স্থূলতা নিয়ে প্রচলিত ধারণার চ্যালেঞ্জ
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, স্থূলতার মূল কারণ হতে পারে আলট্রা-প্রসেসড ও হাইপারপ্যালেটেবল খাবার—যা শরীরের পরিপূর্ণতার সংকেতকে বিঘ্নিত করে এবং মানুষকে অতিরিক্ত খাবার খেতে বাধ্য করে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও মানবসেবা বিভাগ (HHS) বলছে, খাবার প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো সচেতনভাবে এমন খাবার তৈরি করছে যা মানুষকে আসক্ত করে তোলে—যেমনভাবে কোকেন বা নিকোটিন করে।
অন্যদিকে, কেউ কেউ মনে করেন স্থূলতা মানুষের ইচ্ছাশক্তির অভাবের ফল। কিন্তু দোষারোপের এই খেলায় জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের তেমন কোনো সুফল আসছে না। বরং নতুন গবেষণার দিকগুলোকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
গবেষক কেভিন হলের অনুসন্ধান ও বাধা
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ (NIH)-এর গবেষক কেভিন হল দাবি করেন, সংস্থার কর্মকর্তারা তার গবেষণার ফলাফল নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করতে বাধা দিয়েছেন—কারণ তা সরকারি বক্তব্যের সঙ্গে মিলছিল না।
তিনি বলেন, তার গবেষণায় দেখা গেছে আলট্রা-প্রসেসড খাবার মানুষকে বেশি খাওয়ার দিকে ঠেলে দেয়, কিন্তু কারণটা কেবল ‘স্বাদ’ নয়—এর পেছনে রয়েছে আরও জটিল বিষয়।
গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের দুই সপ্তাহ ধরে দুটি আলাদা খাদ্যতালিকায় রাখা হয়—একটি ছিল আলট্রা-প্রসেসড খাবার যেমন টার্কি বেকন, ফ্রাই, ইনস্ট্যান্ট নুডলস, চিকেন নাগেটস ইত্যাদি, আর অন্যটি ছিল তুলনামূলকভাবে প্রাকৃতিক ও অপরিশোধিত খাবার।
দুটি ডায়েটে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, সোডিয়াম ও ফাইবারের পরিমাণ সমান রাখা হয়। কিন্তু যারা আলট্রা-প্রসেসড খাবার খেয়েছিলেন তারা গড়ে প্রতিদিন ৫০০ ক্যালরি বেশি গ্রহণ করেন এবং কয়েক পাউন্ড ওজন বাড়ান।
‘স্বাদের কারণে নয়’—গবেষণায় নতুন সূত্র
অংশগ্রহণকারীরা জানান, দুই ধরনের খাবারই তাদের কাছে সমান স্বাদযুক্ত ও উপভোগ্য মনে হয়েছে। অর্থাৎ, শুধু ‘সুস্বাদু’ বলেই অতিরিক্ত খাওয়া হয় না।
কেভিন হল বলেন, “এখানে আরও আকর্ষণীয় কিছু ঘটছে যা এখনো আমরা পুরোপুরি বুঝতে পারিনি।”
এর পর থেকে তিনি ও তার সহকর্মীরা ২০১৯ সালের গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেন, যেসব খাবার মানুষ অতিরিক্ত খায়, সেগুলোর মধ্যে একটি প্যাটার্ন রয়েছে।
এই খাবারগুলো সাধারণত অতিরিক্ত সোডিয়াম ও স্টার্চযুক্ত, মিষ্টি ও তৈলাক্ত, অথবা নোনতা ও ফ্যাটসমৃদ্ধ। মনোবিজ্ঞানী ও আসক্তি বিশেষজ্ঞ টেরা ফাজিনো এসব খাবারকে বলেন “হাইপারপ্যালেটেবল”—অর্থাৎ এমন স্বাদযুক্ত যা শরীরের স্বাভাবিক ‘পেট ভরে গেছে’ সংকেতকে ব্যাহত করে।
আসক্তি না কি জৈবিক প্রতিক্রিয়া?
ফাজিনো বলেন, হাইপারপ্যালেটেবল খাবার সবসময়ই ‘সুস্বাদু’ নয়। তিনি ইতালির উদাহরণ দিয়ে বলেন, “এখানকার খাবারগুলো তাজা ও পরিতৃপ্তিকর, কিন্তু আসক্তিকর নয়।”
অর্থাৎ, আলট্রা-প্রসেসড খাবার হয়তো শরীরের স্নায়ুতন্ত্রের সংকেত নষ্ট করছে, যার ফলে মানুষ কখন পেট ভরে গেছে তা বুঝতে পারে না।
হাল এই বিষয়ে আরও একটি পরীক্ষা করেন। স্বেচ্ছাসেবকদের আলট্রা-প্রসেসড মিল্কশেক খাওয়ানোর পর তাদের মস্তিষ্কে ডোপামিনের মাত্রা মাপা হয়—যা আসক্তিজনক পদার্থের প্রভাবে বেড়ে যায়।
কিছু অংশগ্রহণকারীর ক্ষেত্রে ডোপামিন বেড়েছে, তবে ওজন বা স্থূলতার মাত্রার সঙ্গে এর সরাসরি সম্পর্ক পাওয়া যায়নি।
সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও বিতর্ক
NIH প্রথমে গবেষণার ফল প্রকাশের কথা বললেও পরে সেটি বাতিল করে। এমনকি নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলতেও হালকে বাধা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ।
তিনি বলেন, “আমার বক্তব্য পরিবর্তন করা হয়েছিল যাতে গবেষণার গুরুত্ব কম দেখায়।”
এ বিষয়ে HHS মুখপাত্র অ্যান্ড্রু নিকসন দাবি করেন, “হালের মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত করা হয়নি—এটি মিথ্যা খবর।”
খাদ্য আসক্তির বাস্তবতা
মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের আসক্তি বিশেষজ্ঞ অ্যাশলি গিয়ারহার্ড বলেন, “আমি এমন মানুষ দেখেছি যারা আলট্রা-প্রসেসড খাবারের প্রতি আসক্ত। তারা না খাওয়া পর্যন্ত শান্ত হতে পারেন না, ঠিক যেভাবে মদ্যপায়ীরা আচরণ করেন।”
তিনি আরও বলেন, “মানুষ সাধারণত আপেল, অ্যাভোকাডো বা মুরগির মাংস নিয়ে অতিরিক্ত খাওয়ার আসক্তি দেখায় না—তাদের আসক্তি পিজ্জা, আইসক্রিম, চকলেট বা ডোনাটে।”
ভবিষ্যৎ গবেষণা ও সম্ভাবনা
হাল এখন গবেষণা করছেন কীভাবে একইরকম সুবিধাজনক ও সাশ্রয়ী খাবার তৈরি করা যায় যা কম আসক্তিকর এবং ওজন না বাড়ায়।
প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, “রিফর্মুলেটেড” আলট্রা-প্রসেসড খাবার—অর্থাৎ হাইপারপ্যালেটেবল উপাদান বাদ দেওয়া সংস্করণ—খুব একটা স্বাদহীন হয় না, বরং তা মানুষের ওজন বৃদ্ধির প্রবণতা কমাতে পারে।
এই পদ্ধতি দোষারোপের চক্র থেকে মুক্ত হয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যেতে পারে—যা হয়তো একদিন আমাদের আরও সুস্থ করে তুলবে।
#স্থূলতা #খাদ্যআসক্তি #স্বাস্থ্যগবেষণা #আলট্রাপ্রসেসডখাবার #যুক্তরাষ্ট্র #বিজ্ঞান #সারাক্ষণরিপোর্ট