।

শিক্ষার্থীদের ‘এসএমআই’ স্যার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষার্থীদের কাছে মনজুরুল স্যার বা নামের আদ্যোক্ষর দিয়ে এসএমআই স্যার নামে বেশ জনপ্রিয় তিনি।

শিক্ষার্থীরা মনে করেন, এই শিক্ষকের রয়েছে ছাত্রকে চমকে দেওয়ার বিস্ময়কর ক্ষমতা।

লেখক আনিসুল হকের স্ত্রী মেরিনা ইয়াসমীন ছিলেন তার ইংরেজী বিভাগের ছাত্রী।

এক লেখায় মি. হক লিখেছেন, ” তিনি যখন বৃত্তি নিয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য বিদেশে যাবেন, তখন ছাত্রছাত্রীরা ভীষণ কান্নাকাটি করেছিলেন। সংবর্ধনার অনুষ্ঠানটিতে অভিনন্দন জানানোর উচ্ছ্বাসের জায়গা দখল করেছিল শিক্ষার্থীদের অশ্রুপাত।”

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সাবেক ছাত্র ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শেখ হাফিজুর রহমান সজল তাকে শুধু শিক্ষক বা গুরুই নয় বরং অভিভাবক হিসেবেই মনে করেন।

তিনি জানান, মনজুরুল স্যারের শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল অন্য শিক্ষকদের থেকে একদমই আলাদা।

স্যারের অসাধারণ বলারভঙ্গী আর ব্যতিক্রমী স্টাইল যা ইদানিংকালের শিক্ষকদের মাঝে ভীষণভাবে অনুপস্থিত।

” এসএমআই স্যারের ক্লাসে অসংখ্য সমকালীন উদাহরণের উপস্থিতি থাকে যা শিক্ষার্থীদের জন্য বুঝতে সহায়ক হয়। স্যারের প্রতিটি ক্লাস ইংরেজি সাহিত্যের সাথে ইতিহাস, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সাহিত্য ধারা ও সমকালীন বাস্তবতার সেতু বন্ধন ছিল ” বলেন তিনি।

সাহিত্যে প্রবেশ ও হঠাৎ ছন্দপতন

বাংলা কথা সাহিত্যে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের পথচলা সত্তরের দশকে। ১৯৭৩ সালে বিচিত্রায় প্রকাশিত একটি গল্পের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ হয় গল্পকার তার।

কিন্তু এরপর দীর্ঘ স্বেচ্ছা বিরতি।

স্বেচ্ছা বিরতির দেড় দশক পর ১৯৮৯ সালে, ঈদসংখ্যা বিচিন্তায় একটি গল্পের মধ্য দিয়ে সাহিত্যের জগতে আবার পদার্পণ করেন এই লেখক।

এবার যেন সাহিত্যে আগের বিরতি পুষিয়ে দিতেই আরো বলিষ্ঠ পদচারণা এই গল্পকারের।

সাহিত্যিকদের মতে, সত্তরের দশকে মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, সামরিক শাসনের দুঃসহ বাস্তবতা, দারিদ্র্য, বেকার সমস্যা, নারী নির্যাতন, সন্ত্রাস প্রভৃতির প্রভাব পড়ে ছোটগল্পে।

বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই লিখেছেন তিনি।

লেখক - সাহিত্যিকদের এক সংগঠনের সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম

মঈনুল আহসান সাবের বিবিসি বাংলাকে বলেন, ” আমি মনে করি তার মূল পরিচিতিটা মূলত লেখক, আমার কাছে অন্তত।”

‘বাস্তবতার গল্পকারে’র পথচলা

কথা সাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী গল্পকারদের অন্যতম। যিনি সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের বন্ধু, সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ী।

এই লেখকের কাছে অবশ্য সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের শিক্ষক পরিচয় ছাপিয়ে গেছে লেখক পরিচয়ে।

মি. সাবের বিবিসি বাংলাকে বলেন, ” আমি মনে করি তার মূল পরিচিতিটা মূলত লেখক, আমার কাছে অন্তত।”

