টিউডর সমাজে সামাজিক মর্যাদা ও আহারের সংস্কৃতি
ষোড়শ শতকের ইংল্যান্ড ছিল সামাজিকভাবে অত্যন্ত শ্রেণিভেদপূর্ণ। টিউডর যুগে ভোজসভা শুধু খাদ্যগ্রহণের নয়, বরং সামাজিক অবস্থান প্রদর্শনেরও জায়গা ছিল। সেই সময়ে অতিথিদের নিজেদের ছুরি ও চামচ সঙ্গে আনতে হতো, যা ছিল তাঁদের ধনসম্পদ ও মর্যাদার প্রতীক।
যে কাটলারি কেউ ব্যবহার করতেন—তা কী ধাতু দিয়ে তৈরি, কতটা অলঙ্কৃত, এমনকি সেটি বহনের ধরন পর্যন্ত তার সামাজিক অবস্থান বোঝাত। ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা রূপা বা সোনার প্রলেপ দেওয়া চামচ ব্যবহার করতেন, আর মধ্যবিত্তরা টিন বা পিউটার চামচে ভরসা রাখতেন। দরিদ্র শ্রেণির মানুষ সাধারণত কাঠ, হাড় বা শিং দিয়ে তৈরি সরল চামচ ব্যবহার করত।
ছুরি ও চামচের উপকরণ ও নকশা
ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে টিউডর যুগের ছুরিগুলো তৈরি হতো লোহার, যার ধার ছিল ইস্পাতের। শতাব্দীর শেষে সম্পূর্ণ ইস্পাতের ব্লেড ব্যবহৃত হতে শুরু করে। হাতল সাধারণত কাঠ, শিং, হাড় বা ল্যাটেন নামের তামা-জিঙ্ক সংকর ধাতু দিয়ে তৈরি হতো। এটি ধাতব পেরেক দিয়ে ব্লেডের অংশে জোড়া লাগানো হতো।
পুরুষেরা এই ছুরি কোমরে ঝোলানো চামড়ার খাপে রাখতেন, আর নারীরা পোশাকের কোমরে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখতেন। চামচ সাধারণত ‘গিপসিয়ার’ নামে পরিচিত চামড়ার থলেতে রাখা হতো, আবার কেউ কেউ টুপি বা পকেটেও রাখতেন।
ভোজসভায় শিষ্টাচার ও ব্যক্তিগত ব্যবহার
সেই সময় রাজা ও উচ্চপদস্থ অভিজাতদের বাদে কেউ অতিথিদের জন্য আলাদা ছুরি সরবরাহ করতেন না। ফলে সবাই নিজের কাটলারি সঙ্গে নিয়ে আসত। ভোজের সময় ছুরি ও চামচ নিজের সামনের রুটির পাশে সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখা ছিল সৌজন্যের নিদর্শন।
১৫০৮ সালের The Boke of Keruynge (The Book of Carving) নামের একটি আচরণবিধিতে বলা হয়েছিল, “তোমার ছুরি রাখো এবং রুটি একটির পাশে আরেকটি সাজাও, চামচ ও ন্যাপকিন সুন্দরভাবে ভাঁজ করে রুটির পাশে রাখো।”
প্রথার পরিবর্তন ও নতুন ধারার সূচনা
ষোড়শ শতকের শেষের দিকে ধীরে ধীরে ধনী পরিবারগুলো একত্রে ব্যবহারের উপযোগী ছুরি-চামচ সেট সংগ্রহ করতে শুরু করে। তখন থেকেই অতিথিদের নিজস্ব কাটলারি আনার রীতি বিলুপ্ত হতে থাকে।
তবে Pieter Bruegel the Younger-এর চিত্রকর্মে দেখা যায়, ইউরোপের নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ সপ্তদশ শতকের শুরু পর্যন্তও নিজেদের ছুরি-চামচ বহন করত।
অভিজাত পরিবারগুলো নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য উচ্চমানের ছুরিগুলো প্রাসাদের ভাণ্ডারে সংরক্ষণ করত। ভোজের সময় সেগুলোই বের করে আনা হতো।
কাঁটাচামচের আগমন ও আধুনিকতার ছোঁয়া
আমরা আজ যে কাঁটাচামচ চিনি, তা ইংল্যান্ডে জনপ্রিয় হয় সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে। তবে রানির যুগে (এলিজাবেথীয় আমলে) কিছু আধুনিক অভিজাত পরিবার ‘সুইটমিট ফর্ক’ নামে দুই দাঁতযুক্ত ছোট কাঁটাচামচ ব্যবহার শুরু করে, যা মূলত ইতালির নবপ্রবর্তিত সংস্কৃতি থেকে আসা ছিল। এগুলো ব্যবহার করা হতো সংরক্ষিত ফল বা ‘ওয়েট সাকেট’ পরিবেশনের সময়।
টিউডর যুগে ভোজসভা কেবল খাদ্যের আসর ছিল না, বরং সামাজিক প্রতীকের প্রদর্শনমঞ্চও ছিল। কার ছুরি কী ধাতুর, কার চামচে কী অলঙ্করণ—এসবই বলে দিত মানুষটি সমাজের কোন স্তরে দাঁড়িয়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রথা হারিয়ে গেলেও, টিউডর আমলের এই ভোজসংস্কৃতি ইউরোপীয় সামাজিক ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায় হয়ে রইল।