বিশ্বজুড়ে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার (সুপারবাগ) সংক্রমণ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) সতর্ক করেছে যে, প্রতি ছয়টি ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের একটিতে অ্যান্টিবায়োটিক আর কার্যকর থাকছে না। ফলে সাধারণ সংক্রমণও হয়ে উঠছে প্রাণঘাতী, এবং আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি ক্রমে হারাচ্ছে কার্যকারিতা।
অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের ভয়াবহ চিত্র
২০২৩ সালে বিশ্বের বিভিন্ন পরীক্ষাগারে শনাক্ত ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের ছয়টির একটিতে অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা হারিয়েছে — এই তথ্য প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)। সংস্থাটির অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (AMR) বিভাগের প্রধান ড. ইভান জে.এফ. হুটিন বলেন, “এই ফলাফল অত্যন্ত উদ্বেগজনক। প্রতিরোধ বাড়তে থাকলে আমাদের চিকিৎসার বিকল্পগুলো ফুরিয়ে যাবে, আর আমরা জীবনের ঝুঁকি বাড়াচ্ছি।”
মৃত্যুহারের পেছনে সুপারবাগের ছায়া
WHO-এর হিসাব অনুযায়ী, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স, অর্থাৎ ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়াগুলো প্রতি বছর সরাসরি এক মিলিয়নেরও বেশি মৃত্যুর কারণ এবং প্রায় পাঁচ মিলিয়ন মৃত্যুর পেছনে পরোক্ষ ভূমিকা রাখে। মানুষ, পশু ও খাদ্য উৎপাদনে নির্বিচারে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে এই প্রতিরোধ ক্ষমতা দ্রুত বাড়ছে। এর ফলে বহু জীবনরক্ষাকারী ওষুধ কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ছে।
WHO-এর নতুন প্রতিবেদন: উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে ২২ ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতিরোধ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছে, যেগুলো ব্যবহার করা হয় মূত্রনালি, পরিপাকতন্ত্র, রক্তপ্রবাহ এবং যৌন সংক্রমণ (যেমন গনোরিয়া) চিকিৎসায়।
ফলাফলে দেখা গেছে, ২০১৮ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত পাঁচ বছরে পর্যবেক্ষণাধীন অ্যান্টিবায়োটিকগুলোর ৪০ শতাংশেরও বেশি ক্ষেত্রে প্রতিরোধ বৃদ্ধি পেয়েছে। বছরে গড়ে ৫ থেকে ১৫ শতাংশ হারে এই বৃদ্ধি ঘটছে।
মূত্রনালি সংক্রমণে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যর্থতা
বিশ্বব্যাপী মূত্রনালি সংক্রমণে ব্যবহৃত সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিকগুলোর ক্ষেত্রে প্রতিরোধের হার ৩০ শতাংশেরও বেশি। WHO আটটি প্রধান ব্যাকটেরিয়া — যেমন ই. কোলাই (E. coli) ও কে. নিউমোনিয়ে (K. pneumoniae) — এর ওপর নজর দিয়েছে, যেগুলো রক্তে সংক্রমণ ঘটিয়ে সেপসিস, অঙ্গ বিকল এবং মৃত্যু ঘটাতে পারে।
প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ই. কোলাই সংক্রমণের ৪০ শতাংশ এবং কে. নিউমোনিয়ে সংক্রমণের ৫৫ শতাংশ ‘থার্ড জেনারেশন সেফালোস্পোরিন’ নামের অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি প্রতিরোধী হয়ে পড়েছে — যা ছিল এই সংক্রমণগুলোর প্রথম সারির চিকিৎসা।
“আধুনিক চিকিৎসা পেছনে পড়ছে”—WHO প্রধানের সতর্কতা
WHO মহাপরিচালক টেড্রস আধানম গেব্রেয়াসুস বলেন, “অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স আধুনিক চিকিৎসার অগ্রগতিকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে — এটি বিশ্বের পরিবারের স্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি।”
যদিও WHO স্বীকার করেছে যে, নজরদারিতে কিছু অগ্রগতি হয়েছে, তবু এখনো ৪৮ শতাংশ দেশ কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের তথ্যই জানায় না।
ড. হুটিন বলেন, “অনেক দেশ এখনো এই বিষয়ে কার্যকর নজরদারি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। ফলে আমরা অন্ধভাবে চলছি।”
কোথায় সবচেয়ে বেশি প্রতিরোধ
উপলব্ধ তথ্য অনুযায়ী, দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও কম নজরদারির দেশগুলোতেই প্রতিরোধের হার বেশি।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে প্রতি তিনটি সংক্রমণের একটিতে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। আফ্রিকায় এই হার পাঁচটির মধ্যে একটি।
WHO-এর ড. সিলভিয়া বার্তাগনোলিও বলেন, “যেসব দেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থা দুর্বল, সেখানে প্রতিরোধের হার বেশি হওয়াটা স্বাভাবিক, কারণ তারা কার্যকরভাবে রোগ শনাক্ত বা চিকিৎসা দিতে সক্ষম নয়।”
নজরদারির ঘাটতি ও ভবিষ্যতের আশঙ্কা
প্রতিরোধের পার্থক্যের আরেকটি কারণ হলো অনেক দেশ পর্যাপ্ত পরীক্ষা বা তথ্য সংগ্রহ করছে না।
WHO সতর্ক করেছে, নতুন পরীক্ষার পদ্ধতি ও ওষুধ উদ্ভাবনের ক্ষেত্রেও অগ্রগতি পর্যাপ্ত নয়, যা ভবিষ্যতে ভয়াবহ সংকট তৈরি করতে পারে।
ড. হুটিন বলেন, “অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের বৃদ্ধি, প্রতিরোধের উল্লম্ফন এবং নতুন ওষুধ উদ্ভাবনের ঘাটতি — এই তিনের মিলন অত্যন্ত বিপজ্জনক এক সংমিশ্রণ।”
ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার এই বিশ্বব্যাপী বিস্তার আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যান্টিবায়োটিকের দায়িত্বশীল ব্যবহার, নজরদারির সম্প্রসারণ এবং নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবন ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণের অন্য কোনো পথ নেই।
#বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থা #সুপারবাগ #অ্যান্টিবায়োটিকপ্রতিরোধ #বিশ্বসংকট #জনস্বাস্থ্য #স্বাস্থ্যঝুঁকি #WHO #সারাক্ষণরিপোর্ট