২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যাল—এ দেওয়া একটি বার্তা যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আলোড়ন তোলে। তিনি লিখেছিলেন, “শিকাগো এখন বুঝবে কেন একে ‘ডিপার্টমেন্ট অব ওয়ার’ বলা হয়।” কয়েক সপ্তাহ পরই সেই হুমকি বাস্তব রূপ নেয়—একটি ইমিগ্রেশন রেইডে, যা এখন ট্রাম্প-শাসিত আমেরিকায় ‘অভিবাসন যুদ্ধ’-এর প্রতীক হয়ে উঠেছে।
শিকাগোর দক্ষিণ উপকূলের আতঙ্কজনক রাত
৭৫০০ সাউথ শোর ড্রাইভ (শিকাগো)—একটি পুরনো অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স। দরজা-জানালা ভাঙা, বহু ফ্ল্যাট ফাঁকা, কয়েকটি কাঠের তক্তা দিয়ে বন্ধ। কোথাও পড়ে আছে স্প্যানিশ ভাষার নতুন নিয়মপুস্তক (নিউ টেস্টামেন্ট), কোথাও ফুল আর বেলুনে সাজানো ঘর—কিন্তু মানুষ নেই। ধারণা করা হচ্ছে, বাসিন্দাদের কেউই এখন স্বাধীন নন; বেশিরভাগই অভিবাসন আটক কেন্দ্রে।
৩০ সেপ্টেম্বর রাত দেড়টার দিকে প্রায় ৩০০ মুখোশধারী ফেডারেল এজেন্ট ভবনটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কেউ হেলিকপ্টার থেকে নামে, কেউ দরজা ভেঙে ঢোকে। আতশবাজির মতো ‘ফ্ল্যাশব্যাং’ ছুঁড়ে ঘুমন্ত মানুষদের রাস্তায় বের করে আনা হয়—শিশুরাও বাদ যায়নি। প্রায় ৩৭ জন ভেনেজুয়েলান অভিবাসীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।
নাগরিক হয়েও গ্রেপ্তার
পঞ্চম তলার বাসিন্দা ৩৩ বছর বয়সী আমেরিকান নাগরিক অ্যালিসিয়া ব্রুকস বলেন, “আমি বাসায় ফিরছিলাম, হঠাৎ কেউ আমার হাত ধরে ফেলে। চোখের পলকে হাতকড়া পড়ানো হলো।” তিনি জানান, পুলিশ তাদের আতঙ্ক সৃষ্টির মতো করে ভবন থেকে বের করে এনে লাইনে দাঁড় করায়। তারপর আফ্রিকান-আমেরিকান নাগরিকদের এক পাশে, ভেনেজুয়েলান অভিবাসীদের অন্য পাশে সরিয়ে নেওয়া হয়।
ব্রুকস বারবার নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে চাইলে কর্মকর্তারা তাতে কর্ণপাত করেননি। বরং তাকে মাটিতে ফেলে আবার হাতকড়া পরানো হয়। সকালে সূর্য ওঠার সময় তিনি মুক্তি পান।
সরকারের দাবি বনাম বাস্তবতা
মার্কিন স্বরাষ্ট্র বিভাগ (D.H.S.) জানায়, অভিযানের লক্ষ্য ছিল ‘ট্রেন দে আরাগুয়া’ নামের এক ভেনেজুয়েলান অপরাধচক্রকে ধরার। ট্রাম্প প্রশাসন তাদের “রাষ্ট্র-সমর্থিত সন্ত্রাসী সংগঠন” বলে অভিহিত করেছে।
কিন্তু এখন পর্যন্ত D.H.S. কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এসব অভিবাসীরা হয়তো কিছুটা বিশৃঙ্খল ছিল—জঞ্জাল ফেলত, জোরে গান বাজাত—কিন্তু তারা অপরাধী নয়। বরং অনেক সময় ভবনের নষ্ট লাইট নিজেরাই ঠিক করত।
আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট
অভিযানের আগে থেকেই ভবনটি সমস্যায় জর্জরিত ছিল। ওয়েলস ফার্গো ব্যাংক ভবনটি বাজেয়াপ্ত করতে মামলা করেছিল। অব্যবস্থাপনা, ভাড়া না দেওয়া ও কোড লঙ্ঘনের ঘটনা নিয়মিত ছিল। কিন্তু এসব কারণে পুরো ভবনকে ‘গ্যাং-দখলকৃত এলাকা’ বলা হাস্যকর, বলে মন্তব্য বাসিন্দাদের।
দক্ষিণ শোর এলাকা মূলত কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর; ধনী নয়, তবে অপরাধপ্রবণও নয়। ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে টেক্সাস রাজ্য প্রায় ৫০ ০০০ আশ্রয়প্রার্থীকে বাসে করে শিকাগো পাঠায়। স্বাভাবিকভাবেই তারা কমভাড়ার এমন ভবনগুলোতে আশ্রয় নেয়, যা স্থানীয়দের সঙ্গে টানাপোড়েন সৃষ্টি করে।
মিডিয়া ও প্রচারকৌশল
অভিযানের পরপরই মার্কিন স্বরাষ্ট্র বিভাগ (D.H.S.) একটি সংক্ষিপ্ত ভিডিও প্রকাশ করে—হলিউডের মতো সম্পাদিত ফুটেজে দেখা যায়, তরুণ হিস্পানিক পুরুষদের হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন মিডওয়ে ব্লিৎজ’, যার প্রধান লক্ষ্য শুধু ধরপাকড় নয়, বরং জনমত গঠন।
২৫ সেপ্টেম্বর সীমান্তরক্ষী নৌকাগুলোকে শিকাগো নদীতে টহল দিতে দেখা যায়—যেন শহরজুড়ে ভয় ছড়ানোই তাদের উদ্দেশ্য। এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টি নোমের প্রচারণামূলক ভিডিওও সেখানে ধারণ করা হয়।
সংখ্যা, ভয়, এবং রাজনীতি
অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে ইতোমধ্যে এক হাজারের বেশি অভিবাসী আটক হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, “শিকাগো আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসবেই।”
২৭ সেপ্টেম্বর এক কর্মকর্তা বলেন, “আমরা এখানে আছি, এবং কোথাও যাচ্ছি না।”
৫ অক্টোবর প্রশাসন জানায়, শহরে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করা হয়েছে। পরদিন ইলিনয় অঙ্গরাজ্য সরকার আদালতে মামলা করে এই মোতায়েন ঠেকাতে। তবুও অভিযান থামেনি—বরং আরও ক্যামেরা, আরও ভিডিও, এবং আরও ভয় তৈরি করছে।
শিকাগোর এই ‘ইমিগ্রেশন রেইড’ শুধু একটি অভিযান নয়; এটি ট্রাম্প প্রশাসনের রাজনৈতিক বার্তা—“আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনব”, কিন্তু মানবাধিকারের বিনিময়ে।
যেখানে নাগরিকরাও সন্দেহভাজন, সেখানে রাষ্ট্রের ‘যুদ্ধনীতি’ কাকে লক্ষ্য করছে—এ প্রশ্ন এখন সারা আমেরিকার।
#আমেরিকা #ট্রাম্প #ইমিগ্রেশন #শিকাগো #অভিবাসননীতি #সারাক্ষণরিপোর্ট