রাজনৈতিক টানাপোড়েনের নতুন অধ্যায়
জাপানে নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের কাউন্টডাউন শুরু হয়েছে। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) নেতৃত্বাধীন জোট থেকে কোমেইতো দলের বেরিয়ে যাওয়া পুরো রাজনৈতিক ভারসাম্যকে নাড়িয়ে দিয়েছে। আগামী ১০ দিনের মধ্যে সংসদের অধিবেশন বসার আগে ভোটের সমীকরণ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো মরিয়া হয়ে কাজ করছে।
জাপানের উভয় সংসদ কক্ষেই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের ভোট অনুষ্ঠিত হয়। যদি দুই কক্ষের সিদ্ধান্ত আলাদা হয়, তবে নিম্নকক্ষের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হিসেবে গণ্য হয়। প্রথম দফার ভোটে কোনো প্রার্থী সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে শীর্ষ দুই প্রার্থীর মধ্যে পুনরায় ভোট অনুষ্ঠিত হয়।
বর্তমানে কোমেইতো দলের ২৪টি আসন রয়েছে, এবং তারা জানিয়েছে যে তারা এলডিপি সভাপতি সানায়ে তাকাইচিকে সমর্থন দেবে না। ফলে বিরোধী দলগুলো এখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিকল্প প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়ার চিন্তা করছে। এতে ২০১২ সালের পর প্রথমবারের মতো এলডিপি ক্ষমতার বাইরে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নিকোই এশিয়া বিশ্লেষণ করেছে—এই নির্বাচনে তিনটি সম্ভাব্য পথ কী হতে পারে।
১. তাকাইচি প্রধানমন্ত্রী হবেন, এলডিপি একক দল হিসেবে ক্ষমতায়
নিম্নকক্ষের মোট সদস্য সংখ্যা ৪৬৫, আর সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ২৩৩ ভোট। বর্তমানে এলডিপির হাতে আছে ১৯৬টি আসন। আগে কোমেইতো সঙ্গে থাকায় দুই দল মিলে নিয়ন্ত্রণ করত ২২০টি আসন।
অন্যদিকে তিন প্রধান বিরোধী দল—সংবিধানভিত্তিক ডেমোক্রেটিক পার্টি (সিডিপি), জাপান ইনোভেশন পার্টি এবং ডেমোক্রেটিক পার্টি ফর দ্য পিপল (ডিপিএফপি)—মোট ২১০টি আসন ধরে রেখেছে। আগে এই তিন দল একত্রিত হলেও এলডিপি-কোমেইতো জোটের সংখ্যা ছাড়াতে পারেনি। কিন্তু এখন যদি তাকাইচি কেবল এলডিপির ভোট পান, তবে বিরোধী জোট একত্র হয়ে সরকার পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
তবে যদি কোমেইতো নিজের প্রার্থীকে ভোট দেয় এবং বিরোধী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তাকাইচি কম আসন নিয়েও জিতে যেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন, তবে এলডিপি নেতৃত্বে একটি সংখ্যালঘু সরকার গঠিত হবে।
২. তাকাইচি প্রধানমন্ত্রী হবেন, অন্যান্য দলের সহযোগিতায়
যদি বিরোধী দলগুলো সমন্বয় করতে ব্যর্থ হয় এবং তাকাইচি কিছু অ-এলডিপি ভোট পেতে পারেন, তাহলে তিনি জাপানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে এগিয়ে যাবেন।
এলডিপি শুরুতে ডিপিএফপি’কে সম্ভাব্য অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করেছিল। তাকাইচি ৫ অক্টোবর ডিপিএফপি নেতা ইউইচিরো তামাকির সঙ্গে বৈঠক করেন, আর পরদিন এলডিপি উপ-সভাপতি তারো আসো দলটির মহাসচিব কাজুয়া শিমবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তখনও সবাই ধারণা করেছিল কোমেইতো জোটে থাকবে।
কিন্তু কোমেইতো বেরিয়ে যাওয়ার পর ডিপিএফপি আগ্রহ হারায়, কারণ এলডিপি-ডিপিএফপি একত্রে গেলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলে নীতিনির্ধারণে তারা প্রভাব ফেলতে পারবে না।
