বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটকের এক উজ্জ্বল নাম আনিকা কবির শখ। একসময় বিজ্ঞাপনে হাসিমাখা মুখ, আজ তিনি এক শিল্পী, যাঁর অভিনয়, উপস্থিতি ও ব্যক্তিত্ব দর্শকের হৃদয়ে ছাপ ফেলেছে। তাঁর জীবনের পথচলা ছিল রঙিন কিন্তু তা ছিল না বাধাহীন। জনপ্রিয়তার উত্থান, ব্যক্তিগত জীবনের উত্থান-পতন, এবং আত্মপরিচয়ের সংগ্রাম—সব মিলিয়ে সখের জীবন যেন এক রোমাঞ্চকর উপন্যাস।
শৈশব ও পরিবার
শখের জন্ম ঢাকা শহরে। তিনি ছিলেন পরিবারের আদরের মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই নাচ, গান ও অভিনয়ে গভীর আগ্রহ ছিল তাঁর। পরিবারের সদস্যরা সবসময় তাঁর সৃজনশীল দিকটিকে উৎসাহ দিয়েছেন। স্কুলে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া, নাচ শেখা, গান গাওয়া—সবকিছুই ছিল তাঁর বেড়ে ওঠার অংশ।
শৈশবে তিনি ছিলেন প্রাণবন্ত ও হাসিখুশি একটি মেয়ে। বন্ধুরা বলতেন, “শখ মানেই হাসি।” সেই উচ্ছলতা পরবর্তী জীবনে তাঁর অভিনয়ে প্রতিফলিত হয়েছে—চোখের ভাষায়, অঙ্গভঙ্গিতে, সংলাপে।
মডেলিং-এ পদার্পণ
২০০০-এর দশকের শুরুতে শখ মডেল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। প্রথমদিকে টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেই তিনি দর্শকের নজরে আসেন। ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’, ‘প্রাণ ফ্রুটো’, ‘সানসিল্ক’, ‘কোকা-কোলা’—এসব জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপনে তাঁর প্রাণবন্ত উপস্থিতি তাঁকে তুমুল আলোচনায় নিয়ে আসে।
সেই সময় বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন জগতে তরুণ মুখ হিসেবে তিনি ছিলেন সবচেয়ে চাহিদাসম্পন্নদের একজন। শখের হাসি, চোখের অভিব্যক্তি এবং স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গিমা তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। এই সফলতা তাঁর জন্য টেলিভিশন নাটকের দরজা খুলে দেয়।
নাটকে যাত্রা
শখের অভিনয় জীবন শুরু হয় ছোট পর্দায়। তাঁর প্রথম নাটক ছিল ‘অদ্ভুত’, এরপর ‘ঘরছাড়া’, ‘কলেজ’, ‘ফুলের মতো মানুষ’, ‘বিবর্ণ ভালোবাসা’ ইত্যাদি ধারাবাহিক ও একক নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
তাঁর অন্যতম আলোচিত কাজ ছিল তৌকীর আহমেদ পরিচালিত ‘রঙ’, যেখানে তাঁর অভিনয় প্রশংসিত হয়েছিল। ধীরে ধীরে তিনি বাংলাদেশের নাট্যজগতে এক ‘পরিচিত মুখ’ থেকে ‘অভিনেত্রী শখ’ হিসেবে স্বীকৃতি পান।
তাঁর সহশিল্পীদের মধ্যে ছিলেন আফরান নিশো, জিয়াউল ফারুক অপূর্ব, মেহজাবীন চৌধুরী প্রমুখ। শখের অভিনয়ের বৈশিষ্ট্য ছিল প্রাকৃতিক সংলাপপ্রবাহ ও মিষ্টি অভিব্যক্তি, যা দর্শকদের কাছে তাঁকে বিশেষভাবে আপন করে তোলে।
বড় পর্দায় পদার্পণ
