বাংলাদেশের গাজীপুর জেলার অন্তর্গত ভাওয়াল গড় এক অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ। ঢাকার উত্তরে বিস্তৃত এই শালবন একসময় বাংলার মধুপুর গড়ের অংশ ছিল। ঘন শালগাছ, বন্যপ্রাণী, প্রাচীন নদীখাত, এবং মানব-প্রকৃতির গভীর সম্পর্ক—সব মিলিয়ে ভাওয়ালের বনভূমি বাংলাদেশের পরিবেশ, সংস্কৃতি ও জীববৈচিত্র্যের ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
ভাওয়াল গড়ের ভূগোল ও অবস্থান
ভাওয়াল গড় অবস্থিত গাজীপুর জেলার শ্রীপুর, কালিয়াকৈর, কাপাসিয়া ও সদর উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে। এটি মধুপুর গড়ের দক্ষিণাংশের একটি অবশিষ্ট অংশ, যা একসময় টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বর্তমানে এই বনভূমি “ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান” নামে পরিচিত, যার আয়তন প্রায় ৫,০০০ হেক্টর।
ঢাকা থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে এই বনভূমি রাজধানীর সবথেকে কাছাকাছি একটি বৃহৎ প্রাকৃতিক বনাঞ্চল।
শালবনের উদ্ভিদবৈচিত্র্য
ভাওয়াল অঞ্চলের প্রধান বৃক্ষ হলো শাল (Shorea robusta), যা এই বনের প্রাণ। এর সঙ্গে রয়েছে গজারি, করই, জাম, আম, হিজল, বট, পাকুর ও অর্জুন গাছ। বনের নিচতলায় জন্মায় বিভিন্ন প্রজাতির ঘাস, ঝোপঝাড় ও ঔষধি উদ্ভিদ।
এই বন একসময় ছিল ঘন ও অরণ্যাচ্ছন্ন; সূর্যের আলোও মাটিতে পৌঁছাত না। কিন্তু অতিরিক্ত কাঠ আহরণ, কৃষি সম্প্রসারণ ও দখলদারির ফলে এখন অনেক অংশে গাছের ঘনত্ব কমে এসেছে।
প্রাণীবৈচিত্র্যের আবাস
ভাওয়ালের শালবন একসময় ছিল বাঘ, চিতা, হরিণ, বনমোরগ, শিয়াল, বন্যখরগোশ ও অসংখ্য পাখির নিবাস। বর্তমানে বড় প্রাণী খুব কম দেখা যায়, তবে শিয়াল, বেজি, বনবিড়াল, কাঠবিড়ালি, প্যাঁচা, বউ কথা কও, টিয়া ও বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতি এখনো টিকে আছে।
ঋতুভেদে বিভিন্ন অতিথি পাখি এখানে আসে, বিশেষ করে শীতকালে।
ভাওয়ালের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
ভাওয়াল গড়ের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। প্রাচীনকালে এটি ছিল পাণ্ডু, পাল ও সেন রাজবংশের শিকারভূমি। পরে মুঘল আমলে ভাওয়াল রাজারা এই এলাকায় তাঁদের দুর্গ ও প্রাসাদ গড়ে তোলেন। এই রাজপরিবারের ইতিহাসই আজকের “ভাওয়াল সন্ন্যাসী” উপাখ্যানের জন্ম দিয়েছে—যা বাঙালির লোককথায় কিংবদন্তি হয়ে আছে।
ভাওয়াল সন্ন্যাসীর কিংবদন্তি
ভাওয়াল রাজা রমেন্দ্রনারায়ণ রায়ের রহস্যময় মৃত্যুর পর বছর কয়েক পর তাঁর মতোই এক সন্ন্যাসীর আবির্ভাব ঘটে ভাওয়ালে। এই সন্ন্যাসী দাবি করেন, তিনিই আসল রাজা, যাকে হত্যা করে বনেপাহাড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।
এই ঘটনার বিচার চলে ১৯ বছর, ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম আলোচিত আদালত নাটকে পরিণত হয় এটি। শেষ পর্যন্ত বিচারক রায় দেন, সন্ন্যাসীই প্রকৃত ভাওয়াল রাজা। এই কিংবদন্তি আজও ভাওয়ালের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ।
ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান: সংরক্ষণের নতুন অধ্যায়
১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার এই বনাঞ্চলকে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে। এর উদ্দেশ্য ছিল বনজ সম্পদ, জীববৈচিত্র্য এবং ঐতিহাসিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা।
বাংলাদেশ বন বিভাগ ১৯৮২ সালে এখানে একটি সংরক্ষণ ও ইকো-ট্যুরিজম কর্মসূচি চালু করে। আজ এটি রাজধানী ঢাকার নাগরিকদের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় বনভ্রমণ কেন্দ্রগুলোর একটি।
ইকো-ট্যুরিজম ও পর্যটন সুবিধা
ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে এখন বিভিন্ন পর্যটন অবকাঠামো গড়ে উঠেছে—প্রবেশ গেট, পিকনিক স্পট, কটেজ, শিশু পার্ক, হাঁটার পথ ও তথ্যকেন্দ্র। প্রতিবছর লাখ লাখ পর্যটক এখানে আসেন প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে।
