৭৩৮ দিনের রক্তপাত ও ধ্বংসের পর অবশেষে মধ্যপ্রাচ্যে নেমেছে শান্তির সুবাতাস। হামাস ও ইসরায়েল বন্দি বিনিময়ের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হলেও, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় অর্জিত এই শান্তি এখন টিকে থাকার বড় পরীক্ষার মুখে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে তাঁর মতভেদে শান্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন অনিশ্চয়তা।
দীর্ঘ যুদ্ধের অবসান
৭৩৮ দিন রক্তপাত, ধ্বংস আর অসহনীয় কষ্টের পর অবশেষে মধ্যপ্রাচ্যে নেমেছে শান্তি।
১৩ অক্টোবর ইসরায়েলজুড়ে আনন্দে ফেটে পড়েছে মানুষ—হামাসের হাতে বন্দি সব জীবিত জিম্মিকে মুক্ত করা হয়েছে। অপরদিকে, ইসরায়েলও মুক্তি দিয়েছে প্রায় ২,০০০ ফিলিস্তিনি বন্দিকে, যাদের অনেকেই দশকের পর দশক কারাগারে ছিলেন।
অস্ত্র এখন নীরব। মধ্যপ্রাচ্য যেন দীর্ঘ এক দুঃস্বপ্ন শেষে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে। এই মুহূর্তের স্থপতি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয় সফরে অঞ্চলটিতে উপস্থিত হন। ইসরায়েল সফর শেষে তিনি যান মিশরের লোহিত সাগরের এক অবকাশ কেন্দ্রে, যেখানে ইউরোপীয়, আরব ও মুসলিম নেতাদের সমাবেশে তাঁকে অভ্যর্থনা জানানো হয়।
ইসরায়েলে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা ও অভিনন্দন
ট্রাম্প সব সময় সাধারণ ইসরায়েলিদের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন, কিন্তু এবার তাঁর মর্যাদা আরও বেড়েছে—কারণ তিনিই সেই চুক্তি করেছেন যা সব জিম্মির মুক্তি নিশ্চিত করেছে।
ইসরায়েল পার্লামেন্টে (কেনেসেট) ট্রাম্পকে অভ্যর্থনা জানিয়ে স্পিকার আমির ওহানা বলেন, “বিশ্বে আরও অনেক ট্রাম্পের প্রয়োজন।” তিনি এমনকি ২০২৬ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ট্রাম্পের প্রস্তাবও দেন।
এক ঘণ্টার নির্ধারিত ভাষণ দ্বিগুণ সময় ধরে চলে; ট্রাম্পের প্রতি দাঁড়িয়ে অভিবাদনের জোয়ার ওঠে। কিন্তু সেই উল্লাসের মাঝেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে—ট্রাম্প ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মধ্যে শান্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গিতে ফারাক গভীর।
নেতানিয়াহুর ভিন্ন হিসাব
নেতানিয়াহু ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানালেও নিজের বক্তব্যে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র “ইসরায়েলের জুডিয়া ও সামারিয়ার (দখলকৃত পশ্চিম তীর) ওপর অধিকার” স্বীকার করেছে—যা আসলে সত্য নয়।
তিনি দাবি করেন, গাজায় যুদ্ধবিরতির সুযোগগুলো উপেক্ষা করা ছিল সঠিক কৌশল এবং যুক্তরাষ্ট্রও নাকি সেই অবস্থানের সঙ্গে একমত ছিল। বাস্তবে ট্রাম্প প্রশাসন কখনোই এমন সমর্থন দেয়নি।
নেতানিয়াহু গাজার পুনর্গঠন বা ফিলিস্তিনিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি, যেন এই প্রশ্নগুলো অস্তিত্বহীন।
ট্রাম্পের বার্তা: শান্তি কেবল ইসরায়েলের জন্য নয়