টেলিভিশন নাটকে সাফল্যের পর শখ চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন। ২০১১ সালে মুক্তি পায় তাঁর প্রথম সিনেমা ‘ভালোবাসার রঙ’, যেখানে নায়ক ছিলেন শাহরিয়ার নাজিম জয়। ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে সফল না হলেও, শখের অভিনয় প্রশংসিত হয়েছিল।
পরে তিনি আরও কিছু সিনেমায় কাজ করেন, যার মধ্যে ছিল ‘অল্প অল্প প্রেমের গল্প’, ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনি’ এবং ‘লাভ এক্সপ্রেস’। তবে নাটকই তাঁর মূল ক্ষেত্র হিসেবে থেকে যায়।
জনপ্রিয়তার শীর্ষে শখ
২০১০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে শখ ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেত্রী। তখনকার টেলিভিশন দর্শকপ্রিয় নাটকগুলোর অনেকগুলোতেই তিনি প্রধান চরিত্রে ছিলেন। তাঁর নামেই দর্শক নাটক দেখত।
তাঁর অভিনীত কিছু স্মরণীয় নাটক যেমন ‘একটি সাদা গোলাপ’, ‘অচেনা মুখ’, ‘চোখের দেখা’, ‘কষ্টের গল্প’, ‘দূরত্ব’ এবং ‘রঙ মিলা ভালোবাসা’ আজও দর্শকের মনে দাগ কেটে আছে।
ভালোবাসা ও বিবাহ
শখের ব্যক্তিগত জীবন যেমন আলোচনায় ছিল, তেমনি বিতর্কেও জড়িয়েছিল। ২০১৫ সালে তিনি বিয়ে করেন ফারুক আহমেদকে, তবে বিয়ের কিছুদিন পরই সম্পর্ক ভেঙে যায়। পরে তিনি আবারও সংসার শুরু করেন, তবে সেই ব্যক্তিগত জীবন তিনি গণমাধ্যমের আলো থেকে দূরে রেখেছেন।
শখ নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন—
“আমার ব্যক্তিগত বিষয়গুলো এখন অনেক গোপন রাখি। আমি শিখেছি, কিছু জিনিস কেবল নিজের জন্যই থাকা দরকার।”
এই বক্তব্যে তাঁর অভিজ্ঞতার ছাপ স্পষ্ট। জীবনের উত্থান-পতন তাঁকে আরও পরিণত করেছে।
বিরতি ও আত্মঅন্বেষণ
একসময় শখ অভিনয় থেকে দূরে সরে যান। দর্শক-ভক্তরা প্রশ্ন করছিলেন—“শখ কোথায়?” তিনি প্রকাশ্যে খুব একটা দেখা দিতেন না। এই সময় তিনি নিজের জীবন, পরিবার এবং মানসিক প্রশান্তিতে মনোযোগ দেন।
তিনি নিজেকে নতুন করে চিনতে শুরু করেন। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন—
“আমি বুঝেছি, খ্যাতি সব নয়। নিজের সঙ্গে শান্তি থাকাটা অনেক বড় ব্যাপার।”
এই বিরতির সময় শখ সমাজসেবা, শিশু শিক্ষা এবং নারী ক্ষমতায়ন বিষয়েও আগ্রহী হন। বিভিন্ন উদ্যোগে অংশ নিয়ে তিনি চেষ্টা করেছেন নিজের প্রভাবকে সমাজে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগাতে।
পুনরায় ফিরে আসা
২০২০ সালের পর তিনি আবারও টেলিভিশনে ফিরতে শুরু করেন। নতুন প্রজন্মের নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করে তিনি প্রমাণ করেন—অভিনয়ের প্রতি তাঁর ভালোবাসা আগের মতোই অটুট।
‘শেষ দেখা’, ‘তোমার নাম ভালোবাসা’, ‘মায়া নগরী’ প্রভৃতি নাটকে তিনি ফিরে আসেন সেই পরিচিত উজ্জ্বলতায়। এবার তাঁর অভিনয়ে দেখা যায় আরও গভীরতা ও পরিমিতি—যেন এক জীবনের অভিজ্ঞতা জমে আছে প্রতিটি সংলাপে।
ব্যক্তিত্ব ও দর্শনের পরিবর্তন
শখ এখন অনেকটাই পরিণত। খ্যাতির ঝলকানি থেকে দূরে থেকে তিনি খুঁজে পান আত্মতৃপ্তি। তাঁর কথায়,
