তেলঙ্গানা আন্দোলন থেকে রাজনীতির মূলধারায়
কে. কবিতা, প্রাক্তন তেলঙ্গানা মুখ্যমন্ত্রী ও ভারত রাষ্ট্র সমিতি (বিআরএস) প্রতিষ্ঠাতা কে. চন্দ্রশেখর রাও (কেসিআর)-এর কন্যা, দীর্ঘদিন ধরে তেলঙ্গানার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা অর্জনের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তবে দলের অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠী রাজনীতির বিরুদ্ধে মুখ খুলে সম্প্রতি তিনি বিআরএস থেকে বরখাস্ত হন। এখন তিনি স্বাধীন রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার পথে।
দল থেকে বহিষ্কার — ‘সত্য বলার জন্য মূল্য দিতে হয়েছে’
কবিতা বলেন, “আমি জনজীবনে এসেছিলাম তেলঙ্গানার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়তে। প্রতিটি গ্রামে ঘুরে নারীদের আন্দোলনে যুক্ত করেছিলাম। বাথুকাম্মা উৎসবকে নারীদের আত্মমর্যাদার প্রতীকে পরিণত করি। কিন্তু আজ যাঁরা আমার বাবার চারপাশে কোটারী তৈরি করেছেন, তাঁরাই ষড়যন্ত্র করে আমাকে দল থেকে সরিয়ে দিয়েছেন।”
তিনি জানান, “আমি দলের ভিতরের অসঙ্গতিগুলো নিয়ে বহুবার আলোচনা চেয়েছিলাম, কিন্তু শুনতে কেউ চায়নি। আমার পাঠানো একটি গোপন চিঠি ইচ্ছাকৃতভাবে ফাঁস করা হয়, যা শেষ পর্যন্ত আমাকে প্রকাশ্যে কথা বলতে বাধ্য করেছে। দল যদি আমাকে বরখাস্ত করতে পারে, তবে আমি পদে থাকব না — এই কারণেই আমি এমএলসি ও দলীয় সদস্যপদ ছেড়ে দিয়েছি।”
‘আমার বাবা রাজ্যের জন্য কাজ করেন, কোটারী নয়’
বাবা কেসিআর কি এই বহিষ্কারের পেছনে ছিলেন? উত্তরে কবিতা বলেন, “আমার বাবা এসবের ঊর্ধ্বে। তিনি সর্বদা রাজ্যের স্বার্থে কাজ করেছেন। কিন্তু মোমবাতির নিচেও অন্ধকার থাকে — এই অন্ধকারেই ওই ‘অশুভ শক্তি’রা বাস করে, যাঁরা আমাকে সরিয়ে দিতে পেরেছেন।”
‘বিজেপির প্রতিশোধমূলক রাজনীতির শিকার হয়েছি’
দিল্লির কথিত মদনীতি কেলেঙ্কারি মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “তিন বছর ধরে আমাকে বারবার ইডি, সিবিআই ও মিডিয়ার হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। আমার দল তখন পাশে দাঁড়ায়নি। শুধু জেলে থাকাকালে বাবা ও ভাই একবার দেখা করেছিলেন। কিন্তু বেরোনোর পর কেউ পাশে ছিল না।”
‘রাজনীতিতে পুরুষতন্ত্র এখনো প্রকট’
রাজনৈতিক পরিবারে নারীরা বঞ্চিত হয় — এ বিষয়ে কবিতা বলেন, “একদম ঠিক। প্রতিটি পরিবারেই যদি ত্যাগের প্রয়োজন হয়, তা নারীই করে। ছেলেকে শিক্ষিত করা হয়, মেয়েকে ঘরে বসানো হয়। রাজনীতিতেও তাই — গাঁধী পরিবার থেকে পওয়ার পরিবার, সর্বত্রই ছেলেরা অগ্রাধিকার পায়।”
‘তেলঙ্গানা জাগরুতি এখন সামাজিক আন্দোলন’
কবিতা বলেন, “তেলঙ্গানা জাগরুতি আসলে একটি নাগরিক সংগঠন, যা রাজ্যের স্বার্থে তৈরি হয়েছিল। আমরা নারী সংরক্ষণ বিলের জন্য সারাদেশে চাপ সৃষ্টি করেছি। ১৮টি দলকে একসঙ্গে এনে সংসদে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এবার আমরা ওবিসি সংরক্ষণের দাবিতে লড়ছি — কারণ তেলঙ্গানার জনসংখ্যার ৫২% ওবিসি হলেও তাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব খুবই কম।”