ভিন্ন ধারার গল্পকার হিসেবেই তিনি মি. ইসলামকে আখ্যায়িত করেন।

” জাদু বাস্তবতা চমৎকারভাবে তার লেখায় কাজ করে। আমি গল্পের কথাই বলি মূলত। আমার মনে হয় গল্পেই তিনি সবচেয়ে বেশি সফল হয়েছেন। জাদু বাস্তবতা একেবারে যখন আমাদের দেশে চর্চা শুরু হয়নি তখন তিনি সেটার চর্চা শুরু করেন ” বলেন মি. সাবের।

বাস্তবতার গল্প খুব সহজে, অবলীলায়, কোথাও কোনো রকম বাধা বা ধাক্কা না দিয়ে সহজভাবে তৈরি করার ক্ষেত্রে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গল্পগুলো একটা নিদর্শন বলে মনে করেন এই লেখক।

মঈনুল আহসান সাবের বলেন, ” হার্ড বা ক্রুয়েল রিয়েলিটি অর্থাৎ নিষ্ঠুর বাস্তবতা কিন্তু তিনি লিখছেন খুবই সহজভাবে। এটাও তার একটা বৈশিষ্ট্য। এটা আমাদের এখানকার সাহিত্যে প্রায় নেই।”

গল্পের ভাষা সাবলীল হওয়া এবং কোথাও নিজেকে জাহির না করার বড় গুণ রয়েছে গল্পকার অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের।

” আমার মনে হয় জাদু বাস্তবতা এবং নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে অবলীলায় কোনো রকম সম্পৃক্ত হওয়া ছাড়া তিনি তুলে আনছেন। তার উপস্থিতি কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই যে বিচ্ছিন্ন থাকা, এইটা একটা খুবই বড় গুণ। আমার কাছে এই দুইটাই তার লেখার সবচেয়ে বড় ব্যাপার ” বলেন মি. সাবের।

পুরষ্কার ও পদক

গল্পকার সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম জীবনে রাষ্ট্রীয় পুরষ্কারসহ সাহিত্যের অনেক সম্মানজনক পুরষ্কারই পেয়েছেন।

সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৮ সালে পান একুশে পদক তিনি। ১৯৯৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন তিনি। ‘নন্দনতত্ত্ব’ বইটির জন্য এই পুরষ্কার।

‘প্রেম ও প্রার্থনার গল্প’ এর জন্য পেয়েছেন ১৪১১ সালের প্রথম আলো বর্ষসেরা বই’ এর পুরস্কার এবং কাগজ সাহিত্য পুরস্কার-২০০৬।

বাংলা সাহিত্যে তার অবদানের জন্য ২০১৬ সালে কাজী মাহবুবুল্লাহ পুরস্কারে ভূষিত হন।

তার বই

বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষকতার সহকর্মী, লেখক সহকর্মী সকলের কাছেই ব্যক্তি হিসেবে মঞ্জুরুল ইসলাম ছিলেন অত্যন্ত সদালাপী, আন্তরিক।

‘ব্যক্তি মনজুরুল ছিলেন অসাধারণ’

বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষকতার সহকর্মী, লেখক সহকর্মী সকলের কাছেই ব্যক্তি হিসেবে মনজুরুল ইসলাম ছিলেন অত্যন্ত সদালাপী, আন্তরিক।

তার লেখক বন্ধু মি. সাবেরের ভাষায়, ” অসাধারণ। তিনি মানুষকে মূল্য দিতে জানেন। এটা হচ্ছে তার সবচেয়ে বড় গুণ। দীর্ঘ সময়ে আমি কখনো দেখিনি কোনো মানুষকে তাচ্ছিল্য করছেন। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে এটা মেকি না। এটা তার ভেতরেই ছিল, চেষ্টা করে করেছেন এমনটা না।”

সহজাতভাবেই বন্ধুবৎসল, সদালাপী স্বভাবের লেখক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।