“যে দিনটা শান্তিতে কাটাতে পারি, সেটাই আমার সবচেয়ে বড় অর্জন।”
তিনি এখন অভিনয়কে কেবল পেশা নয়, এক ধরণের আত্মপ্রকাশ হিসেবে দেখেন। চরিত্র বাছাইয়ে সতর্ক, গল্পে গভীরতা চান, এবং এমন চরিত্রে অভিনয় করতে চান যা সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সোশ্যাল মিডিয়া ও নতুন প্রজন্মের অনুপ্রেরণা
বর্তমানে শখ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সক্রিয়। তাঁর ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুক পেজে অনুরাগীদের ভালোবাসা এখনো অব্যাহত। তিনি প্রায়ই নতুন শিল্পীদের উৎসাহ দেন, বিশেষ করে তরুণী মডেল-অভিনেত্রীদের।
তাঁর পোস্টগুলোতে দেখা যায়—নির্মল জীবনদর্শন, প্রকৃতি-প্রেম, পরিবার ও মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব নিয়ে বার্তা।
বিতর্ক, গুজব ও তার জবাব
খ্যাতির সঙ্গে যেমন প্রশংসা আসে, তেমনি গুজবও আসে। শখের জীবনেও ছিল নানা বিতর্ক—সম্পর্ক, ক্যারিয়ার বিরতি, এমনকি কিছু ব্যক্তিগত মন্তব্য নিয়েও। তবে তিনি সবসময় একধরনের ধৈর্য ও নীরবতার মধ্য দিয়ে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন।
একবার তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন—
“মানুষ আমাকে যতটা জানে বলে মনে করে, আসলে ততটা জানে না।”
এই এক বাক্যেই তাঁর ব্যক্তিত্বের গভীরতা বোঝা যায়—তিনি নিজের পৃথিবীতে শান্ত, পরিণত ও দৃঢ়।
সখের শিল্পদর্শন
শখের কাছে অভিনয় কেবল বিনোদন নয়, মানবিক প্রকাশের মাধ্যম। তিনি মনে করেন—
“একজন অভিনেত্রীর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো মানুষের অনুভূতিকে ছুঁয়ে যাওয়া।”
তাঁর অভিনয়ে কখনও দেখা যায় মৃদু হাসি, কখনও বিষণ্ণতা, কখনও মাতৃত্বের কোমলতা—যা তাঁকে করে তুলেছে একজন বহুমাত্রিক শিল্পী।
সহশিল্পীদের চোখে সখ
সহঅভিনেতা আফরান নিশো এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন—
“শখের সঙ্গে কাজ করা মানেই একধরনের আনন্দ। সে সেটে সবসময় প্রাণ আনতে পারে।”
অন্যদিকে পরিচালক চয়নিকা চৌধুরী বলেন:
“শখকে আমি সবসময় ‘ইমোশনাল অ্যাক্টর’ হিসেবে দেখি। সে নিজের চরিত্রে পুরোপুরি মিশে যেতে পারে।”
এই প্রশংসাগুলো প্রমাণ করে, তিনি কেবল জনপ্রিয় নন—পেশাগতভাবেও সম্মানিত।
নারী হিসেবে সংগ্রাম
বাংলাদেশে নারী শিল্পীদের পথ কখনও সহজ নয়। শখও এর ব্যতিক্রম নন। কখনও ভুল বোঝাবুঝি, কখনও সমালোচনা, আবার কখনও সামাজিক চাপ—সবকিছুই তাঁকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। কিন্তু তিনি কখনও পিছিয়ে যাননি।
তিনি বলেন:
“আমরা নারীরা যদি নিজেদের প্রতি বিশ্বাস রাখি, তাহলে কোনো বাধাই বড় নয়।”
এই বিশ্বাসই তাঁকে টিকিয়ে রেখেছে, দৃঢ় করেছে এবং নতুন প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
সখের বর্তমান জীবন
