কুমিল্লার শ্বাসপ্রশ্বাসে এক বনভূমির নাম রাজেশপুর
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে কুমিল্লা জেলা—ইতিহাস, সংস্কৃতি, নদী, পাহাড় আর মানুষের বন্ধনে গড়া এক প্রাচীন জনপদ। এই জেলার অন্তর্গত রাজেশপুর ইউনিয়নের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত রাজেশপুর শালবন, যা একসময় ছিল অপরিমেয় সবুজের ভান্ডার। শত শত বছরের পুরোনো এই বনভূমি কেবল বৃক্ষরাজির আবাস নয়, এটি এক সময় স্থানীয় মানুষের জীবিকা, বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও পরিবেশগত ভারসাম্যের অংশ ছিল।
রাজেশপুর শালবন যেন এক নিঃশব্দ সঙ্গীত—যেখানে গাছের পাতার মর্মরধ্বনি, পাখির ডাক, বাতাসের ছোঁয়া, আর মাটির গন্ধ মিলেমিশে সৃষ্টি করেছে এক অনন্য পরিবেশ। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়া, বন উজাড় এবং দখলদারির চাপে এই প্রাকৃতিক ঐতিহ্য এখন হুমকির মুখে।
ইতিহাসের পাতায় রাজেশপুর শালবন
রাজেশপুর শালবনের ইতিহাস প্রায় ২০০ বছরের পুরনো বলে ধারণা করা হয়। ব্রিটিশ আমলে এই অঞ্চল ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ, যেখানে ঘন শালবন বিস্তৃত ছিল কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত। তখন এই বনাঞ্চল ছিল কাঠ, ফলমূল এবং ভেষজ উদ্ভিদের প্রধান উৎস। স্থানীয় রাজারা ও জমিদাররা শালগাছ কেটে রাজস্ব সংগ্রহ করতেন।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে বনভূমির মালিকানা সরকারের হাতে যায়। এরপর ধীরে ধীরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বসতি বিস্তার ও চাষাবাদের কারণে বনভূমি সংকুচিত হতে থাকে। তবুও রাজেশপুর শালবন এখনো কুমিল্লার প্রাণবায়ু হিসেবে টিকে আছে—যেন অতীতের এক নিদর্শন, যার ছায়ায় আজও প্রকৃতি বেঁচে আছে।
শালগাছের জগৎ: এক অদ্ভুত জীববৈচিত্র্যের গল্প
শালগাছ (Shorea robusta) বাংলাদেশের বনাঞ্চলের এক অপরিহার্য বৃক্ষ। রাজেশপুরের শালবনে এই গাছগুলো আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে শত বছর ধরে। গাছের নিচে পড়ে থাকা শুকনো পাতা, মাটির গন্ধ, আর গাছের কাণ্ডে শ্যাওলার আস্তরণ—সব মিলিয়ে তৈরি করেছে এক স্বতন্ত্র প্রতিবেশ ব্যবস্থা।
বনের অভ্যন্তরে পাওয়া যায় বুনো আম, জাম, কাঁঠাল, হারবরা, মেহগনি, গামারি, অর্জুন ও বিভিন্ন ভেষজ উদ্ভিদ। বর্ষাকালে বনের ভেতর দিয়ে ছোট ছোট ছড়াগুলো বইতে শুরু করে, আর তখন শালবন যেন হয়ে ওঠে এক জীবন্ত জলরঙের চিত্র।
এখানে দেখা যায় নানা প্রজাতির পাখি—শ্যামা, টিয়া, দোয়েল, বনচড়ুই, কাঠঠোকরা, এমনকি মাঝে মাঝে ময়ূরও। সরীসৃপের মধ্যে সাপ, গিরগিটি, বন্য ব্যাঙ আর বিভিন্ন পোকামাকড়ের প্রজাতি এই বনের খাদ্যজালের অংশ।
স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও বনসম্পর্ক
রাজেশপুর শালবনের চারপাশে রয়েছে ছোট ছোট গ্রাম—যেমন নলডাঙ্গা, রাজেশপুর, কান্দিরপাড় ও লাকসাম সংলগ্ন কিছু এলাকা। এখানকার মানুষের জীবনের সঙ্গে বনের সম্পর্ক গভীর। অনেকে জ্বালানি কাঠ, ফল, গাছের পাতা বা ভেষজ উদ্ভিদ সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে।
তবে এই নির্ভরতা কখনো কখনো অতি-ব্যবহারে রূপ নেয়, যা বনকে ধীরে ধীরে ক্ষয় করে দিচ্ছে। বনবিভাগ স্থানীয়দের সঙ্গে “সহযোগিতামূলক বন ব্যবস্থাপনা” চালু করলেও কার্যকর বাস্তবায়ন এখনও চ্যালেঞ্জের মুখে। অনেকেই বলেন—“বন শুধু সরকারের নয়, আমাদেরও ঘর। কিন্তু আমাদের অংশগ্রহণ ছাড়া বন বাঁচবে না।”