ট্রাম্প তাঁর বক্তব্যে ইসরায়েলকে স্মরণ করিয়ে দেন—এই অস্ত্রবিরতি স্থায়ী শান্তির পথে কেবল প্রথম ধাপ।
তিনি বলেন, “শান্তি শুধু আপনাদের জন্য নয়; ফিলিস্তিনিদেরও এই শান্তির সুফল পেতে হবে।”
তিনি ইসরায়েলকে আহ্বান জানান “দুর্গ নির্মাণ বন্ধ করতে” ও “ঘৃণার দেয়াল ভেঙে ফেলতে”।
ট্রাম্প সতর্ক করেন, “আপনারা জিতেছেন, এখন সময় এসেছে সেই জয়ের ফল ভোগ করার—সবাই মিলে।”
তিনি উল্লেখ করেন, প্রযুক্তি ও অর্থনীতিতে অগ্রগতি সত্ত্বেও ইসরায়েল এখনও “বিশ্ব মানচিত্রে ছোট্ট একটি বিন্দু”—বিশ্বের বিরোধিতা নিয়ে অনন্তকাল টিকে থাকা সম্ভব নয়।
নেতানিয়াহুর অনীহা ও ফিলিস্তিনি প্রশ্ন
মিশরে অনুষ্ঠিত শান্তি-চুক্তির স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ট্রাম্প নেতানিয়াহু ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে আমন্ত্রণ জানান।
আব্বাস আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেও নেতানিয়াহু অজুহাত দেন—একটি ধর্মীয় উৎসবের কারণে তিনি ইসরায়েলে থাকবেন। আসলে তিনি আলোচনায় যোগ দিতে চাননি, কারণ এতে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের বিষয়টি সামনে আসত।
তিনি এমনকি দুই শীর্ষ ফিলিস্তিনি বন্দি—মারওয়ান বারগোতি ও আহমদ সাদাত—কে মুক্তির তালিকা থেকেও বাদ দেন। বারগোতি, যিনি পাঁচটি যাবজ্জীবন দণ্ডে কারাবন্দি, ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা এবং সম্ভাব্য উত্তরসূরি; এ কারণেই নেতানিয়াহু তাঁকে কারাগারে রাখতে চান।
গাজার ভবিষ্যৎ ও নতুন অনিশ্চয়তা
সব জিম্মি ও বন্দি বিনিময়ের পর এখন শুরু হচ্ছে গাজায় হামাস নিরস্ত্রীকরণের কঠিন অধ্যায়।
হামাস এখনও অধিকাংশ অস্ত্র জমা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। গাজার রাস্তায় তাদের সশস্ত্র টহল অন্য মিলিশিয়া গোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত, যাদের কিছু অস্ত্র সরবরাহ করেছিল ইসরায়েল নিজেই।
হামাস “ইসরায়েলি গুপ্তচর” সন্দেহে বহুজনকে মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছে, আবারও তাদের কঠোর নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনছে।
আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী দ্রুত গাজায় মোতায়েন না করা গেলে অঞ্চলটি নতুন করে সহিংসতায় ডুবে যেতে পারে—যা নেতানিয়াহুর উদ্দেশ্যকেই বাস্তবায়িত করবে: স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে ঠেকানো।
শান্তির পর লড়াইয়ের সূচনা
ট্রাম্পের এই মধ্যপ্রাচ্য সফর এক অর্থে বিজয়ের মিছিল। কিন্তু তাঁর স্বপ্নের দ্বিতীয় ধাপ—“গাজা আলোচনার দ্বিতীয় পর্ব”—সম্ভবত আরও কঠিন হতে চলেছে।
শান্তি স্থাপিত হলেও সেটিকে টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ এখনই শুরু হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্য_শান্তি, ট্রাম্প_নেতানিয়াহু, গাজা_সংঘাত, ফিলিস্তিন, ইসরায়েল, হামাস, যুক্তরাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক_রাজনীতি, শান্তি_চুক্তি, সারাক্ষণ_রিপোর্ট