বর্তমানে শখ ঢাকাতেই থাকেন; বিদেশ সফরেও যান। তিনি নাটক ও বিজ্ঞাপন দুটিতেই কাজ করছেন নির্বাচিতভাবে। পাশাপাশি কিছু সামাজিক উদ্যোগেও যুক্ত আছেন।
শখের জীবনে এখন শান্তি, পরিবার, এবং নিজের ভালো লাগা নিয়ে নতুন এক অধ্যায় চলছে। তিনি বলেন,
“আগে আমি শুধু কাজের ভেতরেই বাঁচতাম, এখন আমি জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করি।”
সমাজসেবায় অংশগ্রহণ
শখ শিশু শিক্ষা ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। তিনি মনে করেন, শিল্পীদের সমাজে দায়িত্ব আছে। তিনি কিছু সময় ব্যয় করেন নারীদের দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচিতেও।
এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন—
“শিল্পী হিসেবে আমাদের উচিত সমাজে আলো ছড়ানো। জনপ্রিয়তা মানে কেবল খ্যাতি নয়, দায়িত্বও।”
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
শখ চান পরিচালক হিসেবে কাজ করতে। তাঁর স্বপ্ন একদিন নিজেই একটি গল্প লিখে সেটি পর্দায় রূপ দেবেন।
“আমি চাই এমন একটি চরিত্র সৃষ্টি করতে, যে মানুষকে ভাবাবে, অনুপ্রাণিত করবে,”—বলেছিলেন তিনি।
এছাড়াও তিনি অভিনয়ের পাশাপাশি ফ্যাশন ও সৌন্দর্যবিষয়ক একটি প্ল্যাটফর্ম শুরু করার চিন্তা করছেন, যেখানে তরুণী শিল্পীরা নিজেদের বিকাশ ঘটাতে পারবেন।
জনপ্রিয়তার মূল্য ও একাকীত্ব
খ্যাতি যেমন আনন্দ দেয়, তেমনি একাকীত্বও আনে। শখের নিজের কথায়—
“জনপ্রিয়তার আড়ালে একটা নিঃসঙ্গতা থাকে। সবাই তোমাকে দেখে, কিন্তু খুব কম মানুষ বোঝে।”
এই উপলব্ধি তাঁকে মানবিক করে তুলেছে। তাই এখন তিনি খ্যাতির চেয়ে মানসিক শান্তিকেই বেশি মূল্য দেন।
সমকালীন নাটকে সখের প্রভাব
বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটকে শখ এক নতুন ধারা এনেছিলেন—প্রাকৃতিক অভিনয়, সংলাপে আবেগের মিশ্রণ, এবং নারীর আত্মপরিচয়-ভিত্তিক গল্পে তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। তিনি সেই প্রজন্মের প্রতীক, যারা নারীর কণ্ঠকে শক্তিশালীভাবে উপস্থাপন করেছেন।
আজকের অনেক তরুণ অভিনেত্রী তাঁকে রোল মডেল হিসেবে দেখেন। যেমন—মেহজাবীন চৌধুরী একবার বলেছিলেন,
“শখ আপু আমাদের দেখিয়েছেন, কীভাবে মিষ্টি হাসি দিয়েও শক্ত চরিত্র তুলে ধরা যায়।”
সখের জীবনদর্শন
শখ বিশ্বাস করেন—
“সফলতা মানে শুধু ক্যামেরার আলো নয়, নিজের ভেতরের শান্তি খুঁজে পাওয়া।”
এই দর্শনই তাঁর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে প্রতিফলিত হয়েছে।
তিনি বলেন,
“আমি ভুল করেছি, শিখেছি, আবার চেষ্টা করেছি। জীবনের প্রতিটি ধাপই আমার শিক্ষক।”
আনিকা কবির শখ—একজন শিল্পী, এক সংগ্রামী নারী, এক প্রেরণা। তাঁর জীবনের গল্প কেবল বিনোদনের নয়, এক মানবিক যাত্রা। শিশু মডেল থেকে জনপ্রিয় অভিনেত্রী, আবার সেই আলো থেকে দূরে গিয়ে নিজেকে খুঁজে পাওয়া—সব মিলিয়ে সখের জীবন বাংলাদেশের টেলিভিশন ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়।