বৈশ্বিক বাণিজ্যে নতুন উত্তেজনা
চীনের বিরল খনিজ বা ‘রেয়ার আর্থ মিনারেলস’ রপ্তানিতে নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অর্থনৈতিক পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। তিনি এমন ইঙ্গিতও দিয়েছেন যে, এশিয়া সফরের সময় নির্ধারিত চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক বাতিল করতে পারেন।
দীর্ঘদিন ধরেই চীন বিশ্বে এই খনিজগুলোর উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রাধান্য ধরে রেখেছে। ফলে এ খাতের যেকোনো নীতিগত পরিবর্তন বৈশ্বিক শিল্প ও প্রযুক্তি বাজারে বড় প্রভাব ফেলে।
রেয়ার আর্থ মিনারেলস কী এবং কতটা ‘রেয়ার’?
‘রেয়ার আর্থ’ আসলে পর্যায় সারণির ১৭টি ধাতব উপাদানের সমষ্টি, যার মধ্যে স্ক্যান্ডিয়াম, ইট্রিয়াম ও ল্যানথানাইড গ্রুপের উপাদানগুলো রয়েছে।
নামের মধ্যে ‘রেয়ার’ থাকলেও এসব উপাদান পৃথিবীর ভূত্বকে মোটেও বিরল নয়। এগুলো সোনা থেকেও বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়, কিন্তু উত্তোলন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ জটিল, ব্যয়বহুল এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
এই খনিজগুলো স্মার্টফোন, উইন্ড টারবাইন, এলইডি লাইট, টেলিভিশন স্ক্রিন থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি, এমআরআই স্ক্যানার এবং ক্যানসার চিকিৎসার যন্ত্রেও ব্যবহৃত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তিতে গুরুত্ব
এই উপাদানগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রযুক্তির জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো ব্যবহৃত হয় এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান, সাবমেরিন, স্যাটেলাইট, টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র ও লেজার সিস্টেম তৈরিতে।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিক খনন করা রেয়ার আর্থের ৬১ শতাংশই আসে চীন থেকে, আর প্রক্রিয়াজাতকরণের ৯২ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে দেশটি।
‘হেভি’ ও ‘লাইট’ রেয়ার আর্থের পার্থক্য
রেয়ার আর্থ মিনারেলস দুই ধরনের—‘লাইট’ ও ‘হেভি’। ভারী রেয়ার আর্থ তুলনামূলক কম পাওয়া যায় এবং যুক্তরাষ্ট্র এগুলো আলাদা করার সক্ষমতা এখনো অর্জন করেনি।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি মাত্র রেয়ার আর্থ খনি সক্রিয় রয়েছে, কিন্তু সেখান থেকে আহরিত খনিজ এখনো চীনে পাঠানো হয় পরিশোধনের জন্য।
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের গ্রেসেলিন বাস্কারান বলেন, “চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের এই নির্ভরশীলতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।”
নতুন নিষেধাজ্ঞা ও ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া
চীন সম্প্রতি আরও পাঁচটি রেয়ার আর্থ উপাদান—হলমিয়াম, আর্বিয়াম, থুলিয়াম, ইউরোপিয়াম ও ইটার্বিয়াম—রপ্তানিতে লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করেছে। ফলে নিয়ন্ত্রণাধীন উপাদানের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২। একই সঙ্গে চীন ঘোষণা দিয়েছে, রেয়ার আর্থ প্রযুক্তি বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রেও অনুমতি নিতে হবে।
চলতি বছরের জুনে ট্রাম্প প্রকাশ্যে অভিযোগ করেছিলেন যে, চীন বাণিজ্যবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করেছে, কারণ তারা সাতটি রেয়ার আর্থ খনিজের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরতা ও সম্ভাব্য প্রভাব
২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ৭০ শতাংশ রেয়ার আর্থ আমদানি এসেছে চীন থেকে। ফলে নতুন নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা শিল্পে বড় প্রভাব ফেলতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
ট্রাম্পের মতে, এটি যুক্তরাষ্ট্র–চীন বাণিজ্যযুদ্ধের একটি “বড়সড় উত্তেজনার ধাপ”। তিনি ট্রুথ সোশালে লিখেছেন, “চীন যদি বৈরী বাণিজ্যনীতি চালু রাখে, আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে অর্থনৈতিক পাল্টা ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হব।”
তিনি আরও যোগ করেন, “যে উপাদানগুলো তারা একচেটিয়া করেছে, তার প্রতিটির বিকল্প আমাদের কাছেও রয়েছে।”
বিশ্বের দুই বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তির এই দ্বন্দ্ব কেবল বাণিজ্য নয়, ভবিষ্যতের প্রযুক্তি ও সামরিক ভারসাম্যকেও প্রভাবিত করতে পারে। রেয়ার আর্থ খনিজ নিয়ন্ত্রণ এখন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার নতুন যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।
#রেয়ারআর্থ #চীন #ট্রাম্প #বাণিজ্যযুদ্ধ #প্রযুক্তি #সারাক্ষণ_রিপোর্ট