তিনি জানান, “কংগ্রেস ৪২% সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিলেও বিলটি এখনো রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে, আর বিজেপি তা আটকে রেখেছে।”
জাতি জরিপ নিয়ে মত — ‘উপশ্রেণিভিত্তিক সঠিক তথ্য জরুরি’
কবিতা বলেন, “জাতি জরিপে শুধু প্রধান জাতি নয়, উপশ্রেণি শনাক্ত করাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সংরক্ষণের হার—চাকরি, শিক্ষা ও রাজনীতিতে—সবই তাতে নির্ভর করে। তেলঙ্গানায় আগের জরিপে ওবিসি ৫২% ছিল, এখন ৪৬% বলা হচ্ছে, যা প্রশ্ন তুলছে। তাই এই জরিপে স্বচ্ছতা ও নির্ভুলতা অপরিহার্য।”
দক্ষিণ ভারতের প্রতিনিধিত্ব কমছে — ‘জিডিপি অবদানও বিবেচনায় আসুক’
দক্ষিণের রাজ্যগুলোর রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব কমে যাওয়ার আশঙ্কা নিয়ে কবিতা বলেন, “দিল্লিতে উত্তর ভারতের রাজনীতিকরা প্রভাবশালী, দক্ষিণের নয়। অথচ দক্ষিণের রাজ্যগুলো দেশের জিডিপিতে সবচেয়ে বড় অবদান রাখে। তাই প্রতিনিধিত্ব শুধু জনসংখ্যার ভিত্তিতে নয়, অর্থনৈতিক অবদানের ভিত্তিতেও নির্ধারিত হওয়া উচিত।”
তিনি আরও বলেন, “যে রাজ্য পরিবার পরিকল্পনা বা অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভালো করছে, তাদের পুরস্কৃত করা উচিত। না হলে দক্ষিণে অসন্তোষ বাড়বে।”
বিজেপির সঙ্গে সম্ভাব্য জোট প্রসঙ্গে
তিনি জানান, “জেলে থাকাকালে আমাকে বলা হয়েছিল, বিআরএস যদি বিজেপির সঙ্গে মিশে যায়, তবে জামিন মিলবে। আমি তৎক্ষণাৎ অস্বীকার করি। রাষ্ট্রগঠনের আন্দোলন থেকে জন্ম নেওয়া দলকে কারও স্বাধীনতার বিনিময়ে বিক্রি করা যায় না।”
রাহুল গান্ধীর অভিযোগ নিয়ে মন্তব্য
রাহুল গান্ধীর ‘ভোট চুরি’ অভিযোগ প্রসঙ্গে কবিতা বলেন, “যদি তিনি নির্দিষ্ট উদাহরণ দেন, নির্বাচন কমিশনের উচিত তা পরিষ্কার করা। তেলঙ্গানার গ্রাম পর্যন্ত মানুষ বলেছেন, ‘এটা সম্ভব, নিশ্চয়ই বিজেপি করেছে।’ রাহুলজি প্রশ্ন তুলেই ছুটিতে যান — এবার আশা করি তিনি লড়াই চালিয়ে যাবেন। জনগণকে আশ্বস্ত করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব।”
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা — ‘সমাজিক তেলঙ্গানা’র পথে
শেষে কবিতা বলেন, “আমি এখন ‘সমাজিক তেলঙ্গানা আন্দোলন’-এর নেতৃত্ব দিচ্ছি, যেখানে সমাজের সব শ্রেণির সমান অংশগ্রহণ থাকবে। নতুন পথ খুঁজছি, তবে সামাজিক ন্যায়বিচার ও সংরক্ষণের ন্যায্য বণ্টনের জন্য আমার লড়াই থামবে না।”
তেলঙ্গানা_রাজনীতি, কে_কবিতা, কেসিআর, বিআরএস, নারী_সংরক্ষণ, ওবিসি_কোটা, দক্ষিণ_ভারত, জাতি_জরিপ, রাজনৈতিক_নারীবাদ, রাহুল_গান্ধী, বিজেপি, তেলঙ্গানা_জাগরুতি, সারাক্ষণ_রিপোর্ট