কৃত্রিম মুখের যুগে বাস্তব পরিচয়ের সংকট
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) দ্রুত বিকাশের ফলে এখন যেকোনো ব্যক্তির মুখমণ্ডল, কণ্ঠস্বর কিংবা ভঙ্গিমা ব্যবহার করে তৈরি করা সম্ভব একদম বাস্তবসম্মত ভিডিও বা ছবি। নতুন প্রজন্মের এআই টুল—যেমন ওপেনএআই-এর ‘সোরা’, গুগলের ‘ন্যানো বানানা’ ও অ্যাপলের ‘ইমেজ প্লেগ্রাউন্ড’—কেবল কয়েক মিনিটেই কোনো বাস্তব ভিডিও বা ছবির ভিত্তিতে একেবারে নকল কপি তৈরি করতে পারে।
এই প্রযুক্তি যেমন বিনোদন ও সৃজনশীল কাজের সুযোগ খুলে দিচ্ছে, তেমনি ভয়াবহভাবে প্রশ্ন তুলছে গোপনীয়তা, নিরাপত্তা ও নৈতিকতার সীমা নিয়ে।
যখন ব্যক্তিগত ছবি হয়ে ওঠে এআই-এর উপাদান
একজন লেখক জানান, তাঁর আত্মীয় মেটা এআই-এ পরিবারের ছবি আপলোড করেছিলেন—যার ফলে তাঁর শিশুপুত্রের মুখও এআই ডাটাবেজে চলে যায়। মেটার নীতিমালায় উল্লেখ আছে, এমন ছবি ‘এআই প্রযুক্তি উন্নয়নে’ ব্যবহৃত হতে পারে। ফলে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন—নিজের কিংবা সন্তানের মুখ কোথায় ব্যবহৃত হচ্ছে, তা আর তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেই।
একই অভিজ্ঞতা গুগল ‘জেমিনি’ অ্যাপের ক্ষেত্রেও—লেখক ও তাঁর বন্ধুর শৈশবের ছবি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছিল জন্মদিনের আমন্ত্রণপত্রে তাঁদের শৈশবের “নকল” ছবি। ছবিগুলো এত বাস্তব মনে হচ্ছিল যে নিজের মা-ও হয়তো বুঝতে পারতেন না কোনটি আসল।
‘সোরা’—ভার্চুয়াল ডপেলগ্যাঙ্গারের নতুন দুনিয়া
ওপেনএআই-এর ভিডিও অ্যাপ ‘সোরা’ এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। এটি ব্যবহারকারীর কয়েক সেকেন্ডের ভিডিও ফুটেজ নিয়ে তৈরি করতে পারে এক ভার্চুয়াল রূপ, যাকে বলা হয় “ক্যামিও”। এই ডিজিটাল রূপ ব্যবহার করে তৈরি করা যায় অসংখ্য কল্পিত ভিডিও—যেমন নিজেকে সিনেমার নায়ক হিসেবে দেখা বা মজার কোনো দৃশ্যে অভিনয় করা।
লেখক নিজের মুখ আপলোড করে দেখেন, কেবল মাথা নেড়ে কিছু সংখ্যা উচ্চারণ করার পরই কয়েক মিনিটের মধ্যে তাঁর ডিজিটাল ক্লোন স্ক্রিনে জীবন্ত হয়ে ওঠে—কখনও ইউএসবি কেবলের পাহাড় থেকে পালাচ্ছে, আবার কখনও অস্কার জিতছে।
যদিও এই অ্যাপ কিছু সুরক্ষা ব্যবস্থা রাখে—যেমন অন্য কেউ আপনার ক্যামিও ভিডিও ডাউনলোড বা অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করতে পারে না—তবুও এই ধারণা যে নিজের মুখ এখন ওপেনএআই-এর সার্ভারে সংরক্ষিত, লেখককে অস্বস্তিতে ফেলে।
বিখ্যাতদের নকল রূপ—মৃতদেরও ফিরিয়ে আনছে এআই
‘সোরা’-তে টেইলর সুইফটসহ জীবিত সেলিব্রিটিদের ভিডিও ব্লক করা হলেও, দেখা গেছে মৃত ব্যক্তিদের ভার্চুয়াল পুনর্জীবন। টুপাক শাকুর, আইনস্টাইন, আব্রাহাম লিংকন, জন এফ. কেনেডি এমনকি মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের নকল রূপও দেখা গেছে।