কাজের প্রতি ভীষণ নিষ্ঠাবান লেখক মি. ইসলাম।

উদাহরণ দিতে গিয়ে লেখক মঈনুল আহসান সাবের জানান, হয়তো কোথাও ঘুরতে গিয়ে রাত বারোটা বা একটা পর্যন্ত আড্ডা চলছিল। এক পর্যায়ে সবাই ঘুমাতে গেল।

” কিন্তু হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে দেখতাম মঞ্জু ভাই কাজ করছেন। হয়তো সে কাজের জন্য সময় চেয়ে নেওয়া যেতো কিন্তু সেটা করতেন না। কাজ শেষ করতেন ” বলেন এই লেখক।

‘চিত্র সমালোচক’ হিসেবে প্রসিদ্ধ

সাহিত্যের বিভিন্ন জগতেই কেবলমাত্র লেখালেখি নয় বরং চিত্র সমালোচক হিসেবেও খ্যাতি রয়েছে সৈয়দ মমনজুরুল ইসলামের।

বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকী, সংবাদপত্র বা বইয়ে চিত্রকলার ভাষা নিয়ে অনেক লেখা রয়েছে।

লেখক মনজুরুল ইসলাম প্রখর শিল্পবোধ সম্পন্ন এবং শিল্প বা চিত্রকলার প্রতি বেশ অনুরাগী বলে জানান তার শিক্ষক ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

সাহিত্য সাময়িকী কালি ও কলম এ তার এক লেখায় চিত্রশিল্পের প্রতি এই অনুরাগের কথা ফুটে উঠেছে।

তিনি লিখেছেন, ” ছবির ভাষার কোনো সুনির্দিষ্ট বাক্য বিন্যাস নেই, মুখের ভাষায় যা আছে; কোনো শব্দভাণ্ডার নেই, মুখের ভাষায় যা আছে; প্রকাশ-বহুত্বও নেই, মুখের ভাষায় যা আছে। প্রশ্ন হলো, এগুলো যদি না থাকে, তাহলে ছবির ভাষা আমরা কিভাবে বুঝি? এমনকি বিমূর্ত ছবির?”

ঢাকায় বিভিন্ন আর্ট গ্যালারি অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলা প্রদর্শনীতেও তার দেখা মেলে প্রায়শই।

শিল্পবোদ্ধা হিসেবে তার চিত্র সমালোচক ভূমিকার বিষয়ে বলতে গিয়ে লেখক মঈনুল আহসান সাবের জানান, ১৯৯৬ সালে একই বছর দুই জনই বাংলা একাডেমি পুরষ্কার পান।

চিত্র সমালোচনা পছন্দ করতেন তিনি।

” তখন মঞ্জু ভাইয়ের যে বইটি বেরিয়েছে সেটি নন্দন তত্ত্বের উপরে। ফলে অ্যাস্থেটিকস নিয়ে তার একটা চিন্তা-ভাবনা বহু আগে থেকেই কাজ করছে। আমার মনে হয় সেটাই তাকে চিত্রকর্ম বা চিত্র সমালোচনার প্রতি আকৃষ্ট করেছে।”

শুধু তাই নয় বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পীদের সাথে তার বন্ধুত্বেই তার শিল্প অনুরাগী হওয়ার কথা প্রমাণ করে। যেমনটা বলছিলেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মনিরুল ইসলাম।

বাংলাদেশী এই শিল্পী এখন মূলত স্পেনেই বসবাস করেন। তবে দেশেও আসেন নিয়মিত।

মি. ইসলামের সাথে যখন কথা বলছিলাম তখন তিনি স্পেনে অবস্থান করছেন।

তিনি জানান, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তার ৪০ বছরের বন্ধু।

” মনজুরুল ইসলামকে আমি চিনি প্রায় ৩৫-৪০ বছর। তখন একটা মাত্র গ্যালারি ছিল। আসা-যাওয়া করতো ফয়েজ ভাইয়ের শিল্পাঙ্গন গ্যালারিতে ” বলেন তিনি।

এই চিত্রশিল্পী জানান, চিত্রশিল্পীদের আঁকা বিমূর্ত শিল্পকে সাহিত্যের ভাষায় বন্দনা করেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।

