অনেক শ্রোতার কাছে সমকালীন সঙ্গীত এখনো জটিল, সুরহীন ও “বোঝা কঠিন” এক ঘরানা। ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতপ্রেমীরা প্রায়ই বলেন—“পুরানো সুর ভালো লাগে, নতুনগুলো নয়।” অথচ যে সঙ্গীতকে তারা “নতুন” ভাবেন, তার অনেকাংশই আসলে সাত দশক আগের আধুনিকতার ধারা—যেমন পিয়ের বুলেজের “Le Marteau Sans Maître”।
এই সুরগুলি সবাইকে টানবে এমন নয়, কিন্তু এগুলোই আধুনিক সঙ্গীতের ইতিহাস গড়ে দিয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো—যে সময়ের অ্যাভান্ট-গার্ড সঙ্গীত আজ ইতিহাস, সেটিই কেন এখনো “সমকালীন সঙ্গীত” বলে বিবেচিত হয়?
আধুনিকতার উত্তরাধিকার ও সমকালীন সঙ্গীতের বহুমাত্রিকতা
আজকের পৃথিবীতে সঙ্গীতের কোনো একক ধারা নেই। পরিচয়ের অনুসন্ধান থেকে শুরু করে পরিবেশের শব্দ পর্যন্ত—সবই সঙ্গীতের ভাষা হতে পারে। মিসি মাজোলির “Dark With Excessive Bright” যেমন ইতিহাসের দীর্ঘ প্রভাব বহন করে, তেমনি আনিয়া লকউডের “A Sound Map of the Danube” প্রকৃতির রেকর্ড করা শব্দ দিয়ে তৈরি এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা।
নিউ ইয়র্ক ফিলহারমোনিকের প্রধান নির্বাহী মাতিয়াস তারনোপলস্কি বলেন, “আজকের সুরকাররা কেউ ক্লাসিক্যাল ও রোমান্টিক ঘরানায়, কেউ আধুনিকতায়, কেউ আবার জ্যাজ বা নিজস্ব ঐতিহ্য মিশিয়ে লিখছেন—সমকালীন সঙ্গীত কোনো একক রূপ নয়।”
তবে অনেক শ্রোতার কাছে এটি এখনো “সবজির মতো”—খাওয়া বাধ্যতামূলক, কিন্তু উপভোগ নয়। এর পেছনে আছে যুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদীদের উত্তরাধিকার।
যুদ্ধোত্তর ইউরোপে নতুন সুরধারার জন্ম
পিয়ের বুলেজ, লুইজি নোনো ও কার্লহেইঞ্জ স্টকহাউজেন—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে আসা এই তিন সুরকার এক নতুন সঙ্গীতধারা সৃষ্টি করেন। তারা আরনল্ড শোয়েনবার্গের সুরবিন্যাস পদ্ধতিকে ভিত্তি করে, কিন্তু রোমান্টিক আবেগকে প্রত্যাখ্যান করেন—যেটি নাৎসি শাসন দখল করেছিল।
জার্মান শহর ডার্মস্টাড, যুদ্ধের পর প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত, হয়ে ওঠে আধুনিক সঙ্গীতের কেন্দ্র। সঙ্গীত যেমন ভেঙে পড়েছিল, তেমনি নতুন করে গড়ে তুলতে হতো।
এই প্রজন্মের বৈশিষ্ট্য ছিল সেরিয়ালিজম, গঠনমূলক রূপের প্রতি আগ্রহ, ইলেকট্রনিক শব্দের ব্যবহার ও নতুন যন্ত্রবাজানোর কৌশল। ধীরে ধীরে সুরচর্চা একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের ভেতরে প্রবেশ করে।
বুলেজ: বিতর্কিত অথচ প্রভাবশালী এক যুগস্রষ্টা
বুলেজ ছিলেন সেই প্রজন্মের সবচেয়ে আলোচিত মুখ। তাঁর কণ্ঠ ছিল কঠোর, মতবাদ দৃঢ়। তিনি শুধু সুরকারই নন—প্যারিসে IRCAM ও Cité de la Musique প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি আধুনিক সঙ্গীতের প্রতিষ্ঠানিক কাঠামোও গড়ে তুলেছিলেন।
তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল দ্বিধাবিভক্ত—একদিকে তিনি আন্তন ওয়েবার্নের জটিল সুরে স্পষ্টতা আনতেন, অন্যদিকে ব্রাহ্মসের মতো রোমান্টিক সুরের প্রতি অনাগ্রহ দেখাতেন। এতে তরুণ সঙ্গীতজ্ঞরা তাঁকে এক নৈতিক দিকনির্দেশক হিসেবে দেখতেন।
