সুন্দরবনের খালপাড়, কাদা চর, শিকড়ের মাথায় একসময় চোখে পড়ত যে সব মাডস্কিপার—আজ সেগুলো অনেকটাই বিরল। ম্যানগ্রোভের এই ‘ইন্ডিকেটর স্পিসিস’ কমে যাওয়া মানে বন-বাস্তুতন্ত্র গুরুতর চাপে পড়ছে। একই সঙ্গে মাডস্কিপার আমাদের মনে করিয়ে দেয় কোটি কোটি বছরের সেই বিবর্তন-গল্প, যেখান থেকে জলজ প্রাণীরা ধীরে ধীরে ডাঙায় টিকে থাকার কৌশল আয়ত্ত করে শেষ পর্যন্ত ফুসফুসের বিকাশ ঘটিয়েছে।
সুন্দরবনে মাডস্কিপার কেন গুরুত্বপূর্ণ
মাডস্কিপার ম্যানগ্রোভের স্বাস্থ্যের ব্যারোমিটার। আগে যেখানে-সেখানে দেখা যেত—খালের ধারে, কাদায়, শ্বাসমূলের ফাঁকে—সেই ভিড় এখন আর নেই। ইন্ডিকেটর প্রজাতির কমে যাওয়া দেখায়, আবাসস্থল ও খাদ্যশৃঙ্খলে বিপর্যয় ঘটছে।
সকালের ছন্দ: প্রাণীদের সবচেয়ে ব্যস্ত সময়
ভোরে শিশির ভেজা শরীর গরম করতে রোদে বসা, ক্ষুধা মেটাতে খাবার খোঁজা—এ সময়েই অধিকাংশ পাখি ও বন্যপ্রাণী সবচেয়ে সক্রিয়। দিন গড়ালে চড়া রোদ এড়াতে তারা পাতার ছায়া বা ঝোপে সরে যায়; তাই দুপুরে খালপাড় প্রায় স্তব্ধ।
ফটোগ্রাফারের চোখে অলস দুপুর
সকালের নরম আলোয় ছবি সুন্দর আসে। আর দুপুরে আমরা নৌকা ছায়ায় বেঁধে চুপচাপ বসে থাকি—কখনো হঠাৎ কোনো প্রাণী বেরিয়ে আসে, না হয় কাদায় ছোট ছোট নানা রঙের ফিডলার কাঁকড়া বা জলের ধারে ব্যস্ত মাডস্কিপারদের দেখি। প্রতিটি ছবিই যেন একটি জানালা—যেখান দিয়ে অনেক পুরোনো এক বিবর্তন-গল্প চোখে ভেসে ওঠে।
মাডস্কিপার: পানির মাছ, তবু ডাঙায় টিকে থাকা
সাধারণ মাছের ফুসফুস নেই; তারা ফুলকা দিয়ে পানির অক্সিজেন নেয়, তাই ডাঙায় তুললে মারা যায়। কিন্তু মাডস্কিপারদের পূর্বসূরীরা ডাঙায় টিকতে দুই কৌশল আয়ত্ত করেছিল—
১) বড় মুখে পানি জমিয়ে রাখা: ডাঙায় থাকা অবস্থায় ফুলকা সেই জমে থাকা পানির অক্সিজেন ব্যবহার করে। একটু পরপর পানিতে নেমে পুরোনো পানি ফেলে নতুন অক্সিজেনসমৃদ্ধ পানি নিয়ে আবার উঠে আসে।
২) ভেজা চামড়ায় অক্সিজেন শোষণ: শরীর ভেজা থাকলে চামড়া দিয়েও সামান্য শ্বাস নেয়; তাই সময় পরপর গা ভিজিয়ে আসে।
৫০০ মিলিয়ন বছরের ধারাবাহিক চেষ্টা
এই প্রাথমিক উদ্ভাবনগুলোই স্থলজ প্রাণজগতে শ্বাসপ্রশ্বাসের ভিত্তি গড়েছে। ডাঙায় দীর্ঘক্ষণ থাকার সুবিধা ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে এক সময় ফুসফুসের বিকাশের দিকে পথ দেখিয়েছে।
লোব-ফিনড মাছ থেকে ফুসফুসের আদি রূপ
প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন বছর আগে লোব-ফিনড (বৈজ্ঞানিক নাম: সারকপ্টেরিজি) মাছেরা এই অভিযোজনে এগিয়ে যায়। তাদের উত্তরসূরী ‘লাংফিশে’ ৪২০ মিলিয়ন বছর আগে কার্যকর ফুসফুসের সূচনা ঘটে। জলজ মাছের শরীরে যে গ্যাস ব্লাডার বা ‘পটকা’ ভেসে থাকতে সাহায্য করে, সেটিই ধীরে ধীরে বহু-প্রকোষ্ঠে ভাগ হয়ে ফুসফুসে রূপ নেয়—যেখানে বিপুল তলভাগের মাধ্যমে বাতাস ও রক্তের সংস্পর্শ অনেক বেশি দক্ষ হয়।
খরায় টিকে থাকার কৌশল: লাংফিশের পাঠ
আফ্রিকার খরা-প্রবণ হ্রদে পানি শুকিয়ে গেলে লাংফিশ কাদায় গর্ত করে লেজ নিচে গেঁথে থাকে, মুখের দিকে মিউকাসের ঝিল্লি টেনে আর্দ্রতা ধরে। ঝিল্লির ছোট ছিদ্র দিয়ে মুখ দিয়ে ফুসফুসে বাতাস চলাচল করে। পানিতে থাকলে গিল, আর ডাঙায় বা শুষ্ক মৌসুমে ফুসফুস—দুই মাধ্যমেই তারা শ্বাস নেয়। আজও কিছু প্রজাতি একই কৌশলে বেঁচে আছে।
গল্পের সার: সমুদ্র থেকে স্থলে
গ্যাস ব্লাডারের বহু-প্রকোষ্ঠ রূপান্তর, নাসারন্ধ্রের বিকাশ, চামড়ার মাধ্যমে অক্সিজেন শোষণ—এই ছোট ছোট ধাপ মিলেই স্থলজ প্রাণীর ফুসফুসের জন্ম। উভচরদের আবির্ভাব সেই ধারাবাহিকতারই পরিণতি। মাডস্কিপারদের দেখলে তাই মনে হয়—৫০০ মিলিয়ন বছর আগে পূর্বসূরীদের কঠিন পরীক্ষানিরীক্ষা না হলে আজ হয়তো আমরা কেউই ডাঙায় হাঁটতাম না; থাকলেও বড় বড় ফুলকা নিয়ে সাগরেই ভেসে বেড়াতাম।
উপসংহার: ইন্ডিকেটর প্রজাতি বাঁচানো মানে বনকে বাঁচানো
মাডস্কিপার কমে যাওয়া শুধু একটি মাছের গল্প নয়—এটি পুরো ম্যানগ্রোভের বিপদের সংকেত। আবাসস্থল রক্ষা, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, জলপথের প্রাকৃতিক প্রবাহ বজায় রাখা—সব মিলিয়ে সুন্দরবনের প্রাণজ বৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনার এটাই সময়।
#ট্যাগ: #সুন্দরবন #মাডস্কিপার #ম্যানগ্রোভ #জীববৈচিত্র্য #বিবর্তন #বাংলাদেশ #প্রকৃতি_সংরক্ষণ