” শিল্পের এক রূপের সাথে আরেক রূপের সংযোগ স্থাপন করেন উনি। শিল্পের রূপগুলা কিন্তু আলাদা না। এই জায়গাতে তার ইন্টারেস্টের সাথে পড়াশোনার মাধ্যমে পারফেকশনে চলে এসেছে ” বলেন এই শিল্পী মনিরুল ইসলাম।

বিবিসি নিউজ বাংলা

জনপ্রিয় সংবাদ

চীনে এনবিএর প্রত্যাবর্তন: ম্যাকাওতে প্রাক-মৌসুমে নেটস–সানস, সম্পর্কের নতুন অধ্যায়

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের খ্যাতি ছিল একাধারে শিক্ষক, লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে

০৭:২৪:৪৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১০ অক্টোবর ২০২৫

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষকএবং লেখক, সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মারা গেছেন।

শুক্রবার বিকেল ৫টার দিকে ঢাকার এই বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

গত ৩রা অক্টোবর ঢাকার ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশে (ইউল্যাব) যাওয়ার পথে গাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।

পরে তাকে পার্শ্ববর্তী একটি হাসপাতালে এবং সেখান থেকে ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

পরীক্ষা-নিরীক্ষার করে চিকিৎসকরা জানান, তার ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। এরপর অস্ত্রোপচার করে হার্টে স্টেন্টিং করা (রিং পরানো) হয়।

এর পর থেকেই সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে বলে চিকিৎসকরা জানিয়ে এসেছেন।

তার অক্সিজেন লেভেল কমতে থাকে, ফুসফুসে পানি জমতে শুরু করে। পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে থাকলে রোববার সন্ধ্যায় তাকে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়।

প্রায় ৪৮ ঘণ্টা লাইফ সাপোর্টে থাকার পর তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। তবে পরে আবার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে পুনরায় লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়।

শুক্রবার বিকেল ৫টায় চিকিৎসকেরা লাইফ সাপোর্ট সরিয়ে নিয়ে তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে জানা যায়।

তার মরদেহ আজ বারডেমের হিমঘরে রাখা হবে বলে তার পরিবার, বন্ধু ও স্বজনেরা জানিয়েছেন।

সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য শনিবার সকাল ১১টায় তার মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হবে।

এরপর বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা হবে। পরে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করার কথা রয়েছে

শিক্ষক সৈয়দ মনজুরুল লেখক-সাহিত্যিক হিসেবেই বেশি পরিচিতি পেয়েছিলেন

শিক্ষাবিদ পরিচয় ছাড়াও সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের বিচরণ ছিল বাংলা সাহিত্য ও মুক্ত চিন্তার জগতে। লেখক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক হিসেবেও ব্যাপক পরিচিত তিনি।

তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন ৪৩ বছর। তিনি সর্বশেষ বিশ্ববিদ্যালয়টির ইমেরিটাস অধ্যাপক ছিলেন।

সত্তরের দশকে বাংলার সাহিত্যে বিচরণ শুরু হয় এই শিক্ষক ও লেখকের। এরপর দেড় দশকের দীর্ঘ স্বেচ্ছা বিরতি দিয়েছিলেন।

তবে আশির দশকে আবার একেবারে ভিন্ন রূপে সাহিত্যে পদচারণা শুরু করেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।

এবার লেখালেখির জগতে বিশেষত ‘গল্পে’ নিয়মিত হয়েছেন এই লেখক।

সাহিত্য জগতে তার সহকর্মী ও বন্ধুরা জানান, এবার প্রথাগত গল্পধারার বাইরে বেরিয়ে এসে এক ভিন্ন শৈলীতে লিখতে শুরু করেন তিনি।

অত্যন্ত, সহজ, সাবলীল ভাষায় লেখা তার গল্পগুলো সবসময় পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে- বিষয়টি এমন নয় বলে জানিয়েছেন কথা সাহিত্যিক ও লেখক মঈনুল আহসান সাবের।

