খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের বুক চিরে বয়ে গেছে এক শান্ত অথচ ভয়াল নদী—ঢাকি নদী। নামটি ছোট হলেও এর প্রভাব বিশাল। এই নদীই বটবুনিয়া গ্রামের জীবন, এই নদীই ধ্বংসের কারণ। প্রতিদিনের জোয়ার-ভাটার স্রোতে এ নদী মানুষকে দেয় মাছ, দেয় জল, আবার কেড়ে নেয় ঘর, ক্ষেত আর ফসল।
ঢাকি নদী মূলত পশুর নদীর একটি শাখা, যা দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের জোয়ার-ভাটার প্রবল টানে প্রতিদিন নিজের গতিপথ বদলায়। একসময় এটি ছিল শান্ত স্রোতের নদী, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়ের কারণে এখন এটি বটবুনিয়ার জন্য এক অশান্ত প্রতিবেশ।
ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট: কোথায় এই বটবুনিয়া
বটবুনিয়া গ্রামটি খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার তিলডাঙ্গা ইউনিয়নে অবস্থিত। উত্তরে পশুর নদী, পূর্বে চালনা ও দক্ষিণে সুন্দরবনের সবুজ দেয়াল। এই পুরো অঞ্চলটি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পোল্ডার নং ৩১–এর অন্তর্ভুক্ত—একটি বাঁধঘেরা এলাকা, যা স্থানীয়দের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করার কথা ছিল।
কিন্তু বাস্তবে এই বাঁধ আজ দুর্বল, ক্ষয়ে যাওয়া ও বারবার ভেঙে পড়া। গত কয়েক বছরে ঢাকি নদীর চাপে বটবুনিয়ার বাঁধ একাধিকবার ভেঙেছে, প্রতিবারই গ্রামের অর্ধেক এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।
নদীর চরিত্র: স্রোত, ভাটার টান আর ক্রোধ
ঢাকি নদীকে স্থানীয়রা বলেন “জীবন্ত নদী”—কারণ এটি প্রতি বছর নিজের গতি, গভীরতা ও চর বদলায়। বর্ষায় এটি ফুলে-ফেঁপে ওঠে, ভাটার সময় মাটির তলা খুঁড়ে নতুন স্রোতের রাস্তা তৈরি করে।
জোয়ারের সময় যখন সমুদ্রের পানি পশুর নদী হয়ে ঢুকে পড়ে, তখন ঢাকির স্রোত বাড়ে; আর তখনই তার করাল গ্রাসে চলে যায় ঘরবাড়ি।
স্থানীয় জেলে আজিজ শেখ বলেন,
“এই নদী একদিকে আমাদের মা, আবার অন্যদিকে আমাদের শত্রু। মাছ দেয়, আবার ঘরও নিয়ে যায়।”
সাম্প্রতিক বিপর্যয়: ভাঙনে ডুবে যাওয়া বটবুনিয়া
২০২৫ সালের জুলাই মাসে ঘটে যায় ভয়াবহ ঘটনা। হঠাৎ এক রাতে, পোল্ডার ৩১–এর বাঁধের প্রায় ১৫০ মিটার অংশ ভেঙে পড়ে ঢাকি নদীতে। ভাঙনের স্থান ছিল তিলডাঙ্গার হরি মন্দিরের পাশে। এক রাতেই বটবুনিয়ার শতাধিক পরিবার ডুবে যায় জোয়ারের জলে।
প্রথম ধাক্কায় ডুবে যায় প্রায় ২০০ বিঘা ধানক্ষেত ও অসংখ্য মাছের ঘের। নদীর পানি ঢুকে পড়ে বসতবাড়িতে। গবাদিপশু ভেসে যায়, ঘরের চাল ভেঙে পড়ে, মানুষ আশ্রয় নেয় উঁচু জায়গায় বা স্কুলে।
গ্রামবাসী নিজেরা মাটি ও বালির বস্তা ফেলে বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করলেও, পরবর্তী পূর্ণিমার জোয়ারে সেই অস্থায়ী বাঁধও ধসে যায়। পরদিন সকালেই পুরো গ্রাম একাকার হয়ে যায় নদীর জলের সঙ্গে।
মানুষের কান্না, বেঁচে থাকার লড়াই
বটবুনিয়ার ৬০ বছরের কৃষক নূর ইসলাম বলেন,
“আমার তিন বিঘা জমি ছিল, এখন নদী। মাছের ঘের, ধান—সব শেষ। এখন আমি হাতের মজুরি খাই।”
তার স্ত্রী লতিফা বেগমের চোখে জল, “নদী তো এখন আমাদের শত্রু হয়ে গেছে। রাত হলে এখনো ভয় পাই, আবার যদি পানি আসে!”