রাজেশপুরের প্রকৃতিতে ঋতুচক্রের রঙ
রাজেশপুরের বন যেন ঋতুর সঙ্গে রঙ বদলায়। গ্রীষ্মে গাছের পাতাগুলো হলুদ হয়ে ঝরে পড়ে; বর্ষায় নতুন সবুজে ভরে ওঠে গোটা বন। শরৎ ও হেমন্তে শালপাতার নিচে পড়ে থাকা শুকনো পাতাগুলো এক প্রাকৃতিক গালিচা তৈরি করে।
শীতে সকালের কুয়াশা বনের ভেতরে সাদা আস্তরণ ফেলে দেয়। তখন গাছের নিচে পায়ের শব্দও মৃদু হয়ে আসে। ভোরের শিশিরে ভিজে থাকা শালপাতা থেকে গড়িয়ে পড়া পানির ফোঁটা যেন প্রকৃতির অশ্রুবিন্দু।
বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য: হারিয়ে যাওয়া সঙ্গীরা
একসময় রাজেশপুর শালবনে ছিল বন্যপ্রাণীর স্বর্গরাজ্য। হরিণ, শিয়াল, বন্য খরগোশ, বুনো বিড়াল, গন্ধগোকুল—এরা ছিল এখানকার নিয়মিত বাসিন্দা। কিন্তু বন ধ্বংস, শিকার ও মানুষের অনুপ্রবেশের কারণে এখন তাদের দেখা মেলে না বললেই চলে।
তবুও কিছু ছোট প্রাণী—যেমন কাঠবিড়ালি, বনচিকা, পেঁচা ও ডাহুক এখনও এখানে টিকে আছে। স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন, “যখন শালবনের শেষ গাছ কাটা হবে, তখনই শেষ পাখিটাও উড়ে যাবে।”
রাজেশপুর শালবন ও পরিবেশগত গুরুত্ব
রাজেশপুর শালবন কুমিল্লা জেলার জলবায়ু ও প্রতিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ায়, ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণ করে এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে স্থানীয় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে।
এছাড়া, বনাঞ্চলের মাটি জলধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, যা আশপাশের কৃষি জমিগুলোর জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। বর্ষাকালে এই বন এলাকার ছায়া ও গাছের শিকড় বন্যা প্রতিরোধে সাহায্য করে।
বনবিনাশের ভয়াবহতা
দুঃখজনক হলেও সত্যি, গত তিন দশকে রাজেশপুর শালবনের আয়তন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। অবৈধ কাঠ কাটা, দখলদারি, ইটভাটা স্থাপন ও বসতি গড়ে ওঠায় বন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় এক প্রবীণ বাসিন্দা বলেন, “যে বনে একসময় সূর্যও ঢুকতে পারত না, এখন সেখানে ছেলেপিলে ক্রিকেট খেলে।” এ যেন এক মর্মান্তিক বাস্তবতা—যেখানে সভ্যতার নামে প্রকৃতি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
সংরক্ষণের উদ্যোগ ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ বন বিভাগ রাজেশপুর শালবন সংরক্ষণের জন্য কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বৃক্ষরোপণ, যৌথ বন ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ ও ইকো-ট্যুরিজম প্রকল্প।
তবে বাস্তবতায় দেখা যায়, এসব প্রকল্প টেকসই হয়নি। কারণ, স্থানীয় জনগণ পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ পায়নি, তদারকি দুর্বল, আর রাজনৈতিক প্রভাব অনেক সময় সংরক্ষণ প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত করে।
তবুও কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, যেমন “কুমিল্লা গ্রীন ফোরাম” বা “রাজেশপুর যুব বনবন্ধু ক্লাব” নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা ও গাছ লাগানোর কাজ করছে, যা আশার আলো জ্বালাচ্ছে।
ইকো-ট্যুরিজমের সম্ভাবনা
রাজেশপুর শালবন কেবল বনভূমি নয়—এটি পর্যটনের সম্ভাবনাময় স্থান। কুমিল্লা শহর থেকে মাত্র ২০ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত এই বনটি সহজেই ঘুরে দেখা যায়। এখানকার সবুজ গাছের ছায়া, পাখির ডাক, আর বাতাসের গন্ধ শহরবাসীর জন্য এক অপূর্ব প্রশান্তি দেয়।
ইকো-ট্যুরিজমকে ভিত্তি করে এখানে প্রকৃতি-বান্ধব হাঁটার পথ, তথ্যকেন্দ্র, বন্যপ্রাণী পর্যবেক্ষণ স্থান ও গাইডেড নেচার ট্রেইল তৈরি করা যেতে পারে। এতে যেমন স্থানীয়দের কর্মসংস্থান হবে, তেমনি বন সংরক্ষণেও আগ্রহ বাড়বে।
রাজেশপুরের লোকজ ঐতিহ্য ও বিশ্বাস
স্থানীয় গ্রামগুলোতে এখনো শোনা যায় শালবনের নানা লোককথা। কেউ বলে, বনের গভীরে এক ‘বনদেবী’ আছেন, যিনি বনরক্ষা করেন। কেউ বিশ্বাস করেন, পূর্ণিমার রাতে গাছের ফাঁকে অদ্ভুত আলো জ্বলে ওঠে—যা বনদেবীর উপস্থিতির ইঙ্গিত।
এমন বিশ্বাসগুলো একদিকে লোকজ সংস্কৃতির অংশ, অন্যদিকে প্রকৃতির প্রতি এক অদৃশ্য শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করে। স্থানীয় বয়স্করা বলেন, “আমরা বনের গাছ কাটতাম না, কারণ মনে করতাম সেখানে দেবতা বাস করে।” এই বিশ্বাসই একসময় বনকে টিকিয়ে রেখেছিল।
শিক্ষণীয় স্থান হিসেবে রাজেশপুর
রাজেশপুর শালবন এখন পরিবেশবিদ, ছাত্র, গবেষক ও পর্যটকদের জন্য এক আদর্শ শিক্ষার ক্ষেত্র। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা এখানে এসে প্রতিবেশব্যবস্থা, উদ্ভিদবিদ্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে—রাজেশপুর শালবনের উদ্ভিদ প্রজাতি হারানোর হার বছরে প্রায় ২%। যা রোধ না করলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে এখানকার মৌলিক জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হয়ে পড়বে।
মানুষের দায়িত্ব ও ভবিষ্যতের পথ
প্রকৃতি কখনো একা লড়াই করতে পারে না; মানুষের সহানুভূতি ও অংশগ্রহণই তার সবচেয়ে বড় শক্তি। রাজেশপুর শালবন টিকিয়ে রাখতে হলে স্থানীয়দের সচেতনতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততা এবং সরকারি নীতির সমন্বয় জরুরি।
একটি দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণ পরিকল্পনা দরকার—যাতে বৃক্ষরোপণ, ইকো-ট্যুরিজম, স্থানীয় কর্মসংস্থান ও শিক্ষা কার্যক্রম একসাথে চলে। বন সংরক্ষণ মানে কেবল গাছ রক্ষা নয়; এটি জলবায়ু, জীবন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করা।
সমাপ্তি: সবুজের আহ্বান
রাজেশপুর শালবন কেবল একটি স্থান নয়, এটি এক অনুভূতি—যেখানে প্রকৃতি নিঃশব্দে ফিসফিস করে, “আমাকে বাঁচাও।” কুমিল্লার এই বনভূমি আজ এক কঠিন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। যদি এখনই সংরক্ষণের পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে এই সবুজ ইতিহাস হারিয়ে যাবে কংক্রিটের নিচে।
তবু আশা আছে—যতদিন মানুষ প্রকৃতিকে ভালোবাসে, ততদিন বনও টিকে থাকবে। রাজেশপুর শালবন হয়তো আবার একদিন ফিরে পাবে তার হারানো সজীবতা, আর কুমিল্লার বুকে আবার শোনা যাবে পাতার ফিসফিস, পাখির গান, আর বাতাসের নিঃশব্দ সিম্ফনি।
#রাজেশপুর_শালবন #কুমিল্লা #বাংলাদেশের_বন #প্রকৃতি #পরিবেশ_সংরক্ষণ #ইকোট্যুরিজম #সারাক্ষণ_রিপোর্ট