ঢাকার ব্যস্ত জীবন থেকে মুক্তি পেতে মানুষ ভাওয়ালের শান্ত বনের ভিতর হাঁটতে ভালোবাসে। সকালে কুয়াশায় ঢাকা শালবনের পথ যেন প্রকৃতির কোনো গোপন চিঠি।
পরিবেশগত গুরুত্ব
শালবন কেবল বনভূমি নয়; এটি এক প্রাকৃতিক কার্বন সিংক। এটি বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনে ভূমিকা রাখে। এছাড়া এই বনভূমি স্থানীয় জলাধার, ভূগর্ভস্থ পানির ভারসাম্য ও মাটির উর্বরতা রক্ষা করে।
ভাওয়াল গড়ের বৃক্ষরাজি গ্রীষ্মে তীব্র গরম কমায়, আর বর্ষায় অতিবৃষ্টির পানি ধারণ করে বন্যা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
বনাঞ্চল সংকোচন ও হুমকি
তবে ভাওয়ালের বন এখন নানা হুমকির মুখে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বসতি স্থাপন, কাঠ চুরি, চাষযোগ্য জমি সম্প্রসারণ ও ইটভাটা স্থাপনের ফলে বনভূমির আয়তন ক্রমেই কমছে।
এক সময় এই বন ছিল টানা সবুজের সমুদ্র; আজ অনেক স্থানে দেখা যায় বিরান জমি। বনবিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ৫০ বছরে প্রায় ৪০ শতাংশ শালবন ধ্বংস হয়েছে।
সামাজিক বনায়ন ও পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টা
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন গাছ লাগানোর কাজ চলছে। স্থানীয় জনগণকে এতে সম্পৃক্ত করা হয়েছে, যাতে তারা বন রক্ষায় সরাসরি উপকৃত হয়।
বিশেষ করে নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে; তারা নার্সারি তৈরি, চারা রোপণ ও বনরক্ষণে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।
স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও বনজীবন
ভাওয়ালের আশপাশে বসবাসরত মানুষদের জীবিকা দীর্ঘদিন ধরে এই বনের সঙ্গে জড়িত। কেউ সংগ্রহ করেন মধু, কেউ সংগ্রহ করেন জ্বালানি কাঠ বা ওষধি উদ্ভিদ।তবে বর্তমানে বন বিভাগ তাদের বিকল্প জীবিকা যেমন—হস্তশিল্প, মৌমাছি পালন, এবং ইকো-ট্যুরিজম কর্মসূচিতে যুক্ত করছে, যাতে বননির্ভরতা কমে ও জীবিকা টেকসই হয়।
ভাওয়ালের জলবায়ু ও ঋতুচক্র
ভাওয়াল গড়ের জলবায়ু উষ্ণ ও আর্দ্র। গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠে, আর শীতে নামে ১২ ডিগ্রির নিচে।
বছরে গড়ে প্রায় ২,২০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। বর্ষাকালে বনের নিচে জন্ম নেয় অসংখ্য ফার্ন, ছত্রাক ও মস।
শালবনের প্রাণরস — মাটি
ভাওয়াল গড়ের মাটি মূলত বেলে দোআঁশ প্রকৃতির। এতে জৈবপদার্থের পরিমাণ কম, তাই এখানে গাছগুলো ধীরে ধীরে বাড়ে। তবে একবার পূর্ণতা পেলে শালগাছ শত বছর পর্যন্ত বাঁচে।
এই মাটি পানি ধারণে সহায়তা করে, ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্থিতিশীল থাকে।
গবেষণা ও শিক্ষামূলক কার্যক্রম
ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও গবেষকরা নিয়মিত কাজ করেন।
তারা উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, বনবিদ্যা ও পরিবেশবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করেন। এখানকার জীববৈচিত্র্য বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ইতিহাসের মূল্যবান গবেষণার উৎস।
সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
ভাওয়াল গড় শুধু প্রকৃতির নয়, সংস্কৃতিরও অংশ। স্থানীয় কবিতা, গান, নাটক ও লোককথায় বারবার উঠে এসেছে “ভাওয়ালের বন”।
রাজা-সন্ন্যাসীর গল্প, বনের দেবতা ও শিকার উৎসব—এসব ঐতিহ্য এই অঞ্চলকে দিয়েছে অনন্য সাংস্কৃতিক পরিচয়।
বর্তমান সংরক্ষণ চ্যালেঞ্জ
বনবিভাগ এখনো নানা সমস্যার মুখে—যেমন অবৈধ দখল, রাজনৈতিক প্রভাব, পর্যাপ্ত কর্মীস্বল্পতা ও বাজেট সংকট। অনেক এলাকায় গাছ কেটে চাষাবাদ করা হচ্ছে।তাছাড়া ইকো-ট্যুরিজমের কারণে আবর্জনা, শব্দদূষণ ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা
বনবিভাগ “ভাওয়াল ইকো-রিস্টোরেশন মাস্টারপ্ল্যান ২০৩০” প্রণয়ন করেছে, যার মাধ্যমে গাছ রোপণ, জলাধার পুনর্নির্মাণ, বন্যপ্রাণী করিডোর তৈরি এবং স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণে বন সংরক্ষণ জোরদার করা হবে।
লক্ষ্য—ভাওয়ালকে পুনরায় ঘন শালবনের রূপে ফিরিয়ে আনা এবং একে জলবায়ু অভিযোজনের মডেল হিসেবে গড়ে তোলা।