অনেক পরিবারই এখন অন্যত্র চলে গেছে—কেউ আত্মীয়ের বাড়ি, কেউ অস্থায়ী আশ্রয়ে। শিশুদের স্কুল বন্ধ, কৃষকরা বেকার, জেলেরা নদীতে নামতে ভয় পান।
ভাঙনের কারণ: প্রকৃতি, অবহেলা ও ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা
নদীর প্রাকৃতিক প্রবণতা
ঢাকি নদী জোয়ার-ভাটার নদী। বছরে দুইবার প্রবল স্রোত নদীর পাড়ের নরম মাটি ভেঙে ফেলে। নদীর তলদেশ ক্রমে গভীর হচ্ছে, কিন্তু পাড়ের বাঁধ পুরনো ও দুর্বল—এটাই বড় বিপদ।
পুরনো ও অপরিকল্পিত বাঁধ
এই পোল্ডার নির্মিত হয় ১৯৬০–এর দশকে, তখনকার প্রযুক্তি ও মাটি দিয়ে। আজও সেই পুরনো বাঁধই মেরামত করে ব্যবহার করা হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি দুর্বল হয়েছে, কিন্তু বড় কোনো সংস্কার হয়নি।
অব্যবস্থাপনা ও বিলম্ব
বাঁধ ভাঙার পর স্থানীয়রা বহুবার পানি উন্নয়ন বোর্ডে অভিযোগ করেছেন, কিন্তু দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অনেক সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় কাজ বিলম্বিত হয়। ভাঙনস্থলে সঠিক প্রকৌশল পদ্ধতি ব্যবহার না করায় মেরামতের পরও একই জায়গা আবার ধসে পড়ে।
প্রকৃতির প্রতিশোধ: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
বিশেষজ্ঞরা বলেন, খুলনার উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছরে গড়ে ৬ মিলিমিটার করে বাড়ছে। সেই সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় ও অতিবৃষ্টির প্রকোপ বেড়েছে। ফলে জোয়ারের পানির চাপ বেড়েছে ঢাকি ও পশুর নদীতে।
ঘূর্ণিঝড় আম্ফান, সিডর, আইলার পর থেকে এখানকার নদীগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি অস্থির। সমুদ্রের নোনা পানি ভাটার সময়ও নদীতে থেকে যায়, যার ফলে চাষের জমি লবণাক্ত হয়ে পড়ে। এতে ফসল হয় না, মানুষ বাধ্য হয়ে জীবিকা হারায়।
জীবিকা হারানোর বাস্তবতা
বটবুনিয়া গ্রাম একসময় ধান, চিংড়ি ও মাছ চাষে সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন অধিকাংশ জমি নোনা পানিতে ডুবে গেছে।
জেলে রফিক গাজী বলেন,
“আগে দিনে তিনবার জাল ফেললে মাছ পেতাম। এখন পানি নোনা, মাছও নেই। ঘের ভেসে গেছে, এখন কিস্তির টাকা দিতেও পারি না।”
নারী শ্রমিকরা আগে ধান রোপণে কাজ পেতেন, এখন তাদের কাজও বন্ধ। অনেকেই কাশফুল বা গোলপাতা কেটে বিক্রি করেন জীবিকার জন্য।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সংকট
ভাঙনে বটবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনের নিচে ফাটল দেখা দিয়েছে। শিশুরা এখন তিলডাঙ্গা বাজারের একটি দোকানঘরে অস্থায়ীভাবে পড়াশোনা করছে।
গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও পানি ঢুকে পড়ায় ওষুধ নষ্ট হয়েছে। ডায়রিয়া, ত্বকের সংক্রমণ ও পানিবাহিত রোগ বেড়েছে। মহিলারা বিশুদ্ধ পানি পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ান।
নারী ও শিশুর উপর প্রভাব
বন্যা ও ভাঙনের সময় নারীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন। আশ্রয়কেন্দ্রে গোপনীয়তা থাকে না, নিরাপত্তাও কম।
১৬ বছর বয়সী তৃষা বলে,
“আমাদের টয়লেট ভেসে গেছে। রাতে ভীষণ ভয় লাগে।”
নারীরা এখন নিজেরা একত্র হয়ে নিরাপদ পানির উৎস তৈরি ও স্যানিটেশন রক্ষা করছেন—এ যেন বেঁচে থাকার ছোট এক বিপ্লব।
প্রশাসনিক উদ্যোগ ও ত্রাণ