বুলেজের প্রভাব এতটাই প্রবল ছিল যে, এক তরুণ সুরকারের কাজ তিনি অপছন্দ করলে তার ক্যারিয়ার প্রায় শেষ হয়ে যেত। ফিনল্যান্ডের সুরকার ও কন্ডাক্টর এসা-পেকা সালোনেন বলেন, “বুলেজ ছিলেন নৈতিক আলোকবর্তিকা—তাকে অনুসরণ করলেই সঠিক পথে আছি মনে হতো।”
বিকল্প ধারার উত্থান ও মুক্তচিন্তার যুগ
১৯৭০ ও ৮০-এর দশকে আমেরিকায় মিনিমালিজমের উত্থান ঘটে—ফিলিপ গ্লাস ও জন অ্যাডামস এই ধারা জনপ্রিয় করেন। এর ফলে “দল বেছে নেওয়ার” সংস্কৃতি তৈরি হয়—বুলেজের পক্ষ বা বিপক্ষে।
মিসি মাজোলি বলেন, “দুই দশক আগেও সঙ্গীত বিদ্যালয়গুলো এখনো সেই বিভাজনের প্রভাবের অধীনে ছিল, যদিও বাস্তবে সঙ্গীত তখন অনেক বেশি মুক্ত হয়ে গিয়েছিল।”
আজকের ইউরোপীয় সুরকারদের মধ্যে ওলগা নয়ুউরিথ ও ম্যাথিয়াস পিনশার এই ঐতিহ্য বহন করছেন। তাদের কাজ জটিল হলেও বারবার শুনলে গভীর অর্থ প্রকাশ পায়—যেমন নয়ুউরিথের “Masaot/Clocks Without Hands”।
সমকালীন সঙ্গীতের গ্রহণযোগ্যতা ও শ্রোতাদের মানসিকতা
বুলেজের “Rituel in Memoriam Bruno Maderna” শুনলে প্রতিবারই নতুন কাঠামো ও আবেগ উন্মোচিত হয়। কিন্তু অনেক শ্রোতার কাছে এটি এখনো অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা।
মাজোলি বলেন, “আমি যেমন একবার খারাপ অভিজ্ঞতার পর ১৫ বছর চিংড়ি খাইনি, তেমনি অনেক শ্রোতা একটি কঠিন সুর শুনে সারাজীবন আধুনিক সঙ্গীত এড়িয়ে চলেন।”
তিনি স্মরণ করেন, শিকাগো সিম্ফনি অর্কেস্ট্রার রেসিডেন্ট কম্পোজার থাকাকালে (২০১৮–২০২১) কিছু শ্রোতা তাঁকে বলেছিলেন—“আশা করি আপনি রালফ শাপির মতো লিখবেন না।” অথচ শাপে ২০০২ সালে মারা গেছেন, কিন্তু ১৯৯১ সালের এক বিতর্কিত কনসার্ট এখনো তাদের মনে গেঁথে আছে।
আধুনিকতার ছায়া থেকে বেরিয়ে আসার সময়
যুদ্ধোত্তর অ্যাভান্ট-গার্ড সঙ্গীতের ধাঁচ আজও টিকে থাকলেও তার প্রভাব এখন ঐতিহাসিক। ফিলহারমোনিকের মতো কনসার্টে এসব কাজ এখন “বিশেষ উপলক্ষ” হিসেবে পরিবেশিত হয়, নিয়মিত রেপার্টরির অংশ নয়।
এখনকার ছাত্রছাত্রীরা “Le Marteau” বাজাতে পারে সহজেই, কিন্তু তাদের কাছে এটি ইতিহাসের অংশমাত্র। সালোনেন বলেন, “আজকের তরুণদের কাছে বুলেজও অন্য যেকোনো ঐতিহাসিক ব্যক্তির মতো।”
নতুন প্রজন্মের সঙ্গীত: প্রেক্ষিত, ভারসাম্য ও আনন্দ
আজকের সঙ্গীতচর্চায় মূল নীতি হলো—“সঙ্গীত মানেই সঙ্গীত।”
তারনোপলস্কি বলেন, তাঁর কলেজপড়ুয়া সন্তানদের প্রভাবে তিনি ঘরানাকে আলাদা করে ভাবেন না। মাজোলি তাঁর ছাত্রদের বলেন—“পপ গান যেমন শোনো, তেমনি এলিয়ট কার্টার বা মেসিয়ানের সুরও শোনো।”
অতএব, সমকালীন সঙ্গীতকে বোঝার জন্য দরকার পুনরাবৃত্ত অভিজ্ঞতা ও উন্মুক্ত মন। প্রতিষ্ঠানগুলোকেও শ্রোতাদের রুচি গঠনে ভূমিকা নিতে হবে। যেমন একসময় স্ট্রাভিনস্কির “The Rite of Spring” বাজানো ছিল সাহসিকতার প্রতীক, এখন সেটিই সোল্ড-আউট কনসার্টের নিশ্চয়তা দেয়।
বুলেজ ও তাঁর প্রজন্ম ইতিহাস হয়ে গেছেন—এটাই স্বাভাবিক। তাঁদের কাজ যেমন নোনোর “Il Canto Sospeso” রাজনৈতিক প্রতিবাদের প্রেক্ষাপটে সমৃদ্ধ, তেমনি বেটোভেনের নবম সিম্ফনি ফ্রিডরিখ শিলারের দর্শনের সঙ্গে জড়িত—কিন্তু দুটিই কেবল সঙ্গীত হিসেবেও উপভোগ্য।
আজকের প্রজন্মের সুরকাররা, যেমন মিসি মাজোলি, চেষ্টা করেন শ্রোতাকে একসঙ্গে পরিচিতি ও বিস্ময়ের ভারসাম্যে টানতে—প্রমাণ করে যে সমকালীন সঙ্গীত আর ‘সহ্য করার’ বিষয় নয়, বরং ‘উপভোগ করার’ এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা।