আত্মসমর্পণের তিন সপ্তাহ পর আনুষ্ঠানিক চুক্তি
১৯৪৫ সালে জাপান আত্মসমর্পণের ঘোষণা দিলেও, চীনে তার পূর্ণ কার্যকর হতে তিন সপ্তাহ সময় লেগেছিল। ১০ আগস্ট টোকিও মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেয়, কিন্তু ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চীনে অবস্থানরত জাপানি সৈন্যদের অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ জারি হয়নি। এরপর ৯ সেপ্টেম্বর নানকিং শহরে আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে জেনারেল ইয়াসুতসুগু ওকামুরা তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে আত্মসমর্পণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন, যা একই দিনে চিয়াং কাই-শেকের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।
যুদ্ধশেষে বিপর্যস্ত চীন
চিয়াং কাই-শেকের হিসাব অনুযায়ী, যুদ্ধের শেষ দিকে চীনের মূল ভূখণ্ডে প্রায় ১৩ লাখ জাপানি সেনা রয়ে গিয়েছিল। আগস্টের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন মানচুরিয়ায় প্রবেশ করে জাপানের বিশাল কুয়ানটাং সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে। এছাড়া, চীনের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে ছিল প্রায় ১০ লাখ জাপানি বেসামরিক নাগরিক, আর ১ লাখ ৭০ হাজার সৈন্য অবস্থান করছিল ফর্মোসায় (বর্তমান তাইওয়ান)।
১৮৯৫ সালে জাপানের দখলে চলে যাওয়া এই দ্বীপে দীর্ঘ জাতিগত নিপীড়ন চলেছিল। ১৯৪৩ সালের কায়রো সম্মেলনে চিয়াং কাই-শেক, উইনস্টন চার্চিল ও ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট তাইওয়ানসহ যুদ্ধ-পরবর্তী ভূখণ্ড বিন্যাসের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন।
মানবিক বিপর্যয় ও নতুন সংঘাত
১৯৩৭ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত চলা জাপানি আগ্রাসনের যুদ্ধে চীনের জনগণ ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়ে। প্রায় ২০ লাখ চীনা সেনা ও ১ কোটি ৪০ লাখ সাধারণ মানুষ প্রাণ হারায়। যুদ্ধশেষে অর্থনীতি ও মানবিক অবস্থা এতটাই ভেঙে পড়ে যে কোনো স্বস্তি আসেনি। এরই মধ্যে কুওমিনতাং সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বন্ধুত্ব চুক্তি করে এবং ৫০ হাজার মার্কিন মেরিন সৈন্যকে জাপানি যুদ্ধবন্দিদের প্রত্যাবাসনে সহায়তার জন্য উত্তর চীনে অবতরণের অনুমতি দেয়। কিন্তু শান্তির এই প্রচেষ্টা বেশিদিন টেকেনি; ১৯৪৬ সালেই গৃহযুদ্ধ আবার জ্বলে ওঠে।
মাও সেতুংয়ের পাল্টা দাবি
জাপানের পরাজয়ের পর চিয়াং কাই-শেকের বিবৃতি ছিল ক্ষমাশীল—তিনি বলেছিলেন, চীন প্রতিশোধ নেবে না। কিন্তু কমিউনিস্ট নেতা মাও সেতুং এটিকে ‘দুর্বল’ প্রতিক্রিয়া হিসেবে আখ্যা দেন। মাও দাবি করেন, জাপানের বিরুদ্ধে প্রকৃত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল কমিউনিস্ট বাহিনীই, যারা দক্ষিণ চীনের ‘স্বাধীন অঞ্চলগুলো’ রক্ষা করেছিল। যদিও ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, কমিউনিস্টদের যুদ্ধ সীমিত ছিল মধ্য ও উত্তর-পূর্ব চীনের কিছু অঞ্চলে, আর জাপানি সেনারা ইতিমধ্যে ১৯৪৪ সালের শেষ নাগাদ দক্ষিণ উপকূল পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল।
গৃহযুদ্ধ ও তাইওয়ানের উত্থান
১৯৪৭ সালে চীনজুড়ে গৃহযুদ্ধ তীব্র আকার ধারণ করে। মার্কিন দূত জেনারেল জর্জ মার্শাল চিয়াং ও মাওয়ের মধ্যে জোট সরকার গঠনের চেষ্টা করলেও তা ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে বেইজিংয়ে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। কুওমিনতাং নেতারা তাইওয়ানে পলায়ন করে এবং উপকূলের নিকটবর্তী ছোট ছোট দ্বীপে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তোলে।
এক সময়ের বিদ্রূপাত্মক বাস্তবতায় দেখা যায়, ১৯৫০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানে কুওমিনতাং সরকারকে সমর্থন দিতে শুরু করে, আর অবসরপ্রাপ্ত জাপানি জেনারেলরা গোপনে তাইপেই সফর করে সামরিক ব্রিফিংয়ে অংশ নেন।
যুদ্ধ-পরবর্তী চীন-জাপান সম্পর্কের জটিলতা
পরবর্তী দশকগুলোতে চীন, তাইওয়ান ও জাপানের সম্পর্ক আরও জটিল হয়ে ওঠে। জীবনের শেষ দিকে মাও নিজেও জাপানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্গঠনে আগ্রহী হন। তাঁর উত্তরসূরিরাও এই নীতি অনুসরণ করেন, যদিও একই সঙ্গে যুদ্ধকালীন জাপানি নৃশংসতা স্মরণে স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘর স্থাপনে জোর দেন।
১৯৯০-এর দশক থেকে চীনে জাপানের আগ্রাসন ও ‘কমফোর্ট উইমেন’ বিষয়ক স্মৃতি আরও প্রবল হয়ে ওঠে, এমনকি দক্ষিণ কোরিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়ও এই আলোচনার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। এই সময়েই জাপান হয়ে ওঠে চীনের অন্যতম বৃহৎ বিনিয়োগকারী দেশ।
ইতিহাসের পুনর্লিখন ও আধুনিক ব্যাখ্যা
বর্তমান চীনে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ও চলচ্চিত্র শিল্প একত্রে যুদ্ধকালীন ইতিহাসকে এমনভাবে উপস্থাপন করছে যেন পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাপানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এই বয়ানটি ১৯৩১ সালে মানচুরিয়া দখল থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত সময়কে “চীনা জনগণের মহান প্রতিরোধযুদ্ধ” হিসেবে চিহ্নিত করে।
এতে কুওমিনতাং ও কমিউনিস্ট—দুই পক্ষকেই একত্রে জাতীয় প্রতিরোধের অংশ হিসেবে দেখানো হয়। বাস্তবে, এই ইতিহাসে কে বেশি লড়েছে বা কে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছে—তা নিয়ে বিতর্ক এখনো চলমান, বিশেষ করে তাইওয়ানের রাজনীতিতে। বর্তমানে ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি জাপানকে কূটনৈতিক মিত্র হিসেবে দেখে, যেখানে বেইজিং এখনো জাপানের যুদ্ধকালীন অপরাধকে ইতিহাসের ‘চিরন্তন অকল্যাণ’ হিসেবে উপস্থাপন করে যাচ্ছে।
#চীন, জাপান, দ্বিতীয়_বিশ্বযুদ্ধ, ইতিহাস, মাও_সেতুং, চিয়াং_কাই_শেক, তাইওয়ান, এশিয়া_রাজনীতি, যুদ্ধের_ইতিহাস, সারাক্ষণ_রিপোর্ট