বাংলাদেশ পুলিশের অভ্যন্তরীণ সংকট এখন আর কেবল পেশাগত নয়, বরং রাষ্ট্রীয় ও মানসিক।
আইন রক্ষাকারী বাহিনী আজ এমন এক দ্বন্দ্বে নিমজ্জিত যেখানে তারা একদিকে রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগের প্রতীক, অন্যদিকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের বন্দি।
ওসি হাবিবুল্লাহর উক্তি—“পুলিশ এখন বানরের মতো, খাঁচায় বন্দি করে নাচাচ্ছে”—এই বাস্তবতারই নির্মম প্রতিফলন।
ভূমিকা: পুলিশের অদ্ভুত দ্বন্দ্ব — রাষ্ট্রের রক্ষক না রাষ্ট্রের শিকার?
বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আজ এক গভীর মানসিক ও নৈতিক সংকটের মধ্যে দাঁড়িয়ে।
একদিকে তারা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের প্রতীক — ক্ষমতার প্রয়োগে নির্ভীক; অন্যদিকে রাজনৈতিক নির্দেশ, দলীয় আনুগত্য ও জনআস্থা সংকটে তাদের পেশাদারিত্ব ক্রমে ভেঙে পড়ছে।
ওসি হাবিবুল্লাহর উক্তি—“পুলিশ এখন বানরের মতো, খাঁচায় বন্দি করে নাচাচ্ছে”—এই হতাশার চূড়ান্ত প্রতীক।
এটি কেবল এক কর্মকর্তার ক্ষোভ নয়, বরং একটি প্রতিষ্ঠানের অন্তর্নিহিত ক্লান্তির স্বীকারোক্তি।
ঝিনাইদহ থেকে নরসিংদী: ভেতরের চাপ, বাইরের আঘাত
ঝিনাইদহ জেলা কারাগারের নির্যাতনের বর্ণনা ওসি হাবিবুল্লাহর মন্তব্যকে বাস্তবের মাটিতে নামিয়ে আনে।
এমনকি সম্প্রতি নরসিংদীতে, যেখানে এক উপপরিদর্শক (এসআই) আসামী ধরতে গিয়ে দুর্বৃত্তদের হামলায় গুরুতর আহত হন ।
এছাড়া ২০২৪ সালের জুলাই – আগস্ট মাসে বিভিন্ন জেলায় অজ্ঞাত গোষ্ঠীর হামলায় একাধিক এখনও অজানা সংখ্যক পুলিশ সদস্য নিহত হন।
এসব ঘটনার পরও পুলিশ হত্যার দায়ীদের বিচার তো দূরের কথা, বরং দেখা গেছে — পুলিশ নিহতের ঘটনায় অভিযুক্তদের প্রতি রাষ্ট্রীয় সহানুভূতি কিংবা দায়মুক্তি সংস্কৃতি আরও মজবুত হয়েছে।
আইজিপির সতর্ক উচ্চারণ: ‘পুলিশকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা কঠিন’
পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) সম্প্রতি এক প্রেস কনফারেন্সে বলেছেন,
“নির্বাচনের আগে পুলিশকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা কঠিন কাজ।”
এই মন্তব্যটিই বর্তমান প্রশাসনিক মানসিকতার ইঙ্গিত বহন করে।
কারণ নির্বাচনকালীন সময়ে পুলিশই হবে রাজনৈতিক প্রভাব, জনরোষ এবং আন্তর্জাতিক নজরদারির কেন্দ্রবিন্দু।
আইজিপির এই বক্তব্যকে অনেক বিশ্লেষক ‘সতর্ক সংকেত’ হিসেবে দেখছেন — পুলিশ সদস্যদের মানসিক অবসাদ, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, এবং ভয়ভীতির সংস্কৃতি তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতাকে ক্ষয় করছে।
ফলে পুলিশের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে এক ধরনের “নিষ্ক্রিয় আনুগত্য”—যেখানে তারা চিন্তা করে না, শুধু আদেশ পালন করে।
“খাঁচায় বন্দি বানর” — প্রতীক না প্রতিবাদ?
