পোল্যান্ড দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সবচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে — রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রথম সারিতে পরিণত হওয়ার জন্য। রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে দেশটি এখন ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটি হিসেবে গড়ে উঠছে।
প্রতিরক্ষা ব্যয়ে ইউরোপে শীর্ষে
২০২৫ সালে পোল্যান্ডের সামরিক ব্যয় জিডিপির ৪.৭ শতাংশে পৌঁছেছে — যা ন্যাটো জোটের মধ্যে সর্বোচ্চ। এই বিশাল ব্যয় বৃদ্ধির ফলে দেশটি এখন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের অন্যতম বৃহত্তম ক্রেতা। গত দুই বছরে প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলারের মার্কিন অস্ত্র কেনার চুক্তি করেছে ওয়ারশ।
পোল্যান্ডের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২৬ সালে এই ব্যয় আরও বাড়িয়ে ৪.৮ শতাংশে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ফলে ইউরোপের সবচেয়ে দ্রুতগতিতে আধুনিকায়ন হওয়া সেনাবাহিনীতে পরিণত হচ্ছে দেশটি।
রাশিয়ার ড্রোন অনুপ্রবেশ ও সংঘাতের আশঙ্কা
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রায় ২০টি রুশ ড্রোন পোল্যান্ডের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে। এসব ড্রোন অতিরিক্ত জ্বালানি ট্যাঙ্কসহ দূরপাল্লার অভিযানের জন্য প্রস্তুত ছিল। এই ঘটনার পর ন্যাটোর যুদ্ধবিমানগুলো প্রথমবারের মতো রুশ ড্রোনের মুখোমুখি হয়, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টাস্ক বলেন, “এই মুহূর্তে আমরা যুদ্ধের সবচেয়ে কাছাকাছি অবস্থানে আছি।”
অন্যদিকে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, “ইউরোপ প্রতিদিন আমাদের উসকানির জন্য দায়ী করছে, অথচ তারাই ভয় ছড়াচ্ছে।”
ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে রাশিয়া-ভীতি
পোল্যান্ডের রাশিয়া-ভীতি নতুন কিছু নয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী দেশটি রুশ দখলের শিকার হয়েছে। ১৮ ও ১৯ শতকে ইউরোপের বৃহৎ সাম্রাজ্যগুলো, বিশেষত রাশিয়া, পোল্যান্ডকে ভাগ করে মানচিত্র থেকে মুছে দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স প্রতিশ্রুত সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়; নাৎসিদের আক্রমণের পরপরই সোভিয়েত বাহিনীও দেশটি দখল করে নেয়, যা প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে মস্কোর নিয়ন্ত্রণে রাখে।
এই ইতিহাস আজও পোল্যান্ডের নীতিনির্ধারকদের মনে গভীরভাবে গেঁথে আছে। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ ও সাম্প্রতিক সামরিক উসকানিগুলো সেই পুরনো আশঙ্কাকে আরও জোরদার করছে।
“এটি আমাদের যুদ্ধ”— টাস্কের ঘোষণা
ওয়ারশ নিরাপত্তা সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী টাস্ক বলেন, “এটি আমাদের যুদ্ধ। আমরা পোল্যান্ডকে অস্ত্রে সজ্জিত করতে এবং সেনাবাহিনীকে ব্যাপকভাবে আধুনিক করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।”
তার সরকারের লক্ষ্য হলো, যেকোনো পরিস্থিতিতে দেশকে আত্মরক্ষার সক্ষমতায় পৌঁছে দেওয়া।
যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ও ন্যাটো জোটের সম্পর্ক
রক্ষাব্যয়ে নেতৃত্ব নেওয়ার ফলে পোল্যান্ড ন্যাটোর পূর্বাঞ্চলীয় মিত্রদের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে পোল্যান্ডকে বিশেষ সমর্থন জানিয়েছেন।
নতুন প্রেসিডেন্ট ক্যারোল নাভরকির সঙ্গে সাক্ষাতে ট্রাম্প বলেন, “আমরা পোল্যান্ডের পাশে আছি, এবং নিজেদের রক্ষায় তাদের সহায়তা করব।”
রাশিয়া এ অবস্থানকে হুমকি হিসেবে দেখছে। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী আন্দ্রেই বেলুসভ বলেছেন, মস্কোর সেনাবাহিনীকে ন্যাটোর সঙ্গে সম্ভাব্য সংঘাতের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তবে পুতিন পরে বলেন, “রাশিয়া ন্যাটোকে আক্রমণ করতে চায়—এই ধারণা সম্পূর্ণ অর্থহীন।”
তবুও ক্রেমলিন দাবি করছে, ন্যাটো যেন ১৯৯৯ সালের আগে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে যে অবস্থানে ছিল, সেখানে ফিরে যায়।
“সোভিয়েত ইউনিয়নের পুনর্জাগরণ রাশিয়ার কৌশল”
পোল্যান্ডের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভ্লাদিস্লাভ কসিনিয়াক-কামিশ বলেন, “রাশিয়ার লক্ষ্য হলো পুরনো সোভিয়েত প্রভাববলয় পুনরুদ্ধার করা। এই অবস্থায় পোল্যান্ড সরাসরি লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে।”
বর্তমানে পোল্যান্ডের সেনা সদস্য সংখ্যা ২ লাখ ১০ হাজারের বেশি, যা ন্যাটোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের পর তৃতীয়। ২০১৮ সালের সংস্কার কর্মসূচির পর নতুন ১৮তম মেকানাইজড ডিভিশন গঠন করা হয়েছে, যা সবসময় যুদ্ধপ্রস্তুত অবস্থায় থাকে। আরও দুটি ডিভিশন গঠনের কাজ চলছে।
আধুনিক যুদ্ধ প্রস্তুতি ও মহড়া
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রায় ৩০ হাজার সেনা, যার মধ্যে ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও নেদারল্যান্ডসের সৈন্যরাও, মাসব্যাপী সামরিক মহড়ায় অংশ নেয়। এতে পোলিশ সেনারা তাদের পুরনো ও নতুন অস্ত্রের সমন্বয়ে প্রশিক্ষণ নেয় — যার মধ্যে ছিল মার্কিন অ্যাব্রামস ট্যাংক, দক্ষিণ কোরিয়ার বহু রকেট লঞ্চার এবং মার্কিন HIMARS সিস্টেমের পোলিশ সংস্করণ, যা ইউক্রেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে সফলভাবে ব্যবহার করেছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
নতুন যুদ্ধ সরঞ্জাম দ্রুত সেনাবাহিনীতে যুক্ত হচ্ছে। পোল্যান্ডের সামরিক সক্ষমতা এখন ইউরোপের শীর্ষে পৌঁছাতে যাচ্ছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি, “যেকোনো পরিস্থিতিতে পোল্যান্ড এবার প্রস্তুত থাকবে—ইতিহাসের ভুল আর কখনো পুনরাবৃত্তি হবে না।”
#পোল্যান্ড, রাশিয়া, ইউক্রেন যুদ্ধ, ন্যাটো, সামরিক ব্যয়, ভ্লাদিমির পুতিন, ডোনাল্ড টাস্ক, প্রতিরক্ষা বিশ্লেষণ, ইউরোপীয় নিরাপত্তা, সারাক্ষণ রিপোর্ট