আফ্রিকার দ্বীপরাষ্ট্র মাদাগাস্কার আবারও রাজনৈতিক অস্থিরতায় জর্জরিত। জেনারেশন জেড তরুণদের নেতৃত্বে সৃষ্ট অভূতপূর্ব বিক্ষোভ ও সেনা বিদ্রোহের মুখে প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোয়েলিনা দেশ ছেড়েছেন বলে নিশ্চিত হয়েছে। দেশজুড়ে পানির সংকট থেকে শুরু হয়ে দুর্নীতি-বিরোধী এই আন্দোলন এখন পূর্ণাঙ্গ সরকার পতনের রূপ নিয়েছে।
প্রেসিডেন্টের দেশত্যাগে রাজনৈতিক অস্থিরতা
মাদাগাস্কারের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোয়েলিনা দেশ ছেড়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন বিরোধী দলের নেতা, এক সেনা সূত্র এবং এক কূটনৈতিক কর্মকর্তা। বৈশ্বিকভাবে জেনারেশন জেড বা তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনের ঢেউয়ে মাত্র এক মাসের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো কোনো সরকার পতনের মুখে পড়ল আফ্রিকার এই দ্বীপরাষ্ট্র।
বিরোধী দলের সংসদীয় নেতা সিটেনি র্যান্ড্রিয়ানাসোলোনিয়াইকা জানান, সেনাবাহিনীর কয়েকটি ইউনিট বিদ্রোহ করে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার পর রোববার রাজোয়েলিনা দেশ ত্যাগ করেন।
প্রেসিডেন্টের বার্তা: ‘আমি দেশকে ধ্বংস হতে দেব না’
সোমবার রাতে ফেসবুক লাইভে দেওয়া এক ভাষণে রাজোয়েলিনা বলেন, নিজের প্রাণ রক্ষার জন্য তিনি নিরাপদ স্থানে যেতে বাধ্য হয়েছেন। যদিও অবস্থান প্রকাশ করেননি, তিনি জানান, “আমি মাদাগাস্কারকে ধ্বংস হতে দেব না।”
এক কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, তিনি এখনো পদত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
ফরাসি সামরিক বিমানে দেশত্যাগ
এক সামরিক সূত্রের বরাতে জানা গেছে, রাজোয়েলিনা ফরাসি সেনাবাহিনীর বিমানে করে দেশ ছাড়েন। রোববার সান্ত-মারি বিমানবন্দরে একটি ফরাসি সামরিক “কাসা” বিমান অবতরণ করে, এরপর একটি হেলিকপ্টার এসে রাজোয়েলিনাকে সেখানে তুলে নেয়।
ফরাসি রেডিও আরএফআই জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সঙ্গে রাজোয়েলিনার এক সমঝোতা হয়। তবে ম্যাক্রোঁ বলেন, তিনি নিশ্চিত নন ফ্রান্স তার পালাতে সহায়তা করেছে কি না। তিনি আরও বলেন, মাদাগাস্কারে সাংবিধানিক শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে এবং তরুণদের ক্ষোভ সেনাবাহিনী যেন রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার না করে।
পানি-বিদ্যুৎ সংকট থেকে শুরু হওয়া জনরোষ
২৫ সেপ্টেম্বর থেকে রাজধানী আনতানানারিভো-সহ দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। প্রথমে পানি ও বিদ্যুৎ ঘাটতির প্রতিবাদে রাস্তায় নামলেও আন্দোলন দ্রুত দুর্নীতি, শাসনব্যর্থতা ও মৌলিক সেবার সংকটবিরোধী জনরোষে রূপ নেয়।
এই ক্ষোভ প্রতিধ্বনিত হয় নেপাল ও মরক্কোর মতো দেশেও, যেখানে সম্প্রতি তরুণদের নেতৃত্বে সরকারবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে।
সেনা ও জেন্ডারমেরি বিদ্রোহে সরকারের নিয়ন্ত্রণ হারানো
রাজোয়েলিনার রাজনৈতিক ভরসা ছিল সেনাবাহিনীর বিশেষ ইউনিট ক্যাপস্যাট (CAPSAT), যারা ২০০৯ সালে তাকে ক্ষমতায় আনতে ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু এবার তারাই বিদ্রোহ করে বিক্ষোভকারীদের পাশে দাঁড়ায় এবং ঘোষণা দেয়, তারা জনগণের ওপর গুলি চালাবে না।
তারা রাজধানীর কেন্দ্রীয় স্কয়ারে হাজারো বিক্ষোভকারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং নিজস্বভাবে নতুন সেনাপ্রধান নিয়োগ দেয়।
এরপর সোমবার বিক্ষোভে সমর্থন জানিয়ে আধাসামরিক বাহিনী জেন্ডারমেরির একাংশও বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তারা আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন প্রধান নিয়োগ দেয়, যেখানে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।
সেনেটের নেতৃত্বেও পরিবর্তন
বিক্ষোভে জনগণের ক্ষোভের কেন্দ্রে থাকা সেনেটের সভাপতিকে অপসারণ করা হয়। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন জ্যাঁ আন্দ্রে ন্দ্রেমানজারি। সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্টের পদ শূন্য হলে সেনেটের প্রধান অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন যতদিন না নতুন নির্বাচন হয়।
তরুণদের বিক্ষোভ ও জীবনসংগ্রাম
সোমবার রাজধানীর কেন্দ্রে হাজারো মানুষ “প্রেসিডেন্ট এখনই পদত্যাগ করো” স্লোগানে মিছিল করে।
২২ বছর বয়সী হোটেলকর্মী আন্দ্রিয়ানারিভনি জানান, তাঁর মাসিক ৩ লাখ আরিয়ারি (৬৭ ডলার) আয় দিয়ে পরিবারের খাবারও জোটে না।
তিনি বলেন, “১৬ বছর ধরে এই সরকার শুধু নিজেদের ধনী করেছে, জনগণ রয়ে গেছে গরিব। আর সবচেয়ে বেশি ভুগছে তরুণ প্রজন্ম—জেন জেড।”
দারিদ্র্য ও হতাহতের চিত্র
জাতিসংঘ জানিয়েছে, ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ২২ জন বিক্ষোভকারী ও নিরাপত্তা সদস্য নিহত হয়েছেন।
মাদাগাস্কারের জনসংখ্যা প্রায় ৩ কোটি, যার তিন-চতুর্থাংশ দারিদ্র্যের নিচে বসবাস করে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশের মাথাপিছু আয় ৪৫% হ্রাস পেয়েছে।
দেশত্যাগের আগে বন্দিদের ক্ষমা
দেশ ছাড়ার আগে রাজোয়েলিনা রোববার কয়েকজন বন্দিকে ক্ষমা করে দেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ২০২১ সালের অভ্যুত্থানচেষ্টার অভিযোগে দণ্ডপ্রাপ্ত দুই ফরাসি নাগরিক—পল মাইয়ো রাফানোহেরানা ও ফ্রাঁসোয়া মার্ক ফিলিপ। প্রেসিডেন্সির একটি অভ্যন্তরীণ নথি ও সূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।
#মাদাগাস্কার #রাজোয়েলিনা #জেনজেড_আন্দোলন #আফ্রিকা #রাজনীতি #বিক্ষোভ #ফ্রান্স #সেনা_বিদ্রোহ #সারাক্ষণরিপোর্ট