ওসি হাবিবুল্লাহর উক্তিটি এখন সামাজিক মাধ্যমে এক ধরনের প্রতিরোধের ভাষায় রূপ নিয়েছে।
তার বক্তব্যের অন্তর্নিহিত অর্থ হলো — পুলিশ সদস্যরা যেন আর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেই; তারা রাজনৈতিক মালিকানার খেলায় বন্দি।
একজন সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন,
“আমাদের এখন মানবিকভাবে ভাবার জায়গা নেই। শুধু নির্দেশ মানতে হয়। কে ঠিক, কে ভুল — তা বিবেচনার সুযোগ নেই।”
এই বাস্তবতা পুলিশকে একটি ‘যান্ত্রিক বাহিনী’-তে পরিণত করেছে,
যারা আইন প্রয়োগের চেয়ে ক্ষমতার প্রয়োগেই বেশি দক্ষ হয়ে উঠেছে।
ন্যায়বিচারের কাঠামো দুর্বল, সেখানে শক্তি প্রদর্শন হয়ে ওঠে আত্মরক্ষার প্রতিক্রিয়া।
অনেক পুলিশ সদস্যই মনে করেন, “আমরা জীবন বাজি রেখে কাজ করি, কিন্তু কেউ আমাদের বোঝে না।”
এই মানসিকতা তাদের মধ্যে ‘প্রতিশোধমূলক কর্তব্যবোধ’ সৃষ্টি করে, যা পরিণত হয় সহিংসতায়।
নির্বাচনের ছায়া: পুলিশ কি আবারও বলির পাঁঠা?
আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে।
এমন সময়ে পুলিশই থাকবে প্রতিটি সঙ্কটের সামনের সারিতে — বিক্ষোভ দমন, নিরাপত্তা, ভোটকেন্দ্র পাহারা, গ্রেপ্তার অভিযান ইত্যাদিতে।
কিন্তু যদি পুলিশ নিজের ভেতরে বিশ্বাস হারায় — যদি সে জানে, আদেশ মানলে সমালোচনা, না মানলে শাস্তি —
তবে সে কেবল যান্ত্রিক বাহিনী হিসেবেই কাজ করবে।
দায়মুক্তি নয়, মানবিক পুনর্গঠনই হতে পারে মুক্তির পথ
বাংলাদেশ পুলিশ আজ এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যেখানে শুধু বাহিনীর সংস্কার নয়, প্রয়োজন ‘মনস্তাত্ত্বিক পুনর্গঠন’।
রাষ্ট্র যদি চায় সত্যিকার অর্থে জনগণের পুলিশ, তবে প্রথমেই বন্ধ করতে হবে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও দায়মুক্তি সংস্কৃতি।
একজন ওসি’র হতাশ কণ্ঠস্বর — “আমরা বানরের মতো” — আমাদের সকলের জন্য এক সতর্ক বার্তা:
যে রাষ্ট্র নিজের রক্ষকদের মানুষ হিসেবে দেখতে ভুলে যায়, সে রাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত নিজেকেই বিপন্ন করে।
বাংলাদেশের পুলিশ আজ ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে — যেখানে তাদের সামনে দুটি পথ:
একটি পথ দায়মুক্তির নিরাপত্তা, অন্যটি মানবিক দায়িত্ববোধের পুনর্জাগরণ।
রাষ্ট্র কোনটি বেছে নেবে — সেটিই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক স্বাধীনতার মানচিত্র।
#বাংলাদেশ #পুলিশ #মানবাধিকার #নির্বাচন২০২৫ #আইনি_দায়মুক্তি #ওসি_হাবিবুল্লাহ #নরসিংদী #আইজিপি #সারাক্ষণ_রিপোর্ট