তামাকি সাংবাদিকদের বলেন, “কোমেইতো বেরিয়ে যাওয়ার পর সরকারের সঙ্গে যুক্ত হওয়া আমাদের জন্য অর্থহীন।”
জাপান ইনোভেশন পার্টিও একই অবস্থান নেয়। তারা মূলত কৃষিমন্ত্রী শিনজিরো কোইজুমিকে পরবর্তী এলডিপি প্রধান হিসেবে প্রত্যাশা করেছিল, কিন্তু তাকাইচির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তেমন নেই।
ডিপিএফপি ও ইনোভেশন পার্টির কিছু সদস্য মনে করেন, এলডিপির সঙ্গে জোট করলে তাদের দলীয় ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এলডিপির আশা—অতীতে ইনোভেশন পার্টি বা ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য থাকা সাতজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য তাকাইচিকে ভোট দিতে পারেন। এতে তাকাইচির ভোট বেড়ে ২০৩ এ পৌঁছাবে। ইনোভেশন পার্টি যোগ দিলে এলডিপি নেতৃত্বাধীন জোট ২১০ এর বেশি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে।
অন্যদিকে, ডানপন্থী জনপ্রিয় দল সানসেইতো’র নেতা সোহেই কামিয়া স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, তারা এলডিপির সঙ্গে জোটে যাবেন না।
৩. তামাকি প্রধানমন্ত্রী হবেন, বিরোধী দলগুলো একজোট হয়ে
বিরোধী দলগুলো তাকাইচির জয় ঠেকাতে একত্র হতে পারে এবং ডিপিএফপি নেতা ইউইচিরো তামাকিকে প্রার্থী হিসেবে সমর্থন দিতে পারে। বর্তমানে তাকাইচির বিপরীতে তামাকিই একমাত্র শক্তিশালী নাম।
সিডিপি নেতা ইয়োশিহিকো নোদাকে সমর্থন না করায় তামাকি বিরোধী ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছেন। যদি সিডিপি, ইনোভেশন পার্টি ও ডিপিএফপি ঐক্যবদ্ধ হয়, তাহলে তামাকির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা বাস্তব হতে পারে।
নোদা এক পডকাস্টে বলেন, “সব দলের নেতাদেরই সমান সুযোগ আছে, তাই তামাকিকেও সমর্থন দেওয়া সম্ভব।”
তবে ডিপিএফপি ও অন্যান্য দলের মধ্যে পারমাণবিক শক্তি, নিরাপত্তা নীতি ও সংবিধান সংশোধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতভেদ রয়ে গেছে। তামাকি বলেছেন, সহযোগিতা করতে হলে সিডিপিকে তাদের নিরাপত্তা নীতি পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
ডিপিএফপি পারমাণবিক শক্তির পক্ষে নমনীয়, কারণ তারা বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর শ্রমিক ইউনিয়নের সমর্থন পায়। কিন্তু সিডিপি নতুন পারমাণবিক কেন্দ্র স্থাপন বা সম্প্রসারণে অনিচ্ছুক, যদিও পুরোনো কেন্দ্রগুলো পুনরায় চালু করার বিষয়ে তারা শর্তসাপেক্ষে রাজি।
তামাকির ভাষায়, “যদি সিডিপি পারমাণবিক শক্তি বাতিল করতে চায় বা পুনরায় চালুর অনুমোদন না দেয়, তাহলে ঐক্য গড়া কঠিন।”
সিডিপির ৪০–৫০ জন উদারপন্থী সংসদ সদস্য আছেন; তারা সবাই যদি দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করেন, তাহলে তামাকির পক্ষে প্রয়োজনীয় ভোট পাওয়া কঠিন হতে পারে।
২০ অক্টোবরের সপ্তাহে পার্লামেন্ট অধিবেশন
প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের জন্য পার্লামেন্টের বিশেষ অধিবেশন ২০ অক্টোবরের সপ্তাহে বসবে। তার আগ পর্যন্ত প্রতিটি দলই নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে রাজনৈতিক দর-কষাকষিতে ব্যস্ত থাকবে। পরিস্থিতি এতটাই অনিশ্চিত যে, শেষ মুহূর্তে অনেক দলই নিজেদের ঘোষিত নীতি উপেক্ষা করে অপ্রত্যাশিতভাবে ভোট দিতে পারে।
# জাপান, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন, সানায়ে তাকাইচি, ইউইচিরো তামাকি, জাপানি রাজনীতি, এলডিপি, কোমেইতো, নোদা, জাপান সংসদ, সারাক্ষণ রিপোর্ট