কিন্তু কোনো দশকওয়ারি বিভাজনে না পড়েও বাংলা গল্প সাহিত্যের প্রথম সারির একজন লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।

সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম।

কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮১ সালে ইয়েটস এর কবিতায় ইমানুয়েল সুইডেনবার্গের দর্শনের প্রভাব বিষয়ে পিএইচডি করেন এই শিক্ষক।

জন্ম, শৈশব ও শিক্ষা জীবন

সিলেটে ১৯৫১ সালে জন্মগ্রহণ করেন এই লেখক ও শিক্ষক। বাবা সৈয়দ আমীরুল ইসলাম ও মা রাবেয়া খাতুন।

সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ সালের মাধ্যমিক পাস করেন তিনি।

দুই বছর পরে সিলেট এমসি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন।

পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭১ সালে স্নাতক ও পরের বছরই বাহাত্তর সালে স্নাতকোত্তর শেষ করেন।

কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮১ সালে ইয়েটস এর কবিতায় ইমানুয়েল সুইডেনবার্গের দর্শনের প্রভাব বিষয়ে পিএইচডি করেন এই শিক্ষক।

কর্মজীবন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে মূল পেশাগত জীবন পার করেছেন সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন তিনি।

দীর্ঘদিনের কর্মজীবন শেষে ২০১৭ সালের জুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অবসর নেন এই শিক্ষক।

এরপর ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ, বেসরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন তিনি।

পরে ২০২৩ সালের ২৭শে অগাস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে ‘ইমেরিটাস অধ্যাপক’ করে।

ব্যক্তি জীবনে এক সন্তানের জনক লেখক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম। ছেলে এখন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন।

ছাত্র হিসেবে নিজ শিক্ষকের কাছে কেমন ছিলেন?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন যাদের শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন তিনি, একই বিভাগে যোগদান করার পর তাদের কয়েকজনকেই সহকর্মী হিসেবেও পেয়েছেন।

এমনই একজন শিক্ষক ও তার সহকর্মী বরেণ্য শিক্ষাবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এ এফ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

মি. চৌধুরী জানান, যেসব মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে তিনি গর্ব বোধ করেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন গল্পকার সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম।

“খুবই মেধাবী ছাত্র ছিলো। আমি যেসব ছাত্রদের নিয়ে গর্ব করি তাদের মধ্যে একজন মনজুরুল। প্রথমে তাকে ছাত্র হিসেবে পেয়েছি পরে সহকর্মী হিসেবে” বলেন মি. চৌধুরী।

উত্তরাধিকার সূত্রে শিক্ষক বাবার মতো কর্মজীবনে শিক্ষকতা পেশাকেই তিনি বেছে নিয়েছেন।

“শিক্ষকতাটাকেই পেশা হিসেবে নেয়া তার জন্য স্বাভাবিক ছিল। অন্য কোনো পেশাতে সে যায়নি, তার সাথে মানাতোও না” বলেন ইমেরিটাস অধ্যাপক মি. চৌধুরী।

গবেষণা, সাহিত্যচর্চা, লেখালেখি তার বেশ আগ্রহের জায়গা ছিলো বলেও মনে করেন এই শিক্ষক।

সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামের শিক্ষক এবং সহকর্মী মি. চৌধুরী মনে করেন, শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের মাঝেও বেশ জনপ্রিয় তার এই ছাত্র।

বইয়ের প্রচ্ছদ

স্বেচ্ছা বিরতির দেড় দশক পর ১৯৮৯ সালে, ঈদসংখ্যা বিচিন্তায় একটি গল্পের মধ্য দিয়ে সাহিত্যের জগতে আবার পদার্পণ করেন এই লেখক।

শিক্ষার্থীদের ‘এসএমআই’ স্যার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষার্থীদের কাছে মনজুরুল স্যার বা নামের আদ্যোক্ষর দিয়ে এসএমআই স্যার নামে বেশ জনপ্রিয় তিনি।