এক ভিডিওতে কিং বলেন—“আমার একটি স্বপ্ন আছে, একদিন সোরা তার কনটেন্ট ভায়োলেশন নীতি পরিবর্তন করবে।”
ওপেনএআই জানিয়েছে, তারা ব্যবহারকারীর তথ্যের গোপনতা রক্ষায় পদক্ষেপ নিয়েছে, এবং ইচ্ছা করলে ব্যবহারকারীরা তাদের কনটেন্ট এআই প্রশিক্ষণে ব্যবহারের অনুমতি বন্ধ করতে পারেন।
মিথ্যা মুখে প্রতারণা: বাস্তব জীবনে ভয়ঙ্কর পরিণতি
নাশভিলের টেলিভিশন আবহাওয়াবিদ ব্রি স্মিথ একদিন জানতে পারেন, কেউ তাঁর নামে ইন্টারনেটে ভুয়া প্রোফাইল তৈরি করেছে। সেখানে তাঁর মুখ ব্যবহার করে বানানো হয়েছে অর্ধনগ্ন ছবি ও ভিডিও, যা পাঠানো হচ্ছিল ‘সিগন্যাল’ অ্যাপে।
স্ক্যামাররা দাবি করছিল, ভিডিওর নারীটি সত্যিই তিনিই—যদিও সেগুলো ছিল সম্পূর্ণ এআই-নির্মিত ডিপফেক। তাদের লক্ষ্য ছিল মানুষকে প্রতারণা করে টাকা আদায় করা।
এক ভুয়া অ্যাকাউন্টে এমনকি ২০০ ডলারে ‘ফ্যান এক্সেস’ বিক্রির প্রস্তাব দেওয়া হয়। এতে স্মিথ ভীষণভাবে মানসিক আঘাত পান।
পরে তিনি টেনেসি অঙ্গরাজ্যে একটি আইন পাস করাতে সহায়তা করেন—যাতে অনুমতি ছাড়া এ ধরনের ডিপফেক ছবি বা ভিডিও প্রকাশ করা অপরাধ বলে গণ্য হয়।
ডিপফেক সনাক্তে নতুন সেবা
‘ভারমিলিও’ নামের একটি সংস্থা ইন্টারনেটে এআই-নির্মিত প্রতারণামূলক ছবি ও ভিডিও শনাক্তে কাজ করছে। তাদের সিইও ড্যান নিলি বলেন, প্রতিষ্ঠানটি সোরা’র মতো প্রকাশ্য এআই মডেলের আউটপুট পর্যবেক্ষণ করে এবং ব্যবহারকারীদের অনুমতি ছাড়া তৈরি করা নকল কনটেন্ট সরিয়ে ফেলার অনুরোধ গ্রহণ করে।
সেবাটি বিনামূল্যে ঝুঁকি মূল্যায়নের সুযোগ দেয়, তবে মাসে ১০ থেকে ৯৯ ডলার পর্যন্ত ফি নিয়ে উন্নত মনিটরিং সেবা প্রদান করে।
অন্য একটি সংস্থা ‘লোটি’ জনসাধারণের ব্যক্তিত্বদের জন্য আরও উচ্চমূল্যের সেবা চালু করেছে—যেখানে প্রতি মাসে খরচ হতে পারে ২,৫০০ ডলার পর্যন্ত।
কিশোরদের জন্য বিপজ্জনক বাস্তবতা
২০২৪ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ১৫ শতাংশ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থী জানে—তাদের কোনো সহপাঠীকে জড়িয়ে অনুমতি ছাড়া তৈরি করা হয়েছে অন্তরঙ্গ ডিপফেক ভিডিও।
এটি বিশেষভাবে কিশোর-কিশোরীদের মানসিক নিরাপত্তায় নতুন হুমকি তৈরি করেছে।
গোপনীয়তার নতুন লড়াই
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এআই প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন আরও শক্তিশালী সুরক্ষা ব্যবস্থা।
ড্যান নিলির মতে, “মানুষ যদি প্রযুক্তির প্রতি আস্থা পায় যে তাদের পরিচয় নিরাপদ, তবে তারাই এই প্রযুক্তির উন্নত ব্যবহারকে উৎসাহিত করবে।”
কিন্তু ততদিন পর্যন্ত আমাদের মুখ, কণ্ঠ ও পরিচয়—সবই হয়ে উঠেছে মুক্তপণ্য। এআই যুগে কেউই আর নিজের মুখের একচ্ছত্র মালিক নয়।