ভাঙনের পর স্থানীয় প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড অস্থায়ী মেরামত শুরু করে। বালুর বস্তা, জিওটিউব ও মাটি ফেলে বাঁধ আটকানোর চেষ্টা হয়। ত্রাণ হিসেবে চাল, শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি বিতরণ করা হয়।
তবে স্থানীয়রা বলছেন, এগুলো সাময়িক সমাধান। কৃষক কামাল হোসেন বলেন, “আমরা টিউব দিয়ে বাঁধ চাই না, আমরা চাই স্থায়ী বাঁধ—যাতে আমাদের ঘর টিকে থাকে।”
মানুষের প্রতিবাদ ও দাবি
গ্রামবাসী বারবার সভা করেছে। তারা চায়—
১. বিজ্ঞানসম্মত ও স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ,
২. নদীর খনন ও প্রবাহ ব্যবস্থাপনা,
৩. ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পুনর্বাসন,
৪. কৃষিজমি লবণমুক্ত করার ব্যবস্থা।
তারা আশঙ্কা করছে, যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, পুরো বটবুনিয়া একদিন মানচিত্র থেকে মুছে যাবে।
বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদদের মতামত
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান বলেন,
“ঢাকি নদী হলো উপকূলের জীবন্ত ইকোসিস্টেম। এটিকে শত্রু মনে না করে, বৈজ্ঞানিকভাবে পরিচালনা করতে হবে। বাঁধই একমাত্র সমাধান নয়—নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহও ফিরিয়ে দিতে হবে।”
তিনি আরও বলেন,
“যেখানে জোয়ার-ভাটার স্রোত প্রবল, সেখানে জিওটিউব নয়, আরসিসি রিটেইনিং ওয়াল প্রয়োজন। নইলে প্রতিবার একইভাবে ধ্বংস হবে।”
নদী ও মানুষের সহাবস্থান: ঐতিহ্য ও সম্পর্ক
ঢাকি নদী শুধু দুর্যোগের প্রতীক নয়, এটি খুলনার ঐতিহ্যও। এই নদীপাড়েই শত বছর আগে শুরু হয়েছিল নৌযাত্রা, চালনা বন্দরের ব্যবসা, আর বটবুনিয়া বাজার।
বর্ষায় নদী যখন ফুলে-ফেঁপে ওঠে, তখনও গ্রামের শিশুরা তীরে খেলতে আসে। জেলেরা এখনো ভোরের কুয়াশায় জাল ফেলে, আশা করে এক ঝুড়ি চিংড়ি হয়তো আজও ধরতে পারবে।
নদীর সঙ্গে এই মায়া কখনো ছিন্ন হয় না—এ যেন বেঁচে থাকার এক অনন্ত চক্র।
টেকসই ভবিষ্যতের পরিকল্পনা
বিশেষজ্ঞরা বলেন, খুলনা অঞ্চলের বাঁধ ও নদী ব্যবস্থাপনা এখন “ক্লাইমেট অ্যাডাপটেশন”–এর অংশ হিসেবে দেখতে হবে।
সমাধানের কিছু প্রস্তাব—
- স্থায়ী বাঁধ নির্মাণে আধুনিক প্রকৌশল প্রযুক্তি ব্যবহার,
- নদীর পলি ব্যবস্থাপনা ও ড্রেজিং,
- বিকল্প জীবিকার সুযোগ (ইকো-ট্যুরিজম,হস্তশিল্প, কৃষি-বৈচিত্র্য),
- সম্প্রদায়ভিত্তিক দুর্যোগ প্রস্তুতি প্রশিক্ষণ,
- মহিলা নেতৃত্বে স্থানীয় দুর্যোগ কমিটি গঠন,
- প্রতিটি পরিবারে নিরাপদ আশ্রয় ও নৌকাভিত্তিক উদ্ধার পরিকল্পনা।
মানুষের আশা ও পুনর্জাগরণ
বটবুনিয়ার মানুষ হাল ছাড়েনি। প্রতিদিন সন্ধ্যায় তারা বাঁধের ধারে যায়, নদীর দিকে তাকিয়ে বলে—
“নদী আমাদের ভয় দেখায়, কিন্তু আমরা আবার ঘর তুলব।”
তরুণরা একত্র হয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ মেরামত করে। মেয়েরা স্কুলে ফিরে যায়, কৃষকরা নতুন বীজ রোপণ করে।
এই দৃঢ়তা, এই সাহসই বটবুনিয়াকে জীবিত রাখে।
নদীর সঙ্গে লড়াই, ভালোবাসারও নাম
ঢাকি নদী খুলনার জীবনের প্রতিচ্ছবি—এক নদী, যা দেয়ও, কেড়েও নেয়ও।
বটবুনিয়ার মানুষ এখন জানে, প্রকৃতির বিরুদ্ধে নয়, তাকে সঙ্গে নিয়েই বাঁচতে হবে। তাদের স্বপ্ন একটাই—একটি টেকসই বাঁধ, নিরাপদ জীবন, আর এমন এক ভবিষ্যৎ যেখানে নদী হবে সঙ্গী, শত্রু নয়।
ঢাকির ঢেউয়ের শব্দে মিশে আছে তাদের ইতিহাস, সংগ্রাম ও আশার গান।
#ঢাকি_নদী #খুলনা #বটবুনিয়া #দাকোপ #নদীভাঙন #জলবায়ু_পরিবর্তন #উপকূলীয়_সংকট #বাংলাদেশ #সারাক্ষণ_রিপোর্ট