শিক্ষার্থীরা মনে করেন, এই শিক্ষকের রয়েছে ছাত্রকে চমকে দেওয়ার বিস্ময়কর ক্ষমতা।

লেখক আনিসুল হকের স্ত্রী মেরিনা ইয়াসমীন ছিলেন তার ইংরেজী বিভাগের ছাত্রী।

এক লেখায় মি. হক লিখেছেন, ” তিনি যখন বৃত্তি নিয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য বিদেশে যাবেন, তখন ছাত্রছাত্রীরা ভীষণ কান্নাকাটি করেছিলেন। সংবর্ধনার অনুষ্ঠানটিতে অভিনন্দন জানানোর উচ্ছ্বাসের জায়গা দখল করেছিল শিক্ষার্থীদের অশ্রুপাত।”

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সাবেক ছাত্র ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শেখ হাফিজুর রহমান সজল তাকে শুধু শিক্ষক বা গুরুই নয় বরং অভিভাবক হিসেবেই মনে করেন।

তিনি জানান, মনজুরুল স্যারের শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল অন্য শিক্ষকদের থেকে একদমই আলাদা।

স্যারের অসাধারণ বলারভঙ্গী আর ব্যতিক্রমী স্টাইল যা ইদানিংকালের শিক্ষকদের মাঝে ভীষণভাবে অনুপস্থিত।

” এসএমআই স্যারের ক্লাসে অসংখ্য সমকালীন উদাহরণের উপস্থিতি থাকে যা শিক্ষার্থীদের জন্য বুঝতে সহায়ক হয়। স্যারের প্রতিটি ক্লাস ইংরেজি সাহিত্যের সাথে ইতিহাস, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সাহিত্য ধারা ও সমকালীন বাস্তবতার সেতু বন্ধন ছিল ” বলেন তিনি।

সাহিত্যে প্রবেশ ও হঠাৎ ছন্দপতন

বাংলা কথা সাহিত্যে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের পথচলা সত্তরের দশকে। ১৯৭৩ সালে বিচিত্রায় প্রকাশিত একটি গল্পের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ হয় গল্পকার তার।

কিন্তু এরপর দীর্ঘ স্বেচ্ছা বিরতি।

স্বেচ্ছা বিরতির দেড় দশক পর ১৯৮৯ সালে, ঈদসংখ্যা বিচিন্তায় একটি গল্পের মধ্য দিয়ে সাহিত্যের জগতে আবার পদার্পণ করেন এই লেখক।

এবার যেন সাহিত্যে আগের বিরতি পুষিয়ে দিতেই আরো বলিষ্ঠ পদচারণা এই গল্পকারের।

সাহিত্যিকদের মতে, সত্তরের দশকে মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, সামরিক শাসনের দুঃসহ বাস্তবতা, দারিদ্র্য, বেকার সমস্যা, নারী নির্যাতন, সন্ত্রাস প্রভৃতির প্রভাব পড়ে ছোটগল্পে।

বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই লিখেছেন তিনি।

লেখক - সাহিত্যিকদের এক সংগঠনের সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম

মঈনুল আহসান সাবের বিবিসি বাংলাকে বলেন, ” আমি মনে করি তার মূল পরিচিতিটা মূলত লেখক, আমার কাছে অন্তত।”

‘বাস্তবতার গল্পকারে’র পথচলা

কথা সাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী গল্পকারদের অন্যতম। যিনি সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের বন্ধু, সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ী।

এই লেখকের কাছে অবশ্য সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের শিক্ষক পরিচয় ছাপিয়ে গেছে লেখক পরিচয়ে।

মি. সাবের বিবিসি বাংলাকে বলেন, ” আমি মনে করি তার মূল পরিচিতিটা মূলত লেখক, আমার কাছে অন্তত।”

ভিন্ন ধারার গল্পকার হিসেবেই তিনি মি. ইসলামকে আখ্যায়িত করেন।

” জাদু বাস্তবতা চমৎকারভাবে তার লেখায় কাজ করে। আমি গল্পের কথাই বলি মূলত। আমার মনে হয় গল্পেই তিনি সবচেয়ে বেশি সফল হয়েছেন। জাদু বাস্তবতা একেবারে যখন আমাদের দেশে চর্চা শুরু হয়নি তখন তিনি সেটার চর্চা শুরু করেন ” বলেন মি. সাবের।

বাস্তবতার গল্প খুব সহজে, অবলীলায়, কোথাও কোনো রকম বাধা বা ধাক্কা না দিয়ে সহজভাবে তৈরি করার ক্ষেত্রে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গল্পগুলো একটা নিদর্শন বলে মনে করেন এই লেখক।

মঈনুল আহসান সাবের বলেন, ” হার্ড বা ক্রুয়েল রিয়েলিটি অর্থাৎ নিষ্ঠুর বাস্তবতা কিন্তু তিনি লিখছেন খুবই সহজভাবে। এটাও তার একটা বৈশিষ্ট্য। এটা আমাদের এখানকার সাহিত্যে প্রায় নেই।”

গল্পের ভাষা সাবলীল হওয়া এবং কোথাও নিজেকে জাহির না করার বড় গুণ রয়েছে গল্পকার অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের।

” আমার মনে হয় জাদু বাস্তবতা এবং নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে অবলীলায় কোনো রকম সম্পৃক্ত হওয়া ছাড়া তিনি তুলে আনছেন। তার উপস্থিতি কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই যে বিচ্ছিন্ন থাকা, এইটা একটা খুবই বড় গুণ। আমার কাছে এই দুইটাই তার লেখার সবচেয়ে বড় ব্যাপার ” বলেন মি. সাবের।

পুরষ্কার ও পদক

গল্পকার সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম জীবনে রাষ্ট্রীয় পুরষ্কারসহ সাহিত্যের অনেক সম্মানজনক পুরষ্কারই পেয়েছেন।

সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৮ সালে পান একুশে পদক তিনি। ১৯৯৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন তিনি। ‘নন্দনতত্ত্ব’ বইটির জন্য এই পুরষ্কার।

‘প্রেম ও প্রার্থনার গল্প’ এর জন্য পেয়েছেন ১৪১১ সালের প্রথম আলো বর্ষসেরা বই’ এর পুরস্কার এবং কাগজ সাহিত্য পুরস্কার-২০০৬।

বাংলা সাহিত্যে তার অবদানের জন্য ২০১৬ সালে কাজী মাহবুবুল্লাহ পুরস্কারে ভূষিত হন।

তার বই

বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষকতার সহকর্মী, লেখক সহকর্মী সকলের কাছেই ব্যক্তি হিসেবে মঞ্জুরুল ইসলাম ছিলেন অত্যন্ত সদালাপী, আন্তরিক।

‘ব্যক্তি মনজুরুল ছিলেন অসাধারণ’

বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষকতার সহকর্মী, লেখক সহকর্মী সকলের কাছেই ব্যক্তি হিসেবে মনজুরুল ইসলাম ছিলেন অত্যন্ত সদালাপী, আন্তরিক।

তার লেখক বন্ধু মি. সাবেরের ভাষায়, ” অসাধারণ। তিনি মানুষকে মূল্য দিতে জানেন। এটা হচ্ছে তার সবচেয়ে বড় গুণ। দীর্ঘ সময়ে আমি কখনো দেখিনি কোনো মানুষকে তাচ্ছিল্য করছেন। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে এটা মেকি না। এটা তার ভেতরেই ছিল, চেষ্টা করে করেছেন এমনটা না।”

সহজাতভাবেই বন্ধুবৎসল, সদালাপী স্বভাবের লেখক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।

কাজের প্রতি ভীষণ নিষ্ঠাবান লেখক মি. ইসলাম।

উদাহরণ দিতে গিয়ে লেখক মঈনুল আহসান সাবের জানান, হয়তো কোথাও ঘুরতে গিয়ে রাত বারোটা বা একটা পর্যন্ত আড্ডা চলছিল। এক পর্যায়ে সবাই ঘুমাতে গেল।

” কিন্তু হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে দেখতাম মঞ্জু ভাই কাজ করছেন। হয়তো সে কাজের জন্য সময় চেয়ে নেওয়া যেতো কিন্তু সেটা করতেন না। কাজ শেষ করতেন ” বলেন এই লেখক।

‘চিত্র সমালোচক’ হিসেবে প্রসিদ্ধ

সাহিত্যের বিভিন্ন জগতেই কেবলমাত্র লেখালেখি নয় বরং চিত্র সমালোচক হিসেবেও খ্যাতি রয়েছে সৈয়দ মমনজুরুল ইসলামের।

বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকী, সংবাদপত্র বা বইয়ে চিত্রকলার ভাষা নিয়ে অনেক লেখা রয়েছে।

লেখক মনজুরুল ইসলাম প্রখর শিল্পবোধ সম্পন্ন এবং শিল্প বা চিত্রকলার প্রতি বেশ অনুরাগী বলে জানান তার শিক্ষক ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

সাহিত্য সাময়িকী কালি ও কলম এ তার এক লেখায় চিত্রশিল্পের প্রতি এই অনুরাগের কথা ফুটে উঠেছে।

তিনি লিখেছেন, ” ছবির ভাষার কোনো সুনির্দিষ্ট বাক্য বিন্যাস নেই, মুখের ভাষায় যা আছে; কোনো শব্দভাণ্ডার নেই, মুখের ভাষায় যা আছে; প্রকাশ-বহুত্বও নেই, মুখের ভাষায় যা আছে। প্রশ্ন হলো, এগুলো যদি না থাকে, তাহলে ছবির ভাষা আমরা কিভাবে বুঝি? এমনকি বিমূর্ত ছবির?”

ঢাকায় বিভিন্ন আর্ট গ্যালারি অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলা প্রদর্শনীতেও তার দেখা মেলে প্রায়শই।

শিল্পবোদ্ধা হিসেবে তার চিত্র সমালোচক ভূমিকার বিষয়ে বলতে গিয়ে লেখক মঈনুল আহসান সাবের জানান, ১৯৯৬ সালে একই বছর দুই জনই বাংলা একাডেমি পুরষ্কার পান।

চিত্র সমালোচনা পছন্দ করতেন তিনি।

” তখন মঞ্জু ভাইয়ের যে বইটি বেরিয়েছে সেটি নন্দন তত্ত্বের উপরে। ফলে অ্যাস্থেটিকস নিয়ে তার একটা চিন্তা-ভাবনা বহু আগে থেকেই কাজ করছে। আমার মনে হয় সেটাই তাকে চিত্রকর্ম বা চিত্র সমালোচনার প্রতি আকৃষ্ট করেছে।”

শুধু তাই নয় বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পীদের সাথে তার বন্ধুত্বেই তার শিল্প অনুরাগী হওয়ার কথা প্রমাণ করে। যেমনটা বলছিলেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মনিরুল ইসলাম।

বাংলাদেশী এই শিল্পী এখন মূলত স্পেনেই বসবাস করেন। তবে দেশেও আসেন নিয়মিত।

মি. ইসলামের সাথে যখন কথা বলছিলাম তখন তিনি স্পেনে অবস্থান করছেন।

তিনি জানান, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তার ৪০ বছরের বন্ধু।

” মনজুরুল ইসলামকে আমি চিনি প্রায় ৩৫-৪০ বছর। তখন একটা মাত্র গ্যালারি ছিল। আসা-যাওয়া করতো ফয়েজ ভাইয়ের শিল্পাঙ্গন গ্যালারিতে ” বলেন তিনি।

এই চিত্রশিল্পী জানান, চিত্রশিল্পীদের আঁকা বিমূর্ত শিল্পকে সাহিত্যের ভাষায় বন্দনা করেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।

” শিল্পের এক রূপের সাথে আরেক রূপের সংযোগ স্থাপন করেন উনি। শিল্পের রূপগুলা কিন্তু আলাদা না। এই জায়গাতে তার ইন্টারেস্টের সাথে পড়াশোনার মাধ্যমে পারফেকশনে চলে এসেছে ” বলেন এই শিল্পী মনিরুল ইসলাম।

বিবিসি